ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভোজনরসিকদের মন কাড়বে বাহারি রুশ খাবার

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২৩
ভোজনরসিকদের মন কাড়বে বাহারি রুশ খাবার

রাশিয়া থেকে ফিরে: খাদ্যপ্রীতি চিরকালই বাঙালির ঐতিহ্যের একটি অংশ। আরও সোজা করে বললে, বাঙালি চিরকালই ভোজনরসিক।

আর ভোজনরসিক কথাটা চোখ বন্ধ করে ভাবতে গেলেই যেসব খাবার ভেসে ওঠে; পোলাও, মাংস, মাছ, ঘি, দুধ, ছানা, বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার তার মধ্যে অন্যতম। মস্কোতে কাটানো দিনগুলোতে এসব খাবার মিস করেছি বেশ। অন্তত যখন কয়েকদিন একটানা সকাল-দুপুর-রাতে নিত্যপরিচিত খাবারের পরিবর্তে খেতে হয়েছে নতুন ভিন্ন স্বাদের খাবার।

রাশিয়ার খাবার তার বৈচিত্র্য এবং স্বাদের জন্য পরিচিত। তাই এই কয়েকটা দিন এসব নতুন খাবারের স্বাদ অন্বেষণেই মনোস্থির করলাম। কেননা রাশিয়ার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। এই দীর্ঘ ইতিহাসে রুশ সংস্কৃতি বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। আর এই মিথস্ক্রিয়া রাশিয়ার খাদ্য সংস্কৃতিতেও এনেছে বৈচিত্র্য।

সত্যিই তাই, রাশিয়ার মতো বিশাল এবং বহুজাতির দেশে এসে উপলব্ধি করলাম, এদের নির্দিষ্ট কোনো জাতীয় খাবার নেই। তবে আছে ভিন্ন ভিন্ন জাতির মজার সব খাবার। তবে উত্তর-পূর্ব ইউরোপীয়, ককেশিয়ান, মধ্য এশিয়া, সাইবেরিয়ান এবং পূর্ব এশিয়ার প্রভাবে রাশিয়ার খাবারে আছে বৈচিত্র্য। বহু জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বিস্তৃত অঞ্চল থেকে খাবারে এসেছে ভিন্নতা। বৈরী আবহাওয়া এবং কঠোর পরিবেশগত কারণে মৌসুমি ফসলের ওপর কৃষকের খাবার নির্ভর করতো। ফলে গ্রামীণ জনগণ, পরিবেশের সাথে খাবারের একরকমের সংযোগ ঘটিয়েছিল। তাদের খাদ্য তালিকায় মূলত বিভিন্ন শস্য, মাছ ও গৃহপালিত পশুর মাংস এবং নিজেদের তৈরি বিয়ার ও ভোদকার সরবরাহ।

বিংশ শতাব্দীতে এই জাতীয় খাবার খুব প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৬ থেকে ১৮ শতকের দিকে খাবার রান্নার কৌশলে এসেছিল ভিন্নতা। মাছ মাংসে স্মোক পদ্ধতি, সালাদ, চকলেট, আইসক্রিম, ওয়াইন এসব বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। শহুরে আভিজাত্যের সৃজনশীল এই ইউরোপীয় খাদ্যগুলো রাশিয়ান ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে নতুন দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। আর গ্রামীণ সমাজে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচলন এখনও বিদ্যমান। সেই সঙ্গে মস্কোর ব্যস্ত শহুরে নাগরিকের মাঝে ইউরোপীয় খাবারের উপস্থিতি থাকলেও, এখানেও আছে রুশদের নানা জাতির নানারকম খাবারের সমাহার।

আরও পড়ুন: ** ভিক্টরি মিউজিয়াম: রুশদের লড়াই ও গৌরবের প্রতীক

কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় যা পেলাম, প্রথমত রুশরা খাবার নিয়ে খুব বেশি ঝুট ঝামেলা পছন্দ করে না। তারা সাধারণত সহজ ও সরল খাবার পছন্দ করে। দ্বিতীয়ত, এরা খাবার তালিকায় সবজি ও স্যুপের মাত্রাটা একটু বেশিই রাখে। আর বাঙালির ভরপেট খাওয়ার বিপরীতে এরা ভীষণভাবে অভ্যস্ত পরিমিত খাবার গ্রহণে। এমনকি শুধু আলু খেয়ে এরা দিব্যি পুরো দিন কাটিয়ে দেয়।

আমরা বাঙালিরা রান্না সুস্বাদু করার কিংবা রান্না নিয়ে যত সময় খরচ করি তার চার ভাগের এক ভাগ সময় রুশরা খরচ করে রান্নাতে। রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার শেষে এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই জানলাম এসব তথ্য। একটি কড়াইতে সামান্য তেল বা ইচ্ছে না হলে তেল ছাড়াই বেশ কিছু আলু কেটে লবণ (ইচ্ছে হলে) ছিটিয়ে ঢাকনা দিয়ে চুলোয় বসিয়ে দেয়। সেদ্ধ হলে নামিয়ে নেয়। এটিই ডিনার। অবশ্য এটা খেতেও বেশ মজাদার। খেয়াল করেছি, অধিকাংশ রুশকেই এই খাবার ডিনার হিসেবে খেতে।

