ঢাকা: গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে পুনরায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে দলটির দুই অংশের মধ্যে।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন অংশ দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর হঠাৎ কমিটি ঘোষণা দিয়ে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন।
অপরদিকে মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন অংশ বেশ কিছুদিন যাবত গণফোরাম নামে এককভাবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছিল। গত বছর (২০২১সালে) ০৩ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কাউন্সিলের মাধ্যমে মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে সভাপতি ও অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৫৭সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কাউন্সিলে ড. কামাল হোসেন লিখিতভাবে একটি শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠান। তাকে ওই কমিটির প্রধান উপদেষ্টার পদে রাখা হয়। ওই কমিটিতে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে যার নাম ছিল সেই ডা. মিজানুর রহমান এখন আবার ড. কামাল হোসেনের কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন।
জানা গেছে, ১৭ সেপ্টেম্বর কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন অংশ কমিটি ঘোষণার পরদিনই মন্টু-সুব্রত নেতৃত্বাধীন অংশ বৈঠকে বসেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে ২০ সেপ্টেম্বর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে অব্যাহতি ও ডা. মো. মিজানুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কারের কথা জানান। এ নিয়ে দুই অংশের মধ্যে উত্তেজনার সৃস্টি হয়েছে।
ড. কামাল হোসেনের নবগঠিত কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোশতাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, স্যারকে (ড. কামাল) প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে তারা অব্যাহতি দিয়েছেন। ওনারা এটা মনের মতো করে বানিয়েছেন। স্যার কি এটা একসেপ্ট করেছেন না স্যার সেখানে গেছেন, না স্যার জানেন অব্যাহতি দিলে আমাদের কি আসে যায়? স্যারতো গণফোরামের প্রেসিডেন্ট। তারা অব্যাহতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা থেকে। এই পদতো গঠনতন্ত্রে নেই। গঠনতন্ত্রে কোনো উপদেষ্টা পদই নেই।
আপনাদের নতুন কমিটির সেক্রেটারি মিজানুর রহমান ওই গ্রুপের কমিটিতে ছিলেন সে বিষয়ে কী বলবেন জবাবে তিনি বলেন, ছিলেন। তাকে প্রেসিডিয়াম মেম্বার করে রেখেছিল। তিনিতো সেখানে কখনো যাননি, সইও করেননি। তার আগে তারা যে আহ্বায়ক কমিটি করেছিলেন সেখানে আমাকেও যুগ্ম-আহ্বায়ক করা ছিল। আমি এটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি।
মোশতাক আহমেদ আরও বলেন, গণফোরাম একটা নিবন্ধিত দল। সেই নিবন্ধনতো আমাদের রয়েছে। তাদের নিবন্ধন নেই। এগুলো করার কোনো মানে নেই।
তারা যে সংবাদ সম্মেলন করলেন এর বিরুদ্ধে আপনারা কি কিছু করবেন জবাবে তিনি বলেন, আমি এসব গুরুত্ব দিতে রাজি না। তবে আজকে বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) আমরা প্রেসিডিয়াম বৈঠক করবো। তারপরে সিদ্ধান্ত হবে।
জানতে চাইলে মন্টু-সুব্রত অংশের সহ-সাধারণ লতিফুল বারী হামিম বলেন, আমরা সম্মেলন করে কমিটি করেছি। সম্মেলনে গঠনতন্ত্রের ধারা বাড়ানো কমানো যায়। আমরা সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা পদ সৃষ্টি করে ওনাকে (ড. কামাল) প্রধান উপদেষ্টা রেখেছিলাম। উনি সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে চিঠিও দিয়েছিলেন। কমিটি করার সময় ওনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, আমি থাকবো না তোমরা কমিটি করো। তখন আমাদের নেতারা বলেছিলেন আপনি সভাপতি না হলে প্রধান উপদেষ্টা থাকবেন। তার সম্মতি নিয়েই তাকে প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছিল। এখন সম্মেলন না করে উনি একটা সংবাদ সম্মেলন করে কমিটি করলেন। এটা কি গঠনতন্ত্রের কোথাও আছে? পুরোনো কোনো রাজনৈতিক দলের কমিটি কাউন্সিল ছাড়া হতে পারে না। তারা যদি আলাদা গণফোরাম করতে চায় তাহলে সম্মেলন করেছে, না কি বর্ধিত সভা ডেকেছে বর্ধিত সভা না, সম্মেলন না, কামাল হোসেনের চেম্বারে বসে কয়েকজন মিলে কমিটি করলেন। এটা কী হয়ে গেল?
