ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সমাজ সংস্কারক সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ | ড. ফজলুল হক সৈকত

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৫
সমাজ সংস্কারক সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ | ড. ফজলুল হক সৈকত

রাজনীতি, সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের প্রতি অপার নিষ্ঠা আর সমাজ-গঠন ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান সংগ্রামে নিবেদিত এক প্রাণ সাধক আবুল মনসুর আহমদ (জন্ম: ৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮ ধানিখোলা, ময়মনসিংহ; মৃত্যু: ১৮ মার্চ ১৯৭৯ ঢাকা)। কখনও রাজনীতির মধ্যে ও সরকারের মন্ত্রিসভায়, কখনও সংবাদপত্র সম্পাদনায় বা কলামে, কখনও সাহিত্যে, কখনও বা আইনজীবী হিসেবে নিজের নামের মহিমা প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করেছেন এই মনীষী।

১৯৩০-৩৮ সময়কালে ময়মনসিংহ জজকোর্ট ও কলকাতার আলীপুর জজকোর্টে আইনপেশায় নিয়োজিত থাকার সময়টুকু বাদ দিলে ১৯২০ থেকে প্রায় আমৃত্যু ৬ দশককাল তিনি চিন্তা-মনন ও কর্মে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিশারদ এবং সাহিত্যিক আলেক্সন্দর সল্জনিৎসিন, যিনি নৈতিকশক্তি আর প্রাতিস্বিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে বন্দিশিবির থেকেও শিল্পের গোলাপ ফুটিয়েছেন, ১৯৭০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গ্রহণকালে বক্তৃতায় বলেছিলেন:
‘আদিম মানুষের মত কেউ একজন, এক অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণীকে—সে এক অদ্ভুত হয়ত বালির মধ্যে লুকিয়ে ছিল, অথবা এমন কিছু যা হঠাৎ করেই আকাশ থেকে পড়েছে—বেশ অদম্য আর বক্র, আবার বোধহীনের মত চকচকে, ভেতর থেকে উজ্জ্বল প্রভা বেরিয়ে আসছে, একেক সময় একেক রূপ নিচ্ছে, মনে হচ্ছে, যেন  একে যে-কোনও রূপেই ব্যবহার করা যাবে, হাতের মুঠোয় নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওঠে... সে রকমই শিল্পকে আমরা আমাদের হাতের মুষ্ঠিতে ধরে রেখেছি, আত্মপ্রত্যয়ীর মত মনে করি—এ আমাদের নিজস্ব সম্পদ, এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ন্ত্রণ করি, একে নতুনত্ব দিই, পুনর্নির্মাণ করি, এর ফতোয়া দিই, টাকার জন্য বিক্রি করি, একে নিয়ে প্রভাবশালীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করি এবং বিনোদনের সামগ্রীতে পরিণত করি বিভিন্ন সঙ্গীতের আসরে আর রাতের ক্লাবগুলোতে এবং এক সময় এটি গতিনিরোধক কিংবা লাঠিতে পরিণত হয়, দিক-পরিবর্তনের রাজনীতির অথবা ক্ষীণ সামাজিক প্রয়োজনে। ’ (মামুদ, ২০০৮, ৫৩)

আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতিলগ্নতা এবং সাংবাদিক ও সাহিত্যিক দায়বোধের বিবেচনায় এই কথাগুলো বিশেষভাবে স্মরণ করার প্রয়োজন পড়ে। মধ্যবিত্ত কৃষক-পরিবারের সন্তান আবুল মনসুর আহমদকে জীবনের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে নানান প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে। তাঁর কর্ম-পরিসরের পুরোটি ভুবন জুড়ে সমানতালে চলেছে রাজনীতি-সাধনা ও সাহিত্যচর্চা। তিনি তাঁর প্রতিবেশকে ধারণ করেছেন প্রজ্ঞা আর আশাবাদের প্রবল তাড়নায়। সমাজচিন্তক মনসুর ছিলেন সোসিও-পলিটিক্যাল রাইটার। সাধারণ মানুষের বোধের ভুবনে আলোড়ন তুলতে চেয়েছিলেন এই দার্শনিক। কখনও কখনও তিনি আবেগতাড়িত হয়েছেন, হয়েছেন নিজের ধর্ম ও জাতির প্রতি পক্ষপাতি। কিন্তু সর্বোপরি তাঁর লক্ষ্য ছিল শান্তি, উদার-নৈতিকতা ও মানবতাবাদ। আর সাধনার সমস্ত প্রহর জুড়ে তিনি নির্ভর করেছেন আত্ম-অনুভব আর আত্ম-বিশ্বাসের ওপর। আর সে কারণেই, সত্য-সুন্দর আর কল্যাণের পথে প্রসারিত তাঁর রাজনৈতিক মনীষা এবং সাহিত্যিক অভিলক্ষ্য। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অর্জনের দিক থেকে অবশ্যই কীর্তিমান মানুষ আবুল মনসুর আহমদ। তিনি সময়ের এক নিরন্তর যাত্রী। যেন একটা দূরগামি ট্রেন সময়ের বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে স্টেশন থেকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে অবশেষে নামিয়ে দিয়েছে এক জংশনে। পথ পেরোনোর সময় এত মুখ এত ছবি দেখেছেন তিনি—তার সবগুলো সামাজিক-রাজনৈতিক অভিজ্ঞানকে আশ্রয় করে হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যের উপাদান। কোনও আত্মপ্রচার বা কীর্তিগাথা নয়, মনসুর এঁকেছেন স্রেফ জীবনের ছবি। জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি পরিচিত ভুবন থেকে আর জীবন-জিজ্ঞাসা থেকে সংগ্রহ করেছেন সারি সারি খণ্ডচিত্র। চিত্রগুলো হয়ত ক্ষুদ্র, আঁচড়গুলো মিহি, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক অপূর্ব কাহিনি-ছবি। আবুল মনসুর আহমদের কাছে শেষপর্যন্ত অনুভবঘন-জীবনযাপনই জীবনের বৃহত্তর মহত্তর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবুল মনসুর ‘ধর্মীয় কড়াকড়ি’র পারিবারিক ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে শৈশব-কৈশোর পার করেছেন। ‘ফরাযী’ পরিবারের ছেলে আহমদ আলী ফরাযী পরবর্তীকালে আবুল মনসুর আহমদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর চাচা মুনশী ছমিরুদ্দিন ফরাযীর মক্তবে শিক্ষায় হাতেখড়ি। বাড়ির বৈঠকখানায় বসত এই ফ্রি মাদ্রাসা। কায়দা-আমসেপারা-কোরআন এবং বর্ণ ও বানান শিক্ষা ছিল তাঁর প্রাথমিক পাঠের তালিকায়। ১৫ বছর বয়সে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে দরিরামপুর মাইনর স্কুলের শিক্ষক কৈলাস বাবুর প্রেরণায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন আবুল মনসুর আহমদ। ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজে দর্শনশাস্ত্রে অনার্স পড়ার সময়ে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। তৎকালীন খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। ওই বছরেই যোগ দেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টিতে। পরবর্তীকালে ১৯২৯ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে অর্জন করেন এলএলবি ডিগ্রি।

১৯২৩ সালে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিশেবে মনসুরের সাংবাদিক-জীবনের আরম্ভ। তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজে সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত। সমকালে কাজী নজরুল ইসলাম অবশ্য সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে প্রবল প্রভাবের সাথে বিচরণ করেছেন। আবুল মনসুরের খানিকটা বিশেষত্ব হলো সমকালে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান তরুণসমাজকে সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশে অনুপ্রেরণা প্রদান। অবশ্য তিনি মনে-প্রাণে সাহিত্যিকই হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মওলানা আকরম খাঁ-র সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’, মৌলবী মজিবর রহমানের ‘দি মুসলমান’, ‘দৈনিক কৃষক’, এ কে ফজলুল হকের ‘নবযুগ’, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন এবং অসীম নিষ্ঠার পরিচয়ের কারণে সাংবাদিক ও সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন। তৎকালীন সময়ে সংবাদপত্র ছিল রাজনীতির প্রচারমাধ্যম বা মুখপত্র। সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে সমাজ-রূপান্তরের কারিগরেরা ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বাঙালির চিন্তা ও স্বাধীনতার চেতনাকে নানানভাবে প্রচার করেছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি, দাবি ও ভাষা, অভিলক্ষ্য ও আদর্শ প্রচারে যে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল সংবাদপত্রসমূহ তাঁর পেছনে নজরুল-মনসুরদের অবদান অসামান্য। তখন যেন সাংবাদিকতা ও রাজনীতি ছিল একই সুতোয় বা শেকলে বাঁধা! মনসুর ছিলেন পেশাদার সাংবাদিক। স্বরাজ-প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্ব স্থাপনে তাঁর চিন্তা ছিল অগ্রগামী।