আরও পড়ুন: ** ইতিহাস কথা বলে মস্কোর শরীরজুড়ে

রুশদের প্রিয় খাবারের মধ্যে স্যুপ অন্যতম। রুশরা স্যুপকে ‘বুলিয়ন’ বলে। বুলিয়ন তৈরি করতে, একটি কড়াইতে পানি গরম করে তাতে একটি মুরগি দিয়ে সেদ্ধ করা হয়। মুরগি সেদ্ধ হয়ে গেলে, মুরগিটি উঠিয়ে ফেলা হয় এবং বাকি জ্বাল দেওয়া পানিটাই বুলিয়ন। বলে রাখি, এই স্যুপে কিন্তু লবণ দিতে হয় না। যদিও খাইনি, তবে হোটেলের কয়েকজনের কাছ থেকে এই স্যুপের ভীষণ সুনাম শুনেছি। এছাড়াও কাশা, গ্রেজকা, পেলমেনি, তেল ছাড়া চিকেনও এখানকার মানুষের বেশ প্রিয়।

আমাদের দ্বিতীয় দিনের খাবারে যে খাবারটা খেয়ে সবচেয়ে বেশি শান্তি পেয়েছিলাম, সেটি হলো রুশদের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিজ (Porridge)। রুশ ভাষায় একে বলে ‘কাশা’ (Kasha)। এটি শুধু গ্রামীণ নয়, শহুরে মানুষেরও খুব প্রিয় খাবার। কম সময়ে কাশা তৈরি করা যায় বলেই ব্যস্ত রুশবাসীর প্রিয় খাবার কি না জানি না। তবে পুষ্টিকর তো অবশ্যই। আর সাথে গম, রাই, যবসহ নানা রকম ফসলের সংমিশ্রনে কাশা তৈরি হয় বলে খেতে ভাতের মতো একটা স্বস্তি পাওয়া যায়। সাথে মেশানো থাকে নানারকম শুকনো ফলের গুঁড়ো। গরম দুধে মিশিয়ে খানিক জ্বাল দিলেই কাশা তৈরি। আর কাশা পরিবারে ওটস, বার্লি, জাউ ভাত, সুজি আছে। যাদের তৈরি করতে হয় একই নিয়মে আর মূল উপাদান হচ্ছে দুধ। আর সময় স্বল্পতা অধিক পুষ্টির কারণে রুশ শিক্ষার্থীদের কাছে কাশা জনপ্রিয় খাদ্য।

এছাড়া রুশদের অন্যান্য জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে ‘গ্রেজকা’। এই গ্রেজকা হলো একটি রুটি-ভিত্তিক খাবার। এটি সাধারণত রুটি ভেজে তৈরি করা হয়। গ্রেজকা সাধারণত মাখন বা বেকন দিয়ে পরিবেশন করা হয়। আরও রয়েছে ‘পেলমেনি’। পেলমেনি হলো একটি মাংসের পাস্তা। এটি সাধারণত গরম পানিতে সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। পেলমেনি সাধারণত সস বা মাখন দিয়ে পরিবেশন করা হয়। রুশরা তেল ছাড়া চিকেন খেতে পছন্দ করে। তারা চিকেনকে সাধারণত গ্রিল করে বা সেদ্ধ করে খায়। আর এখানে চিকেন সাধারণত সবজি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

আরও পড়ুন: ** ১৮০ রুবলের দেনা মাথায় নিয়ে শুরু মস্কোয় পথচলা!

বাঙালি খাবারে তেল এবং ঘিয়ের যেমনটা আধিক্য, ঠিক তার উল্টো রুশ খাবারে। রুশদের খাবার মেন্যুতে সালাদ একটি আবশ্যকীয় উপাদান। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে অলিভিয়ে (Olivier) সালাদ। সিদ্ধ আলু, গাজর, মটর, ডিম, সেদ্ধ মুরগি, আপেল, পেঁয়াজ, লবণ, গোলমরিচ দিয়ে মেয়নিজ মিশ্রনে এই সালাদ খুবই জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু। এছাড়া শীতের দেশ রাশিয়ায় ঠান্ডা সহিষ্ণূ সবজি বাঁধাকপি, আলু শসা, টমেটো অন্যতম খাবার। এরা টমেটো, অলিভ, শসা, নানারকম মৌসুমি ফল ভিনেগারে ভিজিয়ে জারে সংরক্ষণ করে সারা বছর। রাশিয়ায় আলুর ফলন বেশি তাই আলু দিয়ে নানারকম খাবারেরও আধিক্য দেখা যায়। রুশ ভাষায় একে বলে ‘কার্তোফেল’।

যে কয়েকদিন রাশিয়ায় থেকেছি, সবচেয়ে মিস করেছি বাঙালির মশলাদার খাবার। রুশরা ঝাল একদমই খায় না বললে চলে। তাই তাদের খাবারে নেই ঝালের কিংবা মশলার ছিটেফোঁটা। লবণ কিংবা প্রক্রিয়াজাত শুকনো কারি পাতার গুঁড়ো দিয়ে মাংস কিংবা ডিম ভেজে খায়। বরং মিষ্টি জাতীয় খাবার রুশদের ভীষণ প্রিয়। তাই নানারকম ‘তর্ত’ অর্থাৎ পিঠা, পেস্ট্রি আর চকোলেট তাদের নিত্যসঙ্গী। রুশ পরিবারে কিংবা আড্ডায় বিকেল বেলা চায়ের সাথে এই তিন আইটেম থাকবেই বলে জানিয়েছিলের হোটেলের এক কর্মী।

কয়েক দিনের এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় যতটা জেনেছি এবং বুঝেছি, রুশদের খাদ্যাভ্যাস তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এরা মিনারেল ওয়াটারের তুলনায় জুস পান করে বেশি। তবে রুশ খাবার তার সহজতা, পুষ্টিগুণ এবং ঐতিহ্যের জন্যই হৃদয়ে জায়গা করে নেবে যেকোনো ভোজনরসিকের।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৩
এইচএমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।