তিনি বলেন, ওনারা প্রেসক্লাবে যে ১০১জনের কমিটি ঘোষণা করলেন তারা কি সেখানে উপস্থিত ছিল শুধু নাম দিয়ে একটা কমিটি করলেই হবে না। অনেকে আছেন যারা দল থেকে দীর্ঘদিন আগে চলে গেছেন। মফিজ কামাল সাহেবকে ড. কামাল হোসেন চেম্বার থেকে বের করে দিয়েছিলেন। উনি গণফোরাম ছেড়ে দিয়েছেন। আলতাফ সাহেব চলে গেছেন। তাদেরকে আবার কমিটিতে এনেছেন।
সেক্রেটারি যাকে বানিয়েছে উনি দীর্ঘদিন নিস্ক্রিয়। আমাদের সম্মেলনের সময় এসে উনি মন্টু ভাইকে বলেছেন, দাদা আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই। উনি কোথাও চলে গেলেতো বলে যাওয়া উচিত ছিল। সেটা করেননি। সামান্য ভদ্রতাও দেখাননি। যেহেতু শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন সেজন্য তাকে বহিষ্কার করেছি। এসময় ডা. মিজানুর রহমানের হারবাল ব্যবসা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন লতিফুল বারী হাবিব।
তিনি বলেন, কামাল হোসেন সাহেবের দলের সেক্রেটারি হওয়ার মতো যোগ্যতা ডা. মিজানুর রহমানের নেই। কামাল হোসেন সাহেবের স্মৃতিভ্রম হয়ে গেছে। বয়সের কারণে যেসব সমস্যা হয়, উনি সেই সমস্যায় ভুগছেন। সে কারণে এ ধরনের একটা লো-প্রোফাইলের লোককে সেক্রেটারি বানিয়েছেন। দলছুট, পদত্যাগকারী, যারা রাজনীতিতে নেই এ সমস্ত লোককে দিয়ে উনি কমিটি করেছেন। এ কমিটি কোনো রাজনীতির মঞ্চে থাকবে না। এ ধরনের রাজনৈতিক দল আমাদের রাজনীতিকে কলুসিত করবে। কামাল হোসেন সাহেবকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু উনি যে কাজটি করলেন সেই কাজের মধ্যে দিয়ে উনি ওনার আসনে আর থাকলেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের শুরুর দিকেই ভাঙনের মুখে পড়ে গণফোরাম। ওই বছর মার্চ মাসে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দলটি কার্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। একটিতে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে থাকেন ড. রেজা কিবরিয়া। আর দ্বিতীয় গ্রুপটির নেতৃত্বে আছেন মোস্তফা মহসীন মন্টু ও অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তাদের সঙ্গে আছেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জগলুল হায়দার আফ্রিক, অ্যাডভোকেট মহসীন রশীদ।
২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দলীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী, জগলুল হায়দার আফ্রিক, হেলালউদ্দিন, লতিফুল বারী হামিম, খান সিদ্দিকুর রহমান ও আবদুল হাসিব চৌধুরীকে বহিষ্কার করা হয়। এদের মধ্যে হেলাল, লতিফুল, সিদ্দিকুর ও হাসিব চৌধুরীকে আগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল।
তার একদিন পরেই কামাল হোসেনের অংশের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া, সহ-সভাপতি মহসীন রশীদ, সহ-সভাপতি আ ও ম শফিকউল্লাহ ও যুগ্ম সাধারণ মোস্তাককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মাঝখানে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় সদস্যপদ থেকে রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগসহ বেশকিছু ঘটনা ঘটে। তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গণফোরামের ভাঙন আরও দৃশ্যমান হয়। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর গণফোরামের একাংশের কাউন্সিলে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে সভাপতি ও সুব্রত চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এরপর এ বছর ১২ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে গণফোরামের দুই পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের একাংশের কাউন্সিলে আরেক অংশের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ ওঠে। এতে কামাল হোসেনের অংশের নির্বাহী সভাপতি মোকাব্বির খান এমপিসহ প্রায় ২০ জন নেতাকর্মী আহত হন। সেই সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে ঢুকে কাউন্সিলের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করা হয়। পরে পুলিশ এসে এক পক্ষকে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে বের করে দেয়।
