জানা যায়, আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে জমি ফাঁকা ফেলে না রেখে আউশ ধানের চাষ করে থাকেন কৃষকরা। বীজ বপনের মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ধান ঘরে তোলা যায়।
সেই আউশ ধানে কৃষকদের উৎসাহ বাড়াতে প্রণোদনা হিসেবে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় ছয় হাজার ৭৭৬ জন চাষিকে জনপ্রতি পাঁচ কেজি বীজ ও ২৫ কেজি সার বিনামূল্যে বিতরণ করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু বাস্তবে কোনো চাষি এ বছর আউশ ধানের চাষ করেননি। ফলে বোরো ধান ঘরে তোলার পর থেকে মাঠ ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
প্রণোদনার তালিকায়ও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি
যাদের জমি নেই বা যারা কখনই চাষাবাদ করেন না, এমন লোকদের আউশের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ প্রকৃত চাষিদের। তালিকায় একই পরিবারের একাধিক সদস্যদের নামে উত্তোলন করে এসব বীজ ও সার কালো বাজারে বিক্রি করা হয়েছে বলেও কৃষকদের অভিযোগ। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা কৃষি অফিসের দালালদের নাম রয়েছে এ প্রণোদনায়। চাষিদের অভিযোগ, তারা এসব বীজ-সার উত্তোলন করে বাজারে বিক্রি করেছেন। কেউ আউশের বীজ নিয়ে চিড়া তৈরি করে খেয়েছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্যরা নিজের পরিবারের সব সদস্যের নামে উত্তোলন করেছেন এ প্রণোদনা।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) আব্দুল হামিজের পরিবারে চার সদস্যের নামে আউশের প্রণোদনা থাকলেও বাস্তবে চাষাবাদ করেননি তিনি।
মহিষখোচা গ্রামে আনছার আলী, বিশ্বনাথ, দিনেশ, জামেনী ও খগেন্দ্র জানান, তারা সবাই আউশের প্রণোদনা পেয়েছেন। কিন্তু কেউ আউশ চাষ করেননি। কারণ জানতে চাইলে তারা বাংলানিউজকে বলেন, আউশের ফলন কম হয়। প্রণোদনার বীজ রেখে দিলেও সার তামাক ক্ষেতে প্রয়োগ করেছেন। এলাকায় কেউ আউশ চাষ করে না। তাই তারাও চাষাবাদ করেননি বলে দাবি করেন।
ওই ইউনিয়নের চাষি তাহাজুল ইসলামের ছেলে মামুদ বাংলানিউজকে জানান, আউশের প্রণোদনার জন্য উপ-সহকারী কৃষি অফিসারের কাছে অনেকবার গিয়েছেন। কিন্তু চাষ করার জন্য আউশের বীজ পাননি। যারা ভাগ দেন তাদের নামে এসব প্রণোদনা দেওয়া হয়। ভাগ দিতে পারেননি বলেই তিনি প্রণোদনা পাননি।
প্রণোদনা নেওয়া ব্যক্তিদের কাছে আউশের ক্ষেত দেখতে চাইলে দুর্নীতির বাস্তব চিত্র বেরিয়ে আসবে বলেও দাবি করেন তিনি।
সারপুকুরের চাষি হযরত আলী বাংলানিউজকে বলেন, প্রণোদনার তালিকা নিয়ে ওই সব চাষিদের কাছে গেলেই তথ্য বেরিয়ে আসবে। এছাড়া জেলার মাঠগুলোর দিকে তাকালেও তো দেখা যাবে কি পরিমাণ আউশ চাষ হয়েছে। এতো বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা নিয়েও মাঠে আউশের ক্ষেত দেখা যায় না। প্রকৃত চাষিদের প্রণোদনা দিলে তারা অবশ্যই চাষাবাদ করতেন।
অভিযোগ রয়েছে ইউপি সদস্য ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা পরিচিতজনদের মাঝে এসব প্রণোদনা ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছেন। তাই কৃষি বিভাগের খাতায় আউশের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক চাষাবাদ দেখানো হলেও বাস্তবে তা শূন্য— ‘যেন কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত মার্চের শেষ দিকে জেলার ছয় হাজার ৭৭৬ জন চাষিকে আউশের প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হয়। এ বছর আউশের লক্ষ্যমাত্রা ১১ হাজার হেক্টর নির্ধারণ হলেও চাষ হয়েছে ১১ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে।
কিন্তু কৃষি বিভাগের মনগড়া এ তথ্য মানতে নারাজ চাষিরা। চাষিদের মতে গোটা জেলা মিলে ৫০ হেক্টর জমিতেও আউশের চাষ হয়নি।
আদিতমারী উপজেলা কৃষি অফিসার আলীনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, তামাক চাষিদের এ প্রণোদনা দেওয়া হয়। কারণ তামাক তুলে চাষিরা আউশ ধান লাগান। তবে এ বছর চাষাবাদ কম হলেও জেলার বাকি ৪ উপজেলার তুলনায় আদিতমারীতে বেশি হয়েছে।
তবে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত না করে উল্টো সেই তামাক চাষিকেই কেনো প্রণোদনা দিলেন- এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিধু ভূষণ রায় বাংলানিউজকে বলেন, আউশের প্রণোদনার সার তামাক ক্ষেতে ব্যবহার হয়নি। চাষিরা ধান বা অন্যান্য ফসলে ব্যবহার করেছেন। প্রণোদনার তালিকায় কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৯
জিপি