ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

দিনের শেষ আলো (সমাপনী কিস্তি) | রোকসানা হাবিব লুবনা

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৬ ঘণ্টা, মে ২, ২০১৫
দিনের শেষ আলো (সমাপনী কিস্তি) | রোকসানা হাবিব লুবনা

প্রথম কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন


প্রথম কিস্তির পর | সৌমিক বলল, তুমি ছাড়া কোথাও যখন কিছু নেই তারমানে আমি তোমাকেই দেখছি। নাকি তