ঢাকা: মহানগর উত্তর বিএনপির ওয়ার্ড সম্মেলনে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির অভিযোগে স্থানীয় ১৪ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই ঘটনায় দলের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের আরও ১২ থেকে ১৫ জন নেতাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বহিষ্কারের পুরো প্রক্রিয়াটি দলীয় গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। বহিষ্কৃতদের কাউকেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়নি। এমনকি তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলা বা আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম অধিকারটুকুও দেওয়া হয়নি।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক অনুমোদিত এ বহিষ্কারাদেশের উদ্দেশ্য নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নও উঠেছে।
বহিষ্কার হওয়া নেতাদের দাবি, ইউনিট কমিটি গঠনে নগরের দেওয়া নির্দেশনা না মেনে একতরফাভাবে কিছু নেতাকে সুবিধা দিতে গিয়ে প্রতিবাদের মুখে পড়েন নগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক। প্রতিবাদের সময় মারধর বা লাঞ্ছিত করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে, আমিনুল হক ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে চাইলে প্রতিবাদকারীরা তার গাড়ীর সামনে শুয়ে পড়েন। তাদের এ প্রতিবাদের স্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। শুধুমাত্র প্রতিবাদ করার কারণে এত নেতাকে বহিষ্কার উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
বহিষ্কার হওয়া দুই নেতা ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে বিএনপির এক নেতার বাসায় গত ৫ জুন ছিল পূর্বনির্ধারিত উত্তরা পশ্চিম জোনের সাংগঠনিক ওয়ার্ড ১, ৫১ এবং বিমানবন্দর জোনের সাংগঠনিক সম্মেলন। ওই সম্মেলনের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই একতরফাভাবে ওয়ার্ডসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিটের কমিটি গঠন এবং কাউন্সিল করার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরে সব পক্ষকে সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। যার সমাধান চেয়ে বারবার চিঠিও দেওয়া হয়।
নগরের নির্দেশনায় প্রতিটি ওয়ার্ডের ইউনিট কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আহ্বায়ক, প্রথম ও দ্বিতীয় যুগ্ম আহ্বায়কের স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু নগর নেতারা নিজেদের ঘোষিত রেজ্যুলেশন ভেঙে একতরফা কিছু নেতাকে সুবিধা দিয়ে কমিটিগুলোর ঘোষণা দেন। যাতে ভোটের মাঠ সমতল না হওয়ার জোরালো অভিযোগ মহানগর উত্তরের নেতারা আমলে নেননি।
এছাড়া অনুষ্ঠিত ওয়ার্ড সম্মেলনের ভোট গণনার সময় প্রার্থীর এজেন্টকে গণনার বাক্স থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে রেজাল্ট ঘোষণারও অভিযোগ ওঠে। বার বার অনুরোধ করলেও প্রার্থীদের কোনো এজেন্টকেই গণনার সময় থাকতে দেওয়া হয়নি।
নেতারা আরও বলেন, ক্ষুব্ধ কয়েকশ নেতাকর্মী ওই ঘটনার নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ করে সেদিন স্লোগান দিচ্ছিলেন। ওই সময় মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক সেখানে উপস্থিত হন। প্রতিবাদ ও স্লোগানের মুখে তিনি চলে যেতে চাইলে নেতাকর্মীরা আমিনুল হকের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। সেখানে বিক্ষোভরত নেতাকর্মীরা সম্মেলনের আগে সমন্বয়ের দাবিতে স্লোগান ও শুয়ে পড়া ছাড়া কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছেন। মূলত, পাতানো কাউন্সিল ও সমন্বয়হীন কমিটি গঠনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতেই এমন গণবহিস্কারের ঘটনা ঘটিয়ে মূল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ দিকে নগর উত্তর বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, বহিষ্কার আদেশের চিঠি দিতে গিয়ে সদস্য সচিব আমিনুল হক জেদের বশবর্তী হয়ে কাজ করেছেন তা স্পষ্ট। এ ধরনের আদেশ বা বিজ্ঞপ্তি বিএনপিতে নজিরবিহীন এবং গঠনতন্ত্র পরিপন্থী।
তিনি বলেন, গত ১১ জুন নগরের দেওয়া চিঠিতে সংশ্লিষ্ট ১৪ নেতাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার না করে তাদের উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অথচ ওই ১৪ নেতা বহিষ্কারের দিন কোনো পদেই ছিলেন না। তারা সবাই বিভিন্ন ওয়ার্ড এবং থানার সাবেক নেতা। তাই সাংগঠনিক পদ থেকে কীভাবে বহিষ্কার করা হলো?
ওই নেতা আরও বলেন, এটি আসলে বহিষ্কার নয় বরং অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে একতরফা ও সমন্বয়হীন কমিটি গঠনের ঘটনা চাপা দেওয়ার প্রতিফলন মাত্র। তাছাড়া প্রাথমিকভাবে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত এক নেতাকে বিএনপির কেউ নয় বলে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার করলেও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসনে তিনি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত প্রাথমিক মনোনয়নের চিঠি পেয়েছিলেন। এখানে মহাসচিব এবং দলীয় চেইন অব কমান্ডও ভঙ্গ হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে।
সেদিন ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল হৃদয়। তিনি বলেন, আমরা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনে রাজনীতি করি। কাউকে বাদ দিয়ে নয়; সবাইকে নিয়ে রাজনীতিতে বিশ্বাসী তিনি। কিন্তু উত্তরাতে যা হয়েছে তা একতরফা হয়েছে। আমরা কয়েকশ নেতাকর্মী উপস্থিত হয়ে সমন্বয় করতে বলেছিলাম। সেখানে আমিনুল ভাইয়ের সঙ্গে কেউ কোনো অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করেনি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিশ্বাস, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মাধ্যমে তদন্ত করে সঠিক তথ্য জানতে পারলে তিনি বিগত আন্দোলন সংগ্রামে আমাদের ভূমিকার কারণে বহিষ্কার নয় বরং পুরস্কৃত করবেন।
এদিকে, ওই ঘটনায় উত্তরের যুগ্ম আহ্বায়ক আক্তার হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যদিও তদন্ত কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বহিষ্কৃত নেতারা। তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত কারও বক্তব্য নেয়নি এবং কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেননি। একতরফা তড়িঘড়ি করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্রথম দিনের সংকটের সুযোগ নিয়ে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে বলেও তারা দাবি করেন।
জানতে চাইলে মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য (দফতরের দায়িত্ব) জিয়াউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ১৪ জনকে সরাসরি বহিষ্কার করা হয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তারা তাদের মতো করে ব্যবস্থা নেবে।
বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে এমন প্রশ্নে জিয়াউর রহমান বলেন, যারা বহিষ্কার হয়েছে তাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিশৃঙ্খাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় অনেকে খুশিও হয়েছেন।
যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের কারণ দর্শাও নোটিশ না দিয়েই বহিষ্কার করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ তাদেরকে সরাসরি বহিষ্কার করা হয়েছে। মহানগর নেতারা এটা করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২২
এমএইচ/এমজে