১৯২০ সালে রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করা তরুণ আবুল মনসুর আহমদ পরবর্তীকালে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন পার করেছেন। ১৯৩০ সালে ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’র ময়মনসিংহের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সাল থেকে পাকিস্তান-আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির অন্যতম কর্ণধার, মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা-নেতা। ১৯৪৬-এ মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৩-১৯৫৮ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ২১ দফার অন্যতম প্রণেতাও তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়ে প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৫৬-৫৭ সময়কালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা—সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের অবদান কালের পরিক্রমায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। চিন্তা ও বক্তব্য প্রকাশে তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ-সাহসী। ‘আবহমানকালের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বদলে পূর্ব বাংলায় ধর্মভিত্তিক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রস্তাব উত্থাপন’ (চরিতাভিধান, ১৯৯৭, ৫৯) করেন তিনি। ‘১৯৬৭ সালে রবীন্দ্র সঙ্গীত পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থি এই বক্তব্য উপস্থাপন করে পাকিস্তান সরকার রেডিও টেলিভিশন থেকে প্রচার না করার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ’ (হাজার বছরের সেরা বাঙালি, ২০০০, ১৪৭-৪৮) তৎকালীন সময়ে পরিচিত আওয়াজ ‘পাক-বাংলার কালচার’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে তিনি ছিলেন নিবেদিত-প্রাণ কর্মী। অবশ্য রাজনৈতিক সংস্কার, গণতন্ত্রের বিকাশ ও চর্চায় চিন্তার প্রাগ্রসরতা, জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রচারে তাঁর ভাবনা-পরিসর বেশ উজ্জ্বল। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ববাংলার (তথা পূর্ব-পাকিস্তানের) স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোসহীন নেতা। ভারতের স্বাধীনতা-অর্জনের পথে রাজনৈতিক বিচিত্র উত্থান-পতনের দিকে তাঁর সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সবসময়। এবং ১৯৪০ সালে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রভূমির আন্দোলন—পাকিস্তান আন্দোলনকে তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন। (সূত্র: বাংলাপিডিয়া) সমকালীন রাজনীতি-বিষয়ে তাঁর ধারণা ও দূরদর্শিতা সত্যিই বিস্ময়কর।

রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের আত্মজৈবনিক রচনা আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৮) আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক বিরাট দলিল। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, আইন-ব্যবসা—প্রভৃতি বিচিত্র পেশার নানান অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটেছে এখানে। বাস্তব-অভিজ্ঞতার আলোয় তিনি সাজিয়েছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটি একটি অবশ্য-পাঠ্য গ্রন্থ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রজা-আন্দোলন, খিলাফত ও অসহযোগ-আন্দোলনসহ নানাবিধ আন্দোলন-সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকচেতনা, অবিভক্ত ভারত ও পাকিস্তানে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্থার ক্রম-জনপ্রিয়তা, সভা-সমিতি, নিখিল ভারতের নির্বাচন, পাকিস্তান-আন্দোলন, দেশভাগ, ভাষা-আন্দোলন, পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শিক্ষা-সংকট, বাণিজ্য-বিস্তার, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের অবিচার, স্বাধীকারের চেতনা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচন, শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং ভ্রান্তি, পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান-প্রসঙ্গ—বিরাট-ব্যাপক ক্যানভান এঁকেছেন লেখক-শিল্পী এই গ্রন্থে। গ্রন্থটি সাধু ভাষারীতিতে রচিত। এই সুবৃহৎ বইটির ‘দুসরা অধ্যায়’-এর ‘ধর্ম-চেতনা বনাম রাজনীতি-চেতনা’-অংশ থেকে খানিকটা পাঠ গ্রহণ করছি:
‘শিক্ষকদের প্রভাব ছাত্রদের উপর অবশ্যই পড়িয়া থাকে। এক আরবী-ফারসী শিক্ষক ছাড়া আমাদের স্কুলের পঁয়ত্রিশ জন শিক্ষকের সবাই হিন্দু। এঁরা প্রকাশ্য রাজনীতি না করিলেও কথা-বার্তায় ও চালে-চলনে স্বদেশী ছিলেন। এঁদের দুই-তিনজনকে আমি খুবই ভক্তি করিতাম। এঁদের প্রভাব আমার মনের উপর ছিল অসামান্য। হঠাৎ একদিন একদল পুলিশ স্কুলে আসিয়া কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করিয়া নিল। এদের মধ্যে দুই-চারজন আমার সুপরিচিত। তাদের জন্য খুবই চিন্তিত ও দুঃখিত হইলাম। গ্রেফতারের কারণ খুঁজিলাম। “রাজবন্দী”, “অন্তরীণ” ইত্যাদি শব্দ এই প্রথম শুনিলাম। কানে রাজনীতির বাতাস গেল। কিছু-কিছু আন্দাজ করিতে পারিলাম। ইংরেজের প্রতি বিদ্বেষ বাড়িল। যুদ্ধে জার্মানির জয় কামনা করিলাম। জার্মানির পক্ষে যাইবার একটা অতিরিক্ত কারণও ছিল। জার্মানির সম্রাটের উপাধি কাইযার। হাকিমভাই নামে এক ‘সবজান্তা’ বন্ধু আমাকে বলিয়াছিলেন এটা আরবী-ফারসী কায়সার শব্দের অপভ্রংশ। শাহনামান কায়সার নিশ্চয়ই মুসলমান ছিলেন। সুতরাং জার্মান সম্রাটও আসলে মুসলমান এমন ধারণাও আমার হইয়া গেল। মুসলমান কায়সারকে খৃস্টানি কাইসার বানাইবার মূলে নিশ্চয়ই ইংরাজের দুষ্ট মতলব আছে। আমরা মুসলমানরা যাতে জার্মানির পক্ষে না যাই সে জন্যই এই বদমায়েশি করিয়াছে। এই অবস্থায় যেদিন শুনিলাম তুর্কির সুলতান মুসলমানদের মহামান্য খলিফা জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে নামিয়াছেন, সেদিন এ ব্যাপারে আমার আর কোনই সন্দেহ থাকিল না। মুসলমানদের খলিফা মুসলিম বাদশা-কে সমর্থন করিবেন না? তবে কে করিবে? এর পরে সমস্ত ইচ্ছা-শক্তি দিয়া জার্মানির জয় অর্থাৎ ইংরাজের পরাজয়ের জন্য মোনাজাত করিতে লাগিলাম। ’ (আহমদ, ২০০২, ২০-২১)

গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে তরুণ বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে যে প্রগতিশীল আন্দোলন গড়ে ওঠে তার সঙ্গেই আবুল মনসুর আহমদের মন-মানসিকতার সাযুজ্য ছিল অধিক। সাহিত্য-সাধনায় তিনি ছিলেন প্রবলভাবে সমাজলগ্ন। ব্যঙ্গরচনা তাঁর প্রধান অবলম্বন। সমাজের মুখোশধারী মানুষের স্বরূপ প্রকাশে তিনি আন্তরিক শিল্পী। মূলত কথাশিল্পী তিনি—গল্প আর উপন্যাস তাঁর বিচরণের ক্ষেত্র। এছাড়া প্রবন্ধ, শিশু-কিশোরতোষ রচনা এবং আত্মজীবনী লিখেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। সাহিত্যচর্চার জন্য ১৯৬০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদক। সমাজের ভেতরে দৃষ্টি প্রসারিত করে তিনি বাস্তবকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গত, সালভাদর দালির ডায়েরি শুরুর দিক থেকে খানিকটা বর্ণনা উদ্ধৃত করছি:
‘লিখবার জন্য আমি প্রথমবারের মত পরিধান করেছি একজোড়া পেটেন্ট চামড়ার জুতো, যা অস্বাভাবিক আঁটসাঁট বলে অনেকদিন পর্যন্ত পায়ে দিতে পারিনি। সাধারণত কোনও লেকচার দেবার আগে জুতোজোড়া আমি পায়ে দেই। কেননা যেই বেদনাকীর্ণ চাপ সৃষ্টি হয় পদযুগলে, তা আমার কষ্ঠনিঃসৃত শব্দকে বাড়িয়ে দেয় অনেকাংশে। সৃষ্ট বেদনায় আমি নাইটিঙ্গেল পাখির মত কিংবা সেইসব নিওপলিটান গায়কদের মত গাইতে পারি, যারা পরিধান করে এমনই আঁটসাঁট জুতো। এই অন্তরযন্ত্রীয় দৈহিক আকাঙ্ক্ষা, এই প্রবল নিপীড়ন বাধ্য করে শব্দকোষ থেকে পরিশোধিত ও উন্নত সত্যকে বের করে আনতে। আর তাই আমি এই জুতো পরে কোনও দ্বিধা ছাড়া আত্মনিগ্রহে নিপীড়িত হয়ে লিখতে শুরু করেছি পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসবার পেছনের সম্পূর্ণ সত্য এক কাহিনী। ’ (সূত্র: কালি ও কলম, ২০০৪, ১৩৩)

