ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বাংলানিউজকে খোরশেদুল আলম

এনডব্লিউপিজিসিএল: শক্ত ভিত ও সফলতার গল্প

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪
এনডব্লিউপিজিসিএল: শক্ত ভিত ও সফলতার গল্প ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। লোকসান দিতে দিতে কিছু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হবার পথে হাঁটছে।

লোকসান ঠেকাতে না পেরে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে এ ধরনের অনেক লোকসানি প্রতিষ্ঠান।

অথচ ঠিক একই সময়ে এর পুরোপুরি ব্যতিক্রম নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল)। মাত্র কয়েক ৫ বছর বয়সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানি।

দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান যথা সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে দফায় দফায় ব্যয় বাড়াচ্ছে। তখন সব প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে আনতে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রীয় এ কোম্পানিটি। এ-কারণে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ২০১৩ সালে বেস্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে এই কোম্পানিকে।

এনডব্লিউপিজিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশদুল আলম বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানটির এগিয়ে চলা এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। তার একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিটে কর্মরত সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সেরাজুল ইসলাম সিরাজ।

বুয়েট থেকে পাশ করার পর তার অনেক বন্ধু বেশি আয়ের জন্য বিদেশ পাড়ি দেন। তখন (১৯৭৬) এএম খোরশেদুল আলম যোগ দেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে। এরপরও অনেক অফার পেয়েছিলেন বিদেশ গিয়ে বেশি আয়ের।

কিন্তু নিজের মেধাকে দেশের কাজে লাগাতে দেশেই থেকে যান। টানা ৩৭ বছর ধরে বিদ্যুৎ খাতে রয়েছেন। অনেক বড় বড় দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে এনডব্লিউপিজিসিএল গঠনের সময় তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শূন্য থেকে তিলে তিলে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছেন এনডব্লিউপিজিসিএল। এক হাতে সামলে নিয়েছেন সবকিছু। সরকার ও এডিবির ঋণের টাকায় গঠন হয় কোম্পানিটির মূলধন। সেই ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ ও খুলনায় প্ল্যান্ট থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যাচ্ছেন।
 
ভেড়ামারা ৪১৪ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। চীনের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় পটুয়াখালীতে কয়লা ভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, খুলনায় এলএনজি ভিত্তিক ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।

২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়ানক সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে। হরতাল-ধর্মঘট যখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়, তখন দেশের অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজেও বিলম্ব হয়। ঠিক সেই সময়ে খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট সিম্পল সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজ শেষ করে উন্নয়ন সহযোগিদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছে দেশীয় এই কোম্পানিটি।

এ-কারণে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ২০১৩ সালে এই দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বেস্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে। এডিবি বিদ্যুৎকেন্দ্র দু’টিকে মডেল হিসেবে ধরে বিভিন্ন স্থানে একে উদাহরণ হিসেবে টানছে। জানালেন প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম।

তিনি জানান, এডিবির প্রেসিডেন্ট প্রকল্পের সিরাজগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে গেছেন। ২২ সেপ্টেম্বর পরিদর্শনে আসছেন ৫ জন বোর্ড-পরিচালক।

নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগকে কৃতিত্ব দিতে হয়। কোনো ফাইল একদিনও আটকে থাকে না। যেদিন ফাইল যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

এছাড়া এডিবি ও কনসালট্যান্টদের সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। এটা এক বড় শক্তি ও প্রেরণা বটে।

সেই সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিজস্ব একটা ফরমুলার কথাও জানান। তিনি বলেন, কোনো প্রকল্পের পিডিকে (প্রকল্প পরিচালক) কোনো সিদ্ধান্তের জন্য হেড অফিসে আসতে হয় না। আমরাই প্রত্যেক সপ্তাহিক ছুটির দিনে সেখানে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে অন দ্য স্পট সভা করি।

এতে চলমান ও পরবর্তী সপ্তাহের কাজের বিষয়ে কোনো জটিলতা থাকলে তা নিরসন করা হয়। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে কোনো কাজ কখনও থেমে থাকেনি। এ-কারণে সব প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সমাধা করা সম্ভব হয়েছে বলেও জানান তিনি।

