ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

যেমন আছে এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৫
যেমন আছে এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছবি: কাশেম হারুন- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। একটি ইতিহাস।

একটি জাতীয় স্মৃতিচিহ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানেই ৭ মার্চের দুনিয়াকাঁপানো ভাষণটি দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে। এসব কারণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে এ উদ্যানের। কেমন চলছে এখন উদ্যান? উত্তর খুঁজতে টানা দু’দিন ও চার রাতের একটা বড় সময় উদ্যানে অবস্থান করে সরেজমিনে যা দেখা গেছে তাই উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

১৯ মার্চ। সকাল ১০টা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করতেই একজন আনসার সদস্য বাংলানিউজের প্রতিবেদকদ্বয়ের কাছে জানতে চাইলেন ‘ব্যাগে কী?’। পেশাগত পরিচয় দিয়ে জবাব দেওয়া হলো, ‘ল্যাপটপ’। এ প্রশ্নের উত্তরে আনসার সদস্য বললেন, ‘তাইলে সাবধানে থাইকেন। নিরিবিলি জায়গায় যাইয়েন না। ’
 
দিন দুপুরেও যে এখানে ছিনতাইকারী থাকে তা আনসার সদস্যের কথায় টের পাওয়া গেল। আনসার সদস্যের এমন কথায় তাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনারা (আনসার) থাকতে ছিনতাই হয় কিভাবে?’ বিদ্রূপাত্মক হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাগো থাকা না থাকা সমান কথা। পুরা উদ্যানে আমরা এখন শিফটিংয়ে আছি মোটে ৫/৬ জন। তাও আবার খালি হাতে। ছিনতাই হইলে আমগো খাড়ায়া খাড়ায়া দেইখা যাওন ছাড়া আর কী করার আছে! কারণ ছিনতাইকারীদের হাতে অস্ত্র থাকে। আমাগো হাত খালি থাকে। ’
 
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিনেই এমন নিরাপত্তাহীন, আর সন্ধ্যার পরের দৃশ্য তো অন্যরকম। ১৯ ও ২০ মার্চ সারাদিন এবং ২০, ২১, ২২ ও ২৩ মার্চ সন্ধ্যা থেকে রাতের একটি অংশ উদ্যানে অবস্থান করে দেখা গেছে, নানা অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী এ উদ্যান।

 
মদ্যপানের নিরাপদ স্থান
ঐতিহাসিক এ উদ্যানকে এখন মাদকসেবীরা মদ আর গাঁজার নিরাপদ স্থান বানিয়ে ফেলেছেন। ভাসমান যৌনকর্মীরা ভেতরে অপেক্ষায় থাকেন খদ্দেরের। এ প্রাঙ্গণের যেসব অংশ অন্ধকার সেখানে আনাগোনা থাকে যৌনকর্মীদের। মাদক সেবন এখানে প্রকাশ্য। প্রায় প্রতি সন্ধ্যার পরই এখানে উন্মুক্ত কয়েকটি মদের আসর বসে। সন্ধ্যার পর উদ্যানে ঘুরলে যে কারও চোখে পড়বে, কয়েকটি দল গোল হয়ে বসে মদ পান করছে, আবার কেউবা গাঁজা। গাঁজা-মদের ঝাঁঝালো গন্ধে ভারী এখানকার পরিবেশ।



ছোপ ছোপ রক্তের দাগ
উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রমনা গণপূর্ত বিভাগের। উদ্যানের ভেতরেই রয়েছে গণপূর্ত বিভাগের (পিডব্লিউডি) কন্ট্রোল রুম। ১৯ মার্চ দিনে পিডব্লিউডি’র কন্ট্রোল রুমের ভেতরের খোলা স্থানে দেখা গেল ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ‘রক্তের দাগ কিসের?’ জানতে চাইলে সেখানে দায়িত্বরত পিডব্লিউডি’র পরিচ্ছন্নতাকর্মী খোকন বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাতে বাইরের লোকজন দেয়ালের উপরে বসে নেশা করে। দু’দিন আগে রাতে একজন নেশা করার সময় নিচে পড়ে যান। পরে মই এনে তাকে তুলে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডব্লিউডি’র একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, উদ্যানের ভেতরে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য না থাকায় রাতে এখানে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে।



বাইরে ধরে ভেতরে পেটানো!
২১ মার্চ রাত সাড়ে ৮টা। শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসিগামী সড়কের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একজন যুবককে রিকশা থেকে নামালেন কয়েকজন যুবক। কলার চেপে তাকে ধরে নামিয়ে সোজা নিয়ে গেলেন উদ্যানের ভেতর। এরপর যুবকটিকে কয়েকজন যুবক এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। উদ্যানের ভেতর একাধিক ভ্রাম্যমাণ হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় প্রতি রাতেই এমন ঘটনার সাক্ষী তারা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ভেতরে না থাকায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে প্রতি রাতে।