সেদিন গণফোরামের কাউন্সিল ঘিরে দলটির বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে দিনভর উত্তেজনা বিরাজ করে। এদিনে কামাল হোসেনের অংশ জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে কাউন্সিলের আয়োজন করে। অপরদিকে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন অংশ প্রেসক্লাবের সামনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মানববন্ধনের আয়োজন করে। সেদিন হামলাকারীরা বলেন, মোকাব্বির খানসহ এই অংশের নেতাকর্মীরা সরকারের দালাল।
আবার হামলার বিষয়ে মোকাব্বির খান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাউন্সিলের আয়োজন করেছি। এটা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি, কিন্তু কিছু দুষ্কৃতকারী কাউন্সিলে হামলা করে আমাকেসহ আরও অনেককে আহত করেছে। এটা গণতন্ত্রের ওপর হামলা। গণফোরাম থেকে বহিষ্কৃতরা এই হামলা চালিয়েছে।
সেই ঘটনার পরপরই গণফোরামের ভাঙন আরও প্রকাশ্যে আসে। এরপর থেকেই ঢিমে-তালে চলে দুই অংশের কাজ। সেই সঙ্গে দুই অংশই নিজেদের আসল গণফোরাম দাবি করে। এরমধ্যে গেল ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি ও ডা. মো. মিজানুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে গণফোরামের ১০১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওইদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সংবাদ সম্মেলনে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরে কমিটির ১০১ সদস্যের নাম পড়ে শোনান নতুন সাধারণ সম্পাদক। এর দুদিন পরই মন্টুর নেতৃত্বাধীন অংশ সংবাদ সম্মেলন করে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ও তার সেক্রেটারি ডা. মিজানুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।
এদিকে, ড. কামাল হোসেনকে দলের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে অব্যাহতি ও ড. কামালের অংশের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মিজানুর রহমানকে সভাপতি পরিষদের সদস্য পদসহ দলের সাধারণ সদস্য পদ থেকেও বহিষ্কার করে সবশেষ মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করেন মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম।
এদিন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক বলেন, আজ আমাদের জাতীয় জীবনের চরম সংকটময়কাল যখন জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য, সেই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন ও মো. মিজানুর রহমান গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষিত কমিটি সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র পরিপন্থী ও অগণতান্ত্রিক।
প্রসঙ্গত, ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ১৯৯৩ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে বেরিয়ে আসা সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিককে সঙ্গে নিয়ে গণফোরাম গঠন করেন। পরে মানিক মারা গেলে আওয়ামী যুবলীগ থেকে আসা মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলটি বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে অংশ নিয়ে প্রথম সংসদে যায়। দলের প্রতীক উদীয়মান সূর্য নিয়ে সিলেট-২ আসনে বিজয়ী হন মোকাব্বির খান। যিনি এখন ড. কামাল হোসেনের অংশে রয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২
এমএইচ/এসআইএস