চলমান প্রকল্প সম্পর্কে জানান, আমাদের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হতে যাচ্ছে পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি সিএমসির সঙ্গে যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শেষ করা হবে।

এরই মধ্যে যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের চুক্তি স্বাক্ষরও হয়ে গেছে। চলছে কোম্পানি গঠনের কাজ। কোম্পানির নামকরণ করা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি’।

সমান সমান শেয়ারে গঠিত এই কোম্পানিতে মোট ৬ জন পরিচালক থাকবেন। এতে বাংলাদেশের ৩ জন ও চীনা সরকারের মনোনীত ৩ জন পরিচালক থাকবেন। ৫ বছর পর পর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হবেন। প্রথম দফায় চেয়ারম্যান থাকছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম।

বাংলাদেশের পক্ষে থাকবেন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও এনডব্লিউপিজিসিএল এমডি। ইসিএ ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করার চিন্তা হচ্ছে। এর পাশাপাশি চীন সরকারের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা চলছে।

চীনের বেশ কয়েকটি ব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানান খোরশেদুল আলম।

কোম্পানি গঠনের পাশাপাশি প্রি-ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির কাজ চলছে। প্রি-ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করছে চীনা প্রতিষ্ঠান এফইডিআই। নভেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে। এরই মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্র দিয়েছে। এটা সহজেই পূরণযোগ্য বলে মনে করছেন এই প্রকৌশলী।

প্রথম ইউনিট থেকে ২০১৮ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশা করছেন তিনি।

তার কথা যদি বাস্তব রূপ নেয় তাহলে এটাই হবে বাংলাদেশের প্রথম সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি।

একই ক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের আলোচনার শুরু হয় ২০১০ সালে। আর পটুয়াখালীর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয় গত বছরের শেষ দিকে। সে হিসেবে অনেক গোছানো বলা যেতে পারে নতুন এই প্রকল্পটি। যা সরকারের জন্য সত্যিই স্বস্তিদায়ক খবর হতে পারে।

খোরশেদুল আলম বলেন, ‘যেহেতু আমাদের গ্যাস সীমিত, তাই আমরা বিকল্প জ্বালানির বিষয়টাও সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছি। খুলনায় এলএনজি (লিকুইডিফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) ভিত্তিক ৮০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্টের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

ভারত থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে এলএনজি আসবে। গেইল ইন্ডিয়া এলএনজি সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে সফলতার আরেক মাইলফলক। এই প্রকল্পে এডিবির অর্থায়ন পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এনডব্লিউপিজিসিএল’র উপর আস্থা বৃদ্ধি পাওয়ায়ই এটা সম্ভব হয়েছে বলে জানান খোরশেদুল আলম।

নতুন এই কোম্পানিটি এরই মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। আরও শক্ত ভিত রচনা করতে কাজ করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা সরকারের উপর নির্ভর করে থাকতে চাই না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নিজস্ব অর্থায়নে নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাই। সে লক্ষেই কাজ করে যাচ্ছি। ’

সিরাজগঞ্জ ও খুলনা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রি করে মাসে আয় হচ্ছে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। এই অর্থ গ্যাসবিল খাত, এডিবির ঋণের সুদাসল পরিশোধ, বাংলাদেশ সরকারের সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ, অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স খরচ ও ডেফিসিয়েশন খাতের জন্য পৃথক অ্যাকাউন্টে আনুপাতিক হারে জমা করা হচ্ছে।

সেখান থেকে নিয়মিতভাবে এডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের ঋণ ও সুদের কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে। মে এবং নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের সুদসহ ঋণের কিস্তি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। যথা নিয়মে গত মে মাসে ১৭৫ কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। কোনো বকেয়া নেই বলে জানান তিনি।

কর্মচারিদের জন্য উদার এনডব্লিউপিজিসিএল। গত বছর কয়েকটি বোনাস দিতে সক্ষম হয়েছেন। এ-কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে রয়েছে কাজের উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ছাপ। সব মিলিয়ে নতুন এই কোম্পানিটি বিদ্যুৎ খাতে মডেল হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।