ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রোমানিয়ার দিনগুলো... | হার্টা মুলার | অনুবাদ : এসএ মামুন

অনুবাদ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১৫
রোমানিয়ার দিনগুলো... | হার্টা মুলার | অনুবাদ : এসএ মামুন



প্রতিবার রোমানিয়া ভ্রমণ আমার কাছে জীবনের অন্য এক সময়ে পরিভ্রমণও বটে, কারণ ওই সময়ে আমি জানতাম না আমার জীবনের কোন ঘটনাগুলো নিছক দুর্ঘটনা বা সাজানো নাটক। এ কারণে আমি যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছি সবখানেই বলেছি আমার নামে খোলা পুলিশের গোপন নথিগুলো যেন দেখার সুযোগ দেয়া হয়।

বিভিন্ন অজুহাতে এ ফাইলগুলো দেখার অধিকার দেয়া হয়নি আমাকে। বরঞ্চ, এমন ভঙ্গিমা দেখানো হয়েছে যেন আমি এখনও সেই নজরদারির মধ্যে আছি।

গেল বসন্তে, এনইসি’র আমন্ত্রণে (নিউ ইউরোপিয়ান কলেজ) বুখারেস্ট গিয়েছিলাম। পরদিন লবিতে বসে কথা হচ্ছিল এক সাংবাদিক ও তার সঙ্গের ফটোগ্রাফারের সঙ্গে। হঠাৎ পেশীবহুল এক নিরাপত্তারক্ষী অনুমোদন আছে কি না জানতে চাইল এবং ফটোসাংবাদিকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। আদেশের সুরে বলতে লাগল, ‘এখানে ফটো তোলার অনুমতি নেই, এখানে যারা আছে তাদেরও। ’ দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় এক বন্ধুর সঙ্গে ডিনারের সময় নির্ধারণ করি। ফোনে যেমনটা কথা হয়েছিল সেই অনুযায়ী আমাকে হোটেল থেকে তুলে নিতে ওই বন্ধু ছ’টার দিকে এখানে এসেছিল। ফোন করে আমাকে তার আগমনের খরব জানাতে বললে রিসেপশনিস্ট বলে বসল তাকে এই ‘দর্শনার্থী ফরম’টা পূরণ করতে হবে। এতেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। কারণ, এ জাতীয় বিষয় আগে কেউ শোনেনি, এমনকি চসেস্কুর সময়েও না।

এরপর আমরা হাঁটা দিলাম রেস্টুরেন্টের দিকে। পথে বারবার সে আমাকে রাস্তার অন্যপাশ দিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করল। বিষয়টা নিয়ে আর বেশি ভাবিনি আমি। পরদিন শুনলাম এনইসি পরিচালক আন্দ্রেই প্লেসু’র কাছে ঘটনাগুলো খুলে বলেছে সে। ভীষণ ক্ষেপে গেলেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে সেক্রেটারিকে পাঠালেন ওই হোটেলের সব বুকিং যেন বাতিল করা হয়। হোটেল ম্যানেজার জানাল যে, যে মেয়েটি তখন ডেস্কে কাজ করছিল সেদিনই সে কাজে যোগ দিয়েছে এবং ব্যাপারটা নিতান্ত ভুলবশতই ঘটেছে। কিন্তু সেক্রেটারি রিসেপশনিস্টকে চিনতেন। দীর্ঘদিন ধরেই সে এ হোটেলে কাজ করছে। ম্যানেজার আরও জানাল, এ হোটেলের মালিক পুলিশের গুপ্ত সংস্থার (সিকিউরিটেট) সাবেক কর্মী এবং তিনি তার পুরনো স্টাইলই চালিয়ে যেতে চান। তারপর হেসে বলল, হ্যাঁ এনইসি তাদের বুকিং বাতিল করতে পারে কিন্তু অন্যখানেও একই ঘটনা ঘটবে। পার্থক্যটা হচ্ছে আপনি সেটা জানবেন না।

চসেস্কুর গোপন বাহিনীর নাম এখন রোমানিয়ান ইনফরমেশন সার্ভিস (এসআরআই)। নামটাই নতুন কেবল। সিকিউরিটেট-এর প্রায় অর্ধেক জনবল নতুন এই সংস্থায় আত্মীকৃত। আসল সংখ্যাটা হয়ত আরও বেশি।

রোমানিয়ার বুদ্ধিজীবীরা চসেস্কু’র গোপন বাহিনী সিকিউরিটেট-এর ফাইলগুলোর ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী না। আমার মত কেউ যদি বছরের পর বছর ধরে সেই পোপন ফাইলগুলো প্রকাশ করার কথা বলে তাহলে দেখা যাবে কাছের বন্ধুদের কাছে একসময় সেটা বাড়াবাড়ি ঠেকতে পারে। এটা আরেকটা কারণ। তাছাড়া কেন বছরের পর বছর সিকিউরিটেট-এর ফাইলগুলো ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর দ্য স্টাডি অব সিকিউরিটেট আর্কাইভস (সিএনএসএএস)-এর হাতে পৌঁছায় না। এ সংস্থাটি ১৯৯৯ সালে ইইউ’র দাবির প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সিএনএসএএস-কেও এসআরআইয়ের কাছে আবেদন করতে হয়। কখনও মঞ্জুর হয় সে আবেদন, অধিকাংশ সময়ই না করে দেওয়া হয়। ২০০৪-এ বুখারেস্ট যাই, আবেদন করার কাজে। সিএনএসএএস-এ ঢুকতেই তাজ্জব হয়ে যাই। দেখি তিনটি মেয়ে ছোট পোশাকে এমন ভঙ্গিতে সেখানে দাঁড়িয়ে যেন তারা পাবের মঞ্চে। মাঝখানে মেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে এক সৈনিক যেন মিলিটারি ব্যারাক পাহারা দিচ্ছে।