আবুল মনসুর আহমদ লেখালেখি শুরু করেছেন বিশ শতকের বিশের দশকে। তখন সাহিত্য-শিল্পের প্রবল পরিবর্তনের সময়। কল্লোল যুগের লেখকেরা সক্রিয়, ছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ (১৯২৬)। সাংবাদিকতা, রাজনীতি আর লেখালেখি চলেছে সমানতালে। তবে, ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ্ব থেকে সত্তরের দশকের প্রায় শেষ অবধি সক্রিয় রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে আমৃত্যু লেখালেখিতে ব্যাপৃত ছিলেন। সমকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অনাচার-কুসংস্কার প্রভৃতি তাঁকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে। কেবল ধর্মচিন্তায় নয়—প্রায় সমগ্রজীবন এবং সমস্ত ভাবনা জুড়েই বর্তমান ছিল তাঁর স্বাজাত্য-প্রীতি। তিনি সমাজকে দেখেছেন ব্যক্তির অভিমত, চিন্তা আর নানান প্রবণতার ভেতর দিয়ে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ আয়না (প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৫) গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘হুজুর কেবলা’র আরম্ভটি এরকম:
‘এমদাদ তার সবগুলি বিলাতি ফিনফিনে ধূতি, সিল্কের জামা পোড়াইয়া ফেলিল; ফ্লেক্সের ব্রাউন রঙের পাম্পশুগুলি বাবুর্চিখানার বঁটি দিয়া কোপাইয়া ইলশা-কাটা করিল। চশমা ও রিস্টওয়াচ মাটিতে আছড়াইয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল; ক্ষুর স্ট্রপ, শেভিংস্টিক ও ব্রাশ অনেকখানি রাস্তা হাঁটিয়া নদীতে ফেলিয়া দিয়া আসিল; বিলাসিতার মস্তকে কঠোর পদাঘাত করিয়া পাথর বসানো সোনার আংটিটা এক অন্ধ ভিক্ষুককে দান করিয়া এবং টুথক্রিম ও টুথব্রাশ পায়খানার টবের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া দাঁত ঘষিতে লাগিল। ’
এর পরের ২টি বাক্যে লেখক জানাচ্ছেন—‘অর্থাৎ এমদাদ অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিল! সে কলেজ ছাড়িয়া দিল। ’ প্রত্যেক লেখকই যে নিজের আত্মজীবনী লেখেন তাঁর সমস্ত লেখার ভেতর দিয়ে, আবুল মনসুর আহমদের এই গল্পটিও তারই নিদর্শন। গল্পের নায়ক এমদাদ। ‘কলেজে এমদাদের দর্শনে অনার্স ছিল। ’ সত্যি কথাটি হলো—লেখক নিজেই ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজে দর্শন বিষয়ে অনার্স পড়ার সময়ে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি অনার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পারেননি—ডিগ্রি পাস কোর্সের সার্টিফিকেট অর্জন করেছিলেন ১৯২৩ সালে।

দ্বিতীয় ও সমাপনী কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।