ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

দৃকে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘বুক পেতেছি গুলি কর’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪
দৃকে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘বুক পেতেছি গুলি কর’

ঢাকা: দৃকের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর দৃকপাঠ ভবনে শুরু হয়েছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘বুক পেতেছি গুলি কর’। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিভিন্ন আলোকচিত্র নিয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।

শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনে এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার ও আহত শিক্ষার্থীরা। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বামী-সন্তান হারানোর বেদনা ও সে সময়ের নির্মমতার ঘটনা তুলে ধরেন নিহতদের স্বজন ও আহতরা। পাশাপাশি এসব অপকর্মে জড়িতদের বিচার দাবি করেন তারা।

আন্দোলনে ধানমন্ডিতে গুলিতে নিহত রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজের খালা ফারজানা মুনমুন বলেন, কীভাবে কেউ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী এতটুকু বাচ্চাদের বুকে গুলি করতে পারে। কারও না কারও নির্দেশেই তো এটা হয়েছে। এভাবে ছোট ছোট বাচ্চাদের ওপর হামলা করা হলো। আমাদের আর হারানোর কিছু নেই। আমরা তো সব হারিয়েই ফেললাম। আমরা হয়তো এইজন্যই বেঁচে আছি, এর বিচার যেন আমরা দেখে যেতে পারি। আমাদের শহীদ পরিবারের একটাই আশা, আমাদের যেন আমরা হাজারো নিরস্ত্র ছাত্র ও সাধারণ মানুষের হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের ছররা গুলিতে ডান চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টি হারিয়েছেন শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মুহাম্মদ এমদাদ। তিনি তার দুঃসহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, আমাকে পুলিশ ইচ্ছা করে গুলি করছে। ৫-৬ ফিট দূর থেকে সাউন্ড গ্রেনেড মেরেছে, ছররা গুলি করেছে। আমরা একটা চোখে গুলি লেগেছে। তারা চাইলেই পায়ে গুলি করতে পারতো, কিন্তু তারা মাথায় গুলি করেছে।

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বিষয়ে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমার চোখে গুলি লাগে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। অথচ আমার ট্রিটমেন্ট শুরু হয় পরদিন সকাল ১০টা-সাড়ে ১০টায়। এর আগে কিছুই করা হয়নি। আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছি, চোখে ভয়ংকর যন্ত্রণা। সেই অবস্থা এখনো আছে। শেখ হাসিনাও তো বলেছিল, সবার চিকিৎসা করে দেবে। আমাদের বিপ্লবী সরকারও বলেছে, সবার চিকিৎসা হবে। সেটা কি এখনো হয়েছে? আমাদের দেশে ভাইরাল না হলে তার কোনো খোঁজ-খবর নেওয়া হয় না। আমি ভাইরাল হয়েছি বলে আমাকে দেখতে আসছে। যে ভাইরাল হয়েছে, তাকে নিয়ে থাকবো। আর যে ভাইরাল হয়নি, তাকে দেখবোও না, খোঁজও নেবো না। এই জিনিসটা থেকে মুক্তি চাই। এই বৈষম্য আমি অন্তত হতে দেব না।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের ছররা গুলিতে মারা যান একটি সাংবাদিক হাসান মেহেদী। অনুষ্ঠানে স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি। এ সময় দর্শকদের অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

ফারহানা ইসলাম পপি বলেন, আমি শুধু ওপরওয়ালাকে একটিই বিচার দেই, আমার সন্তানকে যে এতিম করছে, বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করছে আল্লাহ তাদের শাস্তি তুমি নিজে হাতে দিও। আমার স্বামীর হত্যার বিচার আল্লাহ ঠিকই করবেন। আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমার মেয়ে দুইটার কোনো ব্যবস্থা করতে পারলে আর বাঁচতে চাই না। আমার সংসার করার খুব ইচ্ছা ছিল। আমি ওপারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে চাই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী শাহিনুর সুমি বলেন, গত ১৫ বছরের যে ক্ষোভ এটা শুধু ছাত্রদের নয়, দেশের আপামর জনতার। যার কারণে এই গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। আমরা ছাত্ররা একা কখনোই এই আন্দোলন করতে পারতাম না। তাই জনগণের অংশগ্রহণে যে নতুন সূর্যোদয় হয়েছে, সেখানে বৈষম্যের স্থান নেই। আমরা আমাদের কথা বলার অধিকার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার পেয়েছি। যে পথটা ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের শহীদরা দেখিয়ে গেলেন, সেই পথটাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে হবে। বৈষম্য দূর করে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকবো।

অনুষ্ঠানে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের নিহত শিক্ষার্থী জুলফিকার আহমেদ শাকিলের মা বিবি আয়েশা উপস্থিত ছিলেন। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ায় কোনো কথা বলতে পারেননি। তার পরিবর্তে কথা বলেন শাকিলের বন্ধু ইয়াসিন। তিনি বলেন, শাকিল প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করতো, তার কবিতায় প্রাণ-প্রকৃতি থাকতো। শাকিল রাজনৈতিক কর্মী ছিল, শাকিল আসলে অনেক কিছু ছিল। শাকিলকে আমরা কেউ ধরতে পারিনি। মানুষ কতটা সমৃদ্ধশালী চিন্তা করলে নিজের ভবিষ্যৎ নিজে লিখে যেতে পারে। পাঠশালার প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বপ্ন তারা শাকিল হতে চায়। আমারও স্বপ্ন আমি শাকিল হতে চাই।

সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলমসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধন শেষে অতিথিরা দৃকপাঠ ভবনের দ্বিতীয় তলায় আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২৪
এসসি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।