প্রত্যেক জাতিগত সংখ্যালঘুর জন্য সিকিউরিটেটর বিশেষায়িত বিভাগ ছিল। জার্মানদেরটাকে বলা হতো ‘জার্মান ন্যাশনালিস্ট অ্যান্ড ফ্যাসিস্ট’, তেমনি হাঙ্গেরীয়দের নামে থাকত ‘হাঙ্গেরিয়ান ইরেডেন্টিস্ট’ আর ইহুদিদের ফাইলকে বলা হত ‘জু ন্যাশনালিস্ট’।

হঠাৎ আমার ফাইলটাও খুঁজে পাই, ক্রিস্টিনা নামে সেটা খোলা হয়েছিল। তিনটি খণ্ড, মোট ৯১৪ পৃষ্ঠা। ১৯৮৩ সালের ৮ মার্চ খোলা হয় সেটা, যদিও আমার সম্পর্কে এর আগের তথ্যও সেখানে ছিল। আমার সম্বন্ধে গোপন ফাইল খোলার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে : আমার বই নাদিরস-এ ‘দেশের বাস্তবতার উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ পরিবেশে। ’ তাছাড়া জার্মান ভাষা-ভাষী কবিদের এক আড্ডায় আমার যাতায়াত ছিল।

যে তিন বছর আমি ট্রাক্টর ফ্যাক্টরি টেনোমেটাল-এর অনুবাদকের কাজ করেছি সেই বছরগুলো ফাইল থেকে উধাও। পূর্ব জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি করা মেশিনগুলোর ম্যানুয়াল আমি অনুবাদ করতাম। দু’বছর ধরে আমি বসতাম অফিসের চারজন বুককিপারের সঙ্গে। তারা মজুরি সংক্রান্ত হিসাবগুলো রাখত আর আমি মোটা টেকনিক্যাল ডিকশনারির পাতা উল্টে যেতাম। হাইড্রোলিক, নন-হাইড্রোলিক, লিভার, গজ এগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না আমি। ডিকশনারিতে যখন একটি শব্দের তিনটা, চারটা বা আরও অধিক প্রতিশব্দ থাকত তখন চলে যেতাম ফ্যাক্টরির মধ্যে, জিজ্ঞাসা করতাম শ্রমিকদের। তারা আমাকে সঠিক রোমানিয়ান শব্দটি জানাত। তৃতীয় বছরে এখানে একটি প্রোটেকল অফিস খোলা হয়। সদ্য নিয়োজিত দুজন অনুবাদকের সঙ্গে আমাকে কাজ করতে বলা হয় যাদের একজন ছিল ফরাসি, অন্যজন ইংরেজ। এদেরই একজন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের স্ত্রী। আমার ছাত্রাবস্থায় এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সিকিউরিটেট’র এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগ ছিল। আরেকজন গুপ্ত পুলিশের দ্বিতীয় বড় কর্তার পুত্রবধু। অফিসে বিদেশি কেউ এলে আমাকে সেখান থেকে চলে যেত হত। তারপর, দুবার আমাকে গুপ্ত পুলিশে যোগদানের পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হয়। দ্বিতীয়বার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর পুলিশ কর্মকর্তা স্তানার শেষকথাটি ছিল, ‘এক সময় ঠিকই বুঝবে, নদীতে ডুবিয়ে মারব তোমাকে। ’

এক সকালে দেখি অফিসের বাইরের দরজার কাছে মেঝেতে পড়ে আছে আমার ডিকশনারি। আমার জায়গা দখল করেছে একজন ইঞ্জিনিয়ার, অফিসে ঢোকার অনুমতি নেই আমার। বাড়ি যেতে পারছিলাম না আমি, তাহলে ততক্ষণাৎ তারা আমাকে ছাড়িয়ে দিতে পারে। পরের দুদিন দোতলার মুখের সিঁড়িটায় ডিকশনারি সঙ্গে নিয়ে আট ঘণ্টা করে কাটিয়েছি আমি। অনুবাদের চেষ্টাই করেছি, কেউ যেন বলতে না পারে আমি কাজ করিনি। অফিসের সহকর্মীরা নীরবে পাশ কাটিয়ে চলে যেত। আমার বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার জেনিই কেবল বুঝতে পারত আমার মধ্যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথে তাকে বলতাম সবটুকু। দুপুরের বিরতিতে সে আমার কাছে আসত, সিড়িতে বসে খাবার খেতাম আমরা—যেমনটা আগে অফিসে বসে খেতাম। ফ্যাক্টরির লাউডস্পিকারে আমরা শুনতাম শ্রমিকরা কোরাসে গাইছে দেশের মানুষ কতটা সুখে আছে। খেতে খেতে আমার জন্য কান্না করে উঠত সে। কিন্তু কান্না আমি করিনি। আমাকে শক্ত হতে হয়েছিল।



