ঢাকা: বলা হয় বীজ সার সেচ যত্ন, এই চারে মিলে রত্ন। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের সার্বিক কৃষি উন্নয়ন এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সরকার বাস্তবমুখী নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ফসলে মাঠ হাসলেও মলিন থেকে যাচ্ছে কৃষকের মুখ।
কেবল ন্যায্য মূল্য না পাওয়াই নয়, সন্তানতুল্য ফসল ব্যবস্থাপনায় সার্বিক সহযোগিতার অভাব কৃষকের ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’র মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত তিন দশকে বীজ সরবরাহ ৭ হাজার মেট্রিক টন থেকে ২ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা হলেও, পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের অভাবে অনুমোদন ছাড়াই এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কৃষকের হাতে তুলে দিচ্ছে নিম্নমানের বীজ।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নিয়ম মেনে ধানের বীজ উৎপাদন করার কথা থাকলেও পূর্ব অনুমতি ছাড়াই হাট থেকে ধান কিনে রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী। অধিক মুনাফার আশায় বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির (এসসিএ) অনুমোদন প্রাপ্ত কোম্পানির নকল মোড়কও ব্যবহার করেছে অনেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ে নিবন্ধিত ২০ হাজার বীজ ডিলার রয়েছে। বরিশাল থেকে বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মুসফিকুর রহমান সৌরভ, দিনাজপুর থেকে স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহেদুল ইসলাম রিপন, নাটোর থেকে ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট মামুনুর রশীদ, নওগাঁ থেকে ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট শফিক ছোটনের দেওয়া তথ্য ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের অবৈধ বীজ ব্যবসায়ীর সংখ্যা শতাধিক।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণের অভাবে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী হচ্ছে কৃষকের চোখের জলের কারণ।
বীজ গজানো থেকে শুরু করে পাকা পর্যন্ত নানা রোগে আক্রান্ত হয় ধানগাছ। টুংরো, পাতাপোড়া, ব্লাস্ট, খোলপোড়া ও বাঁকানি ধানের প্রধান রোগ। আর এসব রোগ বেশির ভাগই বীজবাহিত।
জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি-২০১৫’তেও (খসড়া) কৃষি খাতের মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মানসম্মত বীজ ও বালাইনাশক, সুষম সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের যৌক্তিক ব্যবহারে ঘাটতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ন্যস্ত ক্ষমতা বলে বীজ পরিদর্শক বীজ জব্দ করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখলেও, অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে সেসব চেষ্টা। ১৯৭৭ সালে প্রণীত আইনে কিছুটা সংশোধন এনে দ্য সিডস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৯৭-এ করা হয়। তবে কঠিন শাস্তির বিধান না থাকায় আইনের হাত গলে অবৈধ কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বোরো মৌসুমে প্রায় ১৬ লাখ ১৯ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ৮ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর ও রংপুর বিভাগে ৭ লাখ ৬৯ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়। এসব জমিতে বীজের প্রয়োজন হয় প্রায় ৪৮ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন।
এই চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করতে পারে না বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।
নিয়ম রয়েছে বীজ উৎপাদন করতে হলে নেটিং করতে হবে। নেটিং করা না হলে এক ধানের শুক্রানু আরেক ধানে মিলিত হয়ে শংকর জাতের ধান উৎপন্ন হয়। অথচ অসাধু ব্যবসায়ীরা নেটিং ছাড়াই হাট থেকে ধান কিনে তাদের নিজস্ব খামারের ধান বলে বিক্রি করছে।
গ্রেডিং মেশিনের পরিবর্তে খোলা মাঠে ফ্যান দিয়ে ধান শুকিয়ে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ধান মোড়কজাত করা হচ্ছে। মোড়কের গায়ে ট্রুথফুল লেভেল শীট (টিএলএস) লাগানো রয়েছে, এমন চিত্রও উঠে আসে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে।
এসব ক্ষেত্রে কৃষকদের ভালো ধারণা না থাকায় তাদের ছুটতে হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে।
এ মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও, বীজবাহিত নানা রোগে ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভুগতে হচ্ছে কৃষকদের। চলতি বছর এপ্রিল মাস পর্যন্ত নিবিড় রবি ফসল উৎপাদন কর্মসূচির অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বোরো বীজ তলা- হাইব্রিড’র লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ০.৩২০। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অর্জন হয়েছে ০.৪১৩ শতাংশ।
বরিশালে ব্রি ধান-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৪৭, বিনা ধান ১০ কাটা প্রায় শেষ, চলছে আউশ বোনোর প্রস্তুতি। অনেক কৃষকের কপাল পুড়েছে নেকব্লাস্ট রোগ এবং মাজড়া পোকার আক্রমণে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক তুষার সমাদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, নেক ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত রোগ। কৃষকদের ছত্রাক নাশক মেটিভো বা ট্রুপার দুই থেকে তিনবার ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো। যারা দুইবার ব্যবহার করেছেন, তারা ভালো ফলন পেয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ, নাটোর, বগুড়ায় চলনবিল এলাকার জমি মূলত এক ফসলী। বোরো ধানের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত উচু জমিতে আমন ও আউশ ধান চাষ হয়।
