ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

ফিরে দেখা-২০১৪

বিদ্যুতে অর্জন বিরাট, তবু পিছু ছাড়েনি লোডশেডিং

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
বিদ্যুতে অর্জন বিরাট, তবু পিছু ছাড়েনি লোডশেডিং ছবি:ফাইল ফটো

ঢাকা: নির্বাচনী ইস্তেহার ছাড়িয়ে গেছে সরকার, কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিং পিছু ছাড়ছে না। সরকার বলছে লোডশেডিং নয় বিদ্যুতের বিভ্রাট হচ্ছে।

এ কারণে বছরজুড়েই (২০১৪) বিভ্রাট নিয়েই বিভ্রাটে ছিলেন অনেকে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহার ‘ভিশন-২০২১’ ছিল ২০১৩ সালে উৎপাদন ক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০১৫ সালের মধ্যে ৮ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা। সেই নির্বাচনী ইস্তেহারকেও বাস্তব অর্জন ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই।

২০১৩ সালে ৭ হাজারের স্থলে ১০হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করে দেশ। একে উদযাপনও করা হয় ঘটা করে। আয়োজন করা হয় আলোক উৎসবের। আর ২০১৪ সালে উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে আরও ৮’শ মেগাওয়াট।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন দেশে লোডশেডিং ছিলো অসহনীয় পর্যায়ে।   তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী একাধিক সভায় বলেছিলেন, ২০১৪ সাল নাগাদ লোডশেডিংমুক্ত হবে দেশ। কিন্তু ২০১৪ সাল পেরিয়ে গেলেও লোডশেডিংমুক্ত হয়নি। গ্রাম-মফস্বল থেকে প্রতিদিনই লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে তা স্বীকারই করা হচ্ছে না। সব সময় বলা হচ্ছে, ‘লোডশেডিং নয় বিদ্যুৎবিভ্রাট হচ্ছে। আর তা উৎপাদন স্বল্পতার কারণে নয়, বিতরণে সমস্যার কারণে হচ্ছে। ’ এভাবেই চলছে কথার মারপ্যাঁচ।

বিদ্যুৎ,জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সঞ্চালন ও বিতরণে সমান মনোযোগ দিতে না পারায় বিদ্যুৎবিভ্রাট হচ্ছে। মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহে জন্য সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী জনগণের কাছে আরও কিছুটা সময় চেয়েছেন।

নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব দেখাতে পারলেও বিদ্যুৎ বিভাগের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সফলতা দেখানো সম্ভব হয়নি ২০১৪ সালে। মাস্টার প্ল্যানে বলা হয়েছিলো, ২০১৪ সালে ১ হাজার ৯৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। কিন্তু এর অর্ধেকও উৎপাদন করা যায়নি।

বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা না গেলেও অনেক অগ্রগতি রয়েছে। সার্বিক অগ্রগতিতে আমরা সন্তুষ্ট।

২০১৪ সালে  উৎপাদনে যে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র
জানুয়ারিতে উৎপাদনে এসেছে নাটোর ৫০ মেগাওয়াট আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট), মে মাসে ফার্নেস অয়েল চালিত বারাকা-পতেঙ্গা ৫০ মেগাওয়াট ও সামিট গ্রুপের মেঘনাঘাট ২০৩ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট।

জুনে উৎপাদন শুরু করে ডিজিটাল পাওয়ারের ফার্নেস অয়েল চালিত গগননগর ১০২ মেগাওয়াট, জুলাই মাসে যুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট ও ঘোড়াশাল ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি এনডব্লিউপিজিসিএল এবং রিজেন্ট পাওয়ারের মালিকানায় নির্মিত হয়েছে।

অন্যদিকে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে রয়েছে। শিগগিরই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে। এগুলো হচ্ছে পটিয়া ১০৮, জাঙ্গালিয়া ৫০ ও কাঠপট্টি ৫০ মেগাওয়াট পাওয়া প্লান্ট।