তৃতীয় দিনে জেনির ডেস্কের এক কোণে আমি জায়গা করে নিলাম। চতুর্থদিন এভাবে চলল। পঞ্চমদিন সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে ভেতরে ঢোকাতে অপারগ সে। তার সহকর্মীরা বলেছে আমি নাকি ‘গোয়েন্দা’। ডিকশনারি নিয়ে আমি আবারও সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। এবার কান্না চলে আসলো। ফ্যাক্টরিতে গিয়ে যখন একটা শব্দের অর্থ জানতে চাইলাম শ্রমিকরা ‘চর’ ‘চর’ বলে চিৎকার করে উঠল। ওপর থেকে নির্দেশ ছিল আমাকে নাজেহাল করতে। আমি যেন শেষমেষ পদত্যাগ করি। এই সময়টাতে আবার বাবা মারা যায়। কোনও কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি যে টিকে আছি এ ব্যাপারে নিজেকে নিজেই আশ্বস্ত করতে হয়েছিল। এবপর লিখতে শুরু করি নিজের জীবনের গল্প। ‘নাদিরস’ নামের বইয়ের সারবস্তু এসব লেখালেখি থেকেই।

এ ঘটনা কতদিন ধরে চলেছিল, তার কিছুই আমি জানি না। আমার কাছে তা ছিল অনন্ত। সম্ভবত সাতদিন, তারপর বরখাস্ত করা হয় আমাকে। ফাইলে মাত্র দুটো শব্দ রয়েছে এ বিষয় ঘিরে, হাতে লেখা একটা নোট। আমাকে চর হিসেবে নিয়োগের চেষ্টার ঘটনার পাশে এক লেফটেনেন্টের নোট, ‘এটা সত্য। ’

এরপর আসে জিজ্ঞাসাবাদের পালা আর গালাগাল : আমি কোনও চাকরির চেষ্টা করছি না, মানে পতিতাবৃত্তি, কালোবাজারি করেই টিকে আছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন কতকগুলো নাম বলা হলো যেসব নাম জীবনে শুনিনি। পশ্চিম জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থার লোক আমি—কারণ আমার সঙ্গে গ্যেটে ইন্সটিটিউটের একজন গ্রন্থগারিক ও জার্মান দূতাবাসের এক অনুবাদকের সঙ্গে খাতির রয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘিরে চলল মনগড়া তিরস্কার। শুধু এটুকুই নয়, তাদের কোনও পরোয়ানার দরকার ছিল না, রাস্তা থেকেও তুলে নিয়ে যেতে পারত আমাকে।

একদিন নাপিতের দোকানে যাওয়ার পথে এক পুলিশ আমাকে নিয়ে গেল একটি আবাসিক স্থাপনার বেজমেন্টে। সেখানে টেবিলে বসে ছিল সাদা পোশাকের তিনজন। হাড়গিলগিলে একজন ছিল তাদের নেতা। আমার পরচিয়পত্র দেখতে গিয়ে বলল, ‘ওই ... (অশ্রাব্য গালি), তোর সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। ’ তাকে কখনওই দেখিনি আমি। সে বলে উঠল, পোশাক ও প্রসাধনের লোভে আমি আট আরব ছাত্রের সঙ্গে শুয়েছি। কোনও আরব ছাত্রকেই চিনতাম না আমি। তাকে এ কথা বলার পর বলল, ‘যদি আমরা চাই তাহলে জনাবিশেক আরব ছাত্রকে সাক্ষী হিসেবে জোগাড় করতে পারি। তারপর দেখবে মামলাটা কত বড় হয়। ’ বারবার সে আমার পরচয়পত্র মেঝেতে ছুড়ে ফেলে আর আমি নীচু হয়ে আবার কুড়িয়ে নিই। এভাবে ত্রিশ বা চল্লিশবার ঘটার পর আমি যখন একটু ক্লান্ত হয়ে গেছি, অমনি সে লাথি ছুড়ে দেয় আমার পাছায়। টেবিলের পেছনের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে এক মহিলার আর্তনাদ শুনি আমি। এরপর আমাকে আটটার বেশি সেদ্ধ ডিম খেতে বাধ্য করা হয়। তারপর সেই হাড়গিলগিলে আমার পরিচয়পত্র রাস্তার ছুঁড়ে ফেলে পেছনে লাথি কষে। মুখ থুবড়ে পড়ে যাই । মাথা না তুলেই বমি করা শুরু করি। তারপর তাড়াহুড়ো না করে পরিচয়পত্রটি রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হই।

(সংক্ষেপিত)



বাংলাদেশ সময়: ১২৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।