ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

সামিট চুক্তি না মানলেও নির্বিকার পিডিবি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২১ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১২
সামিট চুক্তি না মানলেও নির্বিকার পিডিবি

ঢাকা: সামিট পাওয়ারের হাতে বৃহৎ তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তুলে দিয়ে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সামিট চুক্তির ধারা লঙ্ঘন করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পাচ্ছে না রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।

দফায় দফায় সময় বাড়ানোর পরও কাজই শুরু করতে পারেনি সামিট। এখন গোঁ ধরেছে অর্থের সংস্থান করে দিতে হবে।

২০১১-এর ১২ মে মেঘনাঘাট ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট ও  ১৫ মে বিবিয়ানা ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট ইউনিট-১ ও একই ক্ষমতার ইউনিট-২ নির্মাণের চুক্তি সই করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

গ্যাসভিত্তিক এই তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে মেঘনাঘাট ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে এবং বিবিয়ানা ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ একইবছর আগস্ট মাসে উৎপাদনে যাওয়ার কথা। কিন্তু ১ বছর ২ মাস পার হলেও দুটি ই‌উনিটের কাজই শুরু করতে পারেনি সামিট। তারা দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে চলেছে।

চুক্তি অনুযায়ী অর্থ সংস্থানে সরকারের কোনো দায় না থাকলেও এখন সামিট গোঁ ধরেছে বিশ্বব্যাংক অথবা এডিবির কাছ থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা না হলে তাদের পক্ষে এই দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ করা সম্ভব নয়।

সামিটের এই বক্তব্যের পরে তাদের গ্যারান্টি মানি এক কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার বাতিল করার কথা ছিল। কিন্তু পিডিবি তা না করে দফায় দফায় সময় বাড়াচ্ছে। এতে করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

পিডিবি সূত্র জানায়, গত ১২ মার্চ বিবিয়ানা ইউনিট-১ ও ই‌উনিট-২-এর অর্থ সংস্থানের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। সময়সীমা শেষের দু’দিন আগে সামিট সরকারের কাছে অর্থ সংস্থানের জন্য আরও ছয় মাস সময় চেয়ে আবেদন করে।

আবেদনে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান টানাপোড়েনকে অর্থসংস্থান না হওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়। সামিটের আবেদনটি নিয়ে পরবর্তীতে বিদ্যুৎ বিভাগ একটি বৈঠক করে। এতে বিদ্যু‍ৎ বিভাগের পক্ষ থেকে সামিটকে অর্থ সংস্থানের চাপ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, সর্বশেষ গত ১৮ জুন ১৫ দিনের মধ্যে কাজ শুরু করার জন্য সামিটকে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়। যা গত ১৮ জুলাই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সামিট কাজ শুরুর জন্য মৌখিকভাবে আরও দুই মাসের সময় চেয়েছে।

পিডিবির বিবেচনায় এ মুহূর্তে কাজ শুরু করলেও যথাসময়ে আসতে পারবে না এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি।

এদিকে, বর্তমান সরকারের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানের পরিবারের মালিকানা হওয়ায় সামিটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পাচ্ছে না পিডিবি। এখন সামিটের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলে তাদের গ্যারান্টি মানি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এই ভয়েই নাকি পিডিবি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলে পিডিবির একটি সূত্র দাবি করেছে। কর্নেল (অব.) ফারুকের ভাই সামিটের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ খান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাসভিত্তিক এই বড় দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র যথাসময়ে উৎপাদনে আসলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ব্যাপক উন্নয়ন হতো। যে এক হাজার মেগাওয়াট কুইক রেন্টালের জন্য দেশের অর্থনীতি এখন নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে, সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু এখন যথা সময়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি উৎপাদনে না আসতে পারায় বিদ্যুৎ বিভাগ চরম সংকটের মুখে পড়বে।

বাধ্য হয়েই কুইক রেন্টালের নির্ভর করতে হবে। আর তেমন হলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে দাবি জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের।

পিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, বর্তমান সরকারের কবর রচনার জন্য সামিটেই যথেষ্ট। যে ভাবে চলছে তাতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি না হবে অবনতি হতে পারে।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, সামিটের ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকলেও এত বড় বিদ্যুৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারপরও একই সঙ্গে বৃহৎ তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া কোনো সুস্থ চিন্তার পরিচয় বহন করে না।

পিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন ছোট ছোট কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রই যথা সময়ে নির্মাণ করতে পারেনি সামিট। সে কারণে তাদের জরিমানা করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় ঠিকই কাজ বাগিয়ে নিয়েছে সামিট।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, সামিট কুইক রেন্টালের জন্য গত মে মাস পর্যন্ত জরিমানা দিয়েছে ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, “বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টির কাজ এখনও শুরু করতে পারেনি সামিট। আমরা বিকল্প চিন্তা করছি। ” এ ব্যাপারে শিগগিরই সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হবে বলেও জানান বিদ্যুৎ সচিব।

উল্লেখ্য, বিবিয়ানা-১ ৩৩০-৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রাক-যোগ্যতার প্রস্তাব আহ্বান করা হলে ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল ৭টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের যোগ্যতার দলিলপত্র জমা দেয়।

চারটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা হলেও তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দলিল (আরএফপি-রিকোয়েস্ট ফর প্রপজাল) কেনে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে। মূল্যায়নে পরিকল্পিতভাবে মালয়েশিয়ার ওয়াইটিএল পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল বারহাডকে নন-রেসপনসিভ (দায়িত্বশীল নয়) ঘোষণা করা হয়। এটা করা হয় মূলত সামিটকে কাজ দেওয়ার জন্য। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরা হয় ২ দশমিক ৩২৪১ টাকা।

বিবিয়ানা ইউনিট-২ ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গত বছরের ২ মে ১২টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্যতার দলিলপত্র দাখিল করে। আটটি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্য প্রতিষ্ঠানের ৫টি দরপত্র দলিল (আরএফপি) কিনলেও ১৪ অক্টোবর মাত্র ৩টি দরপত্র জমা হয়। এই কেন্দ্রের বিদ্যুতের দর ধরা হয় প্রতি ইউনিট ২ দশমিক ৩৭৮০৪ টাকা।

এ বিষয়ে সামিট পাওয়ারের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ খানের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০১ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১২
ইএস/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।