আগামী বছরের শুরুতেই সরকারি খাতের আশুগঞ্জ ২২৫ এবং ভোলা ১৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
 
বিনিয়োগের বছর
২০১৪ সালকে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের বছর হিসেবে অভিহিত করছে সংশ্লিষ্টরা। কারণ এই বছর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এসেছে এই খাতে। এছাড়া জাপান, সিঙ্গাপুর, সৌদিআরব মালয়েশিয়া, চীনসহ বেশ কিছু দেশ বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।

চীনের সঙ্গে পটুয়াখালীতে, মালয়েশিয়ার সঙ্গে মাতাবাড়িতে যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপসহ অনেক দেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা কোম্পানি বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। এ-কারণে এই খাতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে বলে মনে করে বিদ্যুৎ বিভাগ।

অন্যদিকে এ বছরেই প্রথম নিজস্ব তহবিলে বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিবিয়ানা (দক্ষিণ) ৩৮৩ মেগাওয়াট নামের এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩২২ মিলিয়ন ডলার।
 
আলোচিত ঘটনা
পহেলা নভেম্বর দেশজুড়ে বিদ্যুতের ব্ল্যাকআউট ছিলো এই খাতের জন্য সবচেয়ে নেতিবাচক এক আলোচিত বিষয়। বেলা ১১.২৭ টায় একযোগে সারাদেশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। বিকেল নাগাদ সামান্য সরবরাহ শুরু হলেও আবার হাইভোল্টেজের কারলে উৎপাদন প্রায় শুন্যে নেমে আসে।

বিদ্যুৎ না থাকায় রাজধানীসহ শহরগুলো ভূতুড়ে রূপ ধারণ করে। আলো জ্বালানোর জন্য মোমবাতির আশ্রয় নিয়েও রক্ষা হয়নি মানুষের। ৫ টাকার মোমবাতি বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা বা আরও বেশি দামে। রাত ৯টা নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। মধ্যরাতে গিয়ে পরিস্থিতি সহনীয় আসে।

তবে ওই ঘটনার পর সারাদেশে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে দেশবাসী। এ কারণে দেশবাসীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।

ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট কারণ উদঘাটন করতে পারেনি। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে ২৯ দফা সুপারিশ দিয়েছে তারা।

বিদ্যুৎখাত
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিলো ৪ হাজার ৯৩১ মেগাওয়াট। আর বর্তমানে ১১ হাজার ২৬৫ মেগাওয়াট সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে বেজড লোড বিদ্যুৎ কেন্দ্র না বসিয়ে কুইক রেন্টাল, এবং পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এর স্থায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় সমলোচনা হয়েছে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি স্থাপন করায়। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিলো প্রায় সোয়া দুই টাকার মতো। ৬ বছরের ব্যবধানে তা ৬ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য সামাল দিতে ৭ দফা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। তারপরও প্রতি বছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হয়েছে। আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বর্তমান সরকার ৭৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি করেছে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১১হাজার ১২৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে উৎপাদনে এসেছে ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা থেকে ৬হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। আর অন্যগুলো নির্মাণাধীন রয়েছে।

বর্তমান সরকারের ৬ বছরে ৪৬ লাখ নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দিতে চায় সরকার।
কিন্তু পল্লী বিদ্যুতায়ণ বোর্ড (আরইবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার মঈন উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের মধ্যেই সব গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে চাই। এজন্য প্রয়োজনীয় সব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

অফ গ্রিড (বিদ্যুতের লাইন নির্মাণ ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য) এলাকা যেমন হাওড় ও দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল এর বাইরে থাকছে বলে জানিয়েছে আরইবি চেয়ারম্যান।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের ইতিহাসে ২০১৪ সাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়া হয়েছে এই বছর। যার সুফল দেশবাসী কিছুদিন পর থেকে পেতে শুরু করবে।

লোডশেডিং ও মানসম্মত বিদ্যুতের জন্য ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০,

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।