ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

নাসিমকে হারানোর ২ বছর

প্রভাব পড়েছে সিরাজগঞ্জের রাজনীতি ও উন্নয়নে

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২২
প্রভাব পড়েছে সিরাজগঞ্জের রাজনীতি ও উন্নয়নে ফাইল ছবি

সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের যে ক’জন কৃতি রাজনীতিবিদ জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ নাসিম তাদের অন্যতম। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণে শুধু নিজ দল নয়, বিরোধী রাজনীতির সমর্থকদের কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন।

 

সোমবার (১৩ জুন) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে হারানোর দুই বছর পূর্ণ হলো। এ দুই বছরে তার অনুপস্থিতির প্রভাব পড়েছে জেলার রাজনীতি ও উন্নয়নে।  

দলীয় সূত্র জানায়, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর মাত্র ১৩ দিনের মাথায় জেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অস্থিরতা নেমে আসে। ২০২০ সালের ২৬ জুন নাসিমের স্মরণসভায় যোগ দিতে এসে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হক বিজয়। এ হত্যাকাণ্ডের পরে দু’গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। ৭ জুলাই নিহত বিজয় স্মরণে মিলাদ মাহফিলে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হন ৪০ জন। তখন থেকেই জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে অস্থিরতা শুরু হয়।

এ অবস্থায় ১১ নভেম্বর দলের সভাপতি পদ থেকে সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বর্তমান এমপি হাবিবে মিল্লাত মুন্নাকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় যথাক্রমে অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসান ও আব্দুস সামাদ তালুকদারকে। এরপর চলতি বছরের ২৮ মার্চ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে ভারমুক্ত হন তারা।  

বর্তমানে দলের মধ্যে প্রকাশ্য কোনো বিভেদ দেখা না গেলেও ভেতরে ভেতের নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। অনেকেই বলেন, মোহাম্মদ নাসিম থাকতে জেলার কোথাও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সংঘর্ষ বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তিনি দলের যে কোনো কোন্দল তিনি দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করেছেন।  

এদিকে নাসিমের মৃত্যুর পর জেলার উন্নয়ন কার্যক্রমেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। শহরের মধ্য দিয়ে চারলেন মহাসড়ক প্রকল্পের কাজ রয়েছে বন্ধ। মুলিবাড়ীতে শেখ হাসিনা ট্রমা সেন্টার এখনো চালু হয়নি, বন্ধ রয়েছে কাজিপুরের ইকোপার্ক নির্মাণ। মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও চালু হয়নি শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। কাজিপুরে সোনামুখী মিনি স্টেডিয়ামের কাজ চলছে ঢিমেতালে। কাজিপুরে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ক্লাস শুরু হলেও সেখানে কোনো ইনস্ট্রুমেন্ট নেই। এছাড়া সিরাজগঞ্জ-কাজিপুর দুইলেন সড়ক নির্মাণকাজ চলছে মন্থর গতিতে।  ফাইল ছবি

কাজিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের সমকক্ষ নেতৃত্ব এখন আর নেই। তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন সারা বাংলাদেশের মতো সিরাজগঞ্জ তথা কাজিপুরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছেন। তার বেশিরভাগই তিনি শেষ করেছিলেন। এখন যেগুলো বাকি রয়েছে, তার কিছু চলছে ধীরগতিতে। বেশ কিছু বন্ধও রয়েছে। তার ছেলে এমপি তানভীর শাকিল জয় উন্নয়ন কাজে গতি ফেরাতে সচেষ্ট রয়েছেন।  

তিনি আরও বলেন, মোহাম্মদ নাসিম যে কোনো নেতাকর্মীকে মুহূর্তেই আপন করে নিতেন। তার সামনে কোনো সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ মাথা তুলে কথা বলার সাহস পেত না। কেউ তার সামনে উশৃঙ্খলতা করার সাহস দেখাত না। তাকে সবাই শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। তার অনুপস্থিতিতে দলের মধ্যেও কিছু কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তিনি।  

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক শামছুজ্জামান আলো বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর থেকে রাজনৈতিক অভিভাকহীনতায় ভুগছে সিরাজগঞ্জ। যে কারণে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে।  

জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুর রউফ পান্না বলেন, মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন সিরাজগঞ্জের উন্নয়নের প্রাণপুরুষ। তার নেতৃত্বে নয় তলা বিশিষ্ট চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিশাল ভবনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন হয়েছে।  

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি আবু ইউসুফ সূর্য বলেন, বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা যেমন পাব না, মনসুর আলীর মতো নেতাও পাব না। নাসিমের মৃত্যুর পর এখনো সিরাজগঞ্জের রাজনীতিতে শূন্যতা বিরাজ করছে। তিনি সবাইকে একই বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছিলেন। তার অভাব পূরণ হবার নয়। তার যে যোগ্যতা ছিল, সেটা দিয়ে সিরাজগঞ্জের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে অনেক কাজ স্থবির হয়ে আছে। আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ তালুকদার বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে সিরাজগঞ্জ শুধু নয় সারাদেশের রাজনীতিতেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তার মৃত্যুতে আমরা মাথার ওপর থেকে ছায়া হারিয়ে ফেলেছি। তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। জেলার রাজনীতিতে তার অভাব এখন আমরা বুঝতে পারছি।  

তিনি ছিলেন উন্নয়নের যাদুকর। ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জে অনেক স্থাপনা হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় দফায় তিনি মন্ত্রী হয়েও সিরাজগঞ্জে বৃহৎ উন্নয়ন সাধন করেছেন। সর্বশেষ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ উপহার দিয়েছেন তিনি। তার মৃত্যুতে সিরাজগঞ্জের মানুষ উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে।  ফাইল ছবি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর শহীদ এম মনসুর আলীর মেঝ ছেলে মোহাম্মদ নাসিম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কুড়িপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আশির দশক থেকে শুরু করে তিনি টানা পাঁচ দশক জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুব বিষয়ক সম্পাদক, এরপর প্রচার সম্পাদক, তারপর টানা দুই মেয়াদে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের পাশাপাশি ১৪ দলের মুখপাত্রের দায়িত্বে ছিলেন নাসিম।

টানা চার বারসহ মোট ছয় বারের সংসদ সদস্য নাসিম ১৯৯১ সালে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে দল ক্ষমতায় এলে প্রথমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ছিলেন।  পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৪ সাল থেকে তিনি পাঁচ বছর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।  

২০২০ সালের ১৩ জুন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরবিদায় নেন মোহাম্মদ নাসিম।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।