এই মৌসুমে জিরাশাইল বা মিনিকিট, খাটো-১০, ব্রি-২৮, ব্রি-২৬ এবং পরীক্ষামূলকভাবে ব্রি-৬৪, ব্রি-৬২, হাইব্রিড হিরা ও বিনা-১৪ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে।
এসব এলাকায় অধিকাংশ জমির ধান কাটা এবং মাড়াই শেষ হয়ে গেলেও কৃষকের মুখ শুকিয়ে দিয়েছে ধানের ব্লাস্ট বা পাতা ঝলসানো, লিকবাইট, সিথ বাইট ও ব্রাউন স্পট রোগ। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় মাজড়া পোকার আক্রমণও দেখা দিয়েছিলো।
কৃষকের সচেতনতার অভাবের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার আমিরুল ইসলাম। কৃষকরা নিজেরাও ভালো ধান থেকে বীজ তৈরি করেন। তবে পদ্ধতিতে অসংগতি থেকে যাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় কৃষক।
‘ফসলের ক্ষতি এড়াতে আগামীতে কৃষকরা যেন মানসম্মত বীজ কেনার ক্ষেত্রে সর্তক থাকে- সে প্রচারণা চালানো হয়েছে। তাদের ব্রি উদ্ভাবিত রোগ ও পোকা সহনশীল জাতের ধান চাষের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
রোগ মুক্তির জন্য ক্যাবরিও টপ (ছত্রাক নাশক), অ্যামিস্টার টপ (কীটনাশক) এবং আক্রান্ত জমিতে সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো। পোকা থেকে ফসল রক্ষায় জমিতে গাছের ডাল পুঁতে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো যেনো পাখি পোকা খেয়ে ফেলতে পারে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, জেলার সব জায়গায় বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। দু’এক জায়গায় পোকার আক্রমণ দেখা দিলেও সার্বিক উৎপাদনে প্রভাব পড়েনি।
দিনাজপুর-রংপুর এলাকায় ধানের ক্ষতি করেছে মাজরা পোকা, কারেন্ট পোকা, গান্ধী পোকা।
প্রতিকার হিসেবে দানা এবং তরল বিষ ব্যবহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কৃষকদের, জানালেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা।
জামালপুর জেলার মেলান্দহে চলতি বোর মৌসুমে বিআর-৫৮ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ মহামারি আকারে বিস্তার করেছে। মাহমুদপুর ইউনিয়নের আগপয়লা এলাকার প্রায় ১০ থেকে ১৫ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে এ রোগে।
বিআর-৫৮ জাতের ধান চিকন এবং ফলন বেশি হয়। ধান কাটাও যায় আগে। এ কারণে বিআর-৫৮ চাষে বেশি আকৃষ্ট হন কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে এ মৌসুমে ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৩শ’ হেক্টর জমিতে বিআর-৫৮ রোপণ করা হয়েছে। গত বছর থেকে বিআর-৫৮ জাতের ধান চাষ শুরু হয়। তবে গত বছরও কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
আগপয়লা গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) জানান, ধান গাছ খুবই সুন্দর হয়েছে। কিন্তু পাতায় মরে গেছে এবং শীষে ধান নেই। যে ধান হয়েছে সেগুলো চিটা। কৃষি অধিদফতরের পরামর্শে প্রয়োজনীয় সার-কীটনাশক প্রয়োগ করেও শেষ রক্ষা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মেলান্দহ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মাহফুজুর রহমান জানান, ধান গাছের ব্লাস্ট রোগ আগে থেকে জানা সম্ভব হয় না। রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পাতা ও ধানের ডগার গোড়ায় খয়েরি রঙের মালার মতো হয়ে গাছের খাদ্য নালী বন্ধ করে দেয়।
পরিমাণের তুলনায় ইউরিয়া, জিপসাম বেশি প্রয়োগ হলেও এ রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়াও বীজ কীট মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে এ রোগ হতে পারে। কৃষকের অসচেতনা এর জন্য দায়ী।
সবচেয়ে বড় কথা হলো বীজ বিক্রেতা আমাদের অনুমোদিত ডিলার নন। বিএডিসি এর দায় নেবে না। এ বীজ সরবরাহ করেছে মধুপুরের মেসার্স মনিরা ট্রেডার্স।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মধুপুরের মেসার্স মনিরা ট্রেডার্সের মালিক মতিয়র রহমান। তিনি বলেন, ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকে না।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্লাস্ট রোধে সিলিয়া, জিল, টুপার, নাটিবো (ছত্রাক প্রতিরোধক) এবং ধানের ফুলঝরা বন্ধে হেপ্টোকোনাজল, ইমিস্টার, বাবিস্টন, নুইন, নিমকোজেড জাতীয় ওষুধ স্প্রে করে সুফল পাওয়ার কথা।
এছাড়া প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবও।
দেশের ৬টি ভৌগলিক অঞ্চল অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলের স্থায়ী খরাপ্রবণ এলাকা, ক্রমবর্ধমান ও ভয়াবহ বন্যাপ্রবণ মধ্যাঞ্চল, আকস্মিক বন্যাপ্রবণ উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য দক্ষিণের লবণাক্ত অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রামের অনিশ্চিত ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত অঞ্চল এবং ঘুর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ অঞ্চলগুলো দেশের মোট এলাকার প্রায় ৪১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে।
বীজ পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মহাপরিচালক-বীজ) মো. ফজলে ওয়াহেদ খোন্দকার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক অভিযোগ জানালে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ম্যানডেড বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি (এসসিএ)। বীজ উইংয়ে লোকবল হয়তো কম আছে, কিন্তু যাই আছে তাতে অভিযোগ পাওয়া মাত্র ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।
বাংলাদেশ সময়: ০১২৫ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৬
এটি