ধর্ষণও হলো এখানে!
মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনায় ঐতিহাসিক গুরুত্ব পাওয়া এ উদ্যানে মধ্যরাতে নারী ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। শাহবাগ থানাসূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১২ মে মধ্যরাতে এক তরুণী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। উদ্যানের তিন নেতার মাজারের পেছনে ওই তরুণীর প্রেমিক ও তার সাত বন্ধু মিলে তাকে গণধর্ষণ করে।

এ ঘটনায় প্রতারক প্রেমিক নাঈমসহ অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় পরদিন মামলাও করেন ধর্ষণের শিকার ওই তরুণী। উদ্যানে রাতে দায়িত্বরত কয়েকজন আনসার সদস্য বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ধর্ষণ ছাড়াও উদ্যানের ভেতরে একাধিকবার শ্লীলতাহানীর ঘটনাও ঘটেছে।
 
নিরস্ত্র আনসার উদ্যানের পাহারাদার
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭২ একর জায়গাজুড়ে এই উদ্যানের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র ১৯ জন নিরস্ত্র আনসার সদস্য। তাও আবার শিফটিংয়ে কাজ করছেন। দিনে ও রাতে তারা শিফটিংয়ে দায়িত্ব পালন করেন। আনসার সদস্যরা ভেতরে থাকলেও প্রতিনিয়তই এখানে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। ভেতরে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা জানান, নিরস্ত্র থাকায় অনেক কিছু দেখেও তারা কিছু করতে পারেন না।

৭২ একর উদ্যান পরিষ্কারে মাত্র ৬ জন!
দিনে পুরো উদ্যান ঘুরে দেখা গেছে, যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ। মলমূত্র চোখে পড়েছে বিভিন্ন স্থানে। উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রমনা গণপূর্ত বিভাগ-১ এর। ১৯ মার্চ উদ্যানের ভেতর প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গিয়ে পাওয়া গেল উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শাহ আলম ফারুককে। পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, ৭২ একর জায়গা পরিষ্কার করার জন্য মাত্র ৬ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাও পিডব্লিউডি-র দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তারা প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। পরিচ্ছন্নতার জন্য লোকসংখ্যা আরও বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে আবেদন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

আছে হিজড়াদের উৎপাতও!
২২ মার্চ রাত ৯টায় উদ্যানের ভেতরে দেখা গেল কয়েকজন হিজড়াকে। অনেকটা জোর করেই উদ্যানে ঘুরতে আসা মানুষদের  কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন। যারা টাকা দিচ্ছেন না তারা অপমান-অপদস্থ হচ্ছেন হিজড়াদের হাতে। বিড়ম্বনা এড়াতে অনেকে হিজড়াদের হাতে টাকা দিয়ে রক্ষা পাচ্ছেন। সাংস্কৃতিককর্মী আহমেদুল বাশার বলেন, ‘আমি প্রতি সন্ধ্যায় উদ্যানে আসি। অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি না হতে বেশি ভেতরে যাই না। উদ্যানে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে সেসবের মধ্যে হিজড়াদের উৎপাতও রয়েছে। ’

আছে সর্বস্ব হারানোর ভয়
২৩ মার্চ রাত সাড়ে ৯টায় উদ্যানের সামনেই কথা হয় বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সারওয়ার জাহানের সঙ্গে। যে সময়ে তার সঙ্গে কথা হয় তার আধঘণ্টা আগেই সর্বস্ব খুইয়েছেন তিনি। বললেন, ‘ভেতরে না গিয়ে উদ্যানের রাস্তায় কয়েকজন বন্ধুসহ আড্ডা দিচ্ছিলাম। উদ্যান থেকে উঠে যাওয়ার সময় আমি ভেতরে প্রস্রাব করতে যাই। আমার অন্য বন্ধুরা তখন বের হচ্ছিলেন। প্রস্রাব করার সময়ই ৬/৭ জন অস্ত্র বের করে ফোন মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে দ্রুত চলে যেতে বলে। পেছনে তাকালে গুলি করা হবে বলেও হুমকি দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেবল রাতেই নয়, দিনেও এখানে এমন ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন অনেকে।
 
উজাড় হচ্ছে সবুজ
সরেজমিনে দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনাসহ বিভিন্ন কারণে উদ্যানের অনেক সবুজ গাছপালা উজাড় হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দিনে ও রাতে উদ্যানের ভেতর অনেকে মোটর সাইকেল নিয়েও প্রবেশ করছেন। স্বাধীনতার পর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও আশানুরূপ ফল আসেনি।



স্বাধীনতা স্তম্ভ-স্বাধীনতা জাদুঘর নিয়ে নতুন আশা
১৯৯৬ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। দীর্ঘ ১৮ বছরে কয়েক দফায় প্রকল্পের ব্যয় ও সময়সীমা বাড়িয়ে সম্প্রতি অবকাঠামোর কাজ সম্পন্ন করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

স্বাধীনতাস্তম্ভ বা গ্লাসটাওয়ার এবং স্বাধীনতা জাদুঘর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণের দিকে একদমই মনোযোগ নেই কারও। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জনবলের বিদ্যমান কাঠামোয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। এজন্য আলাদা কোনও ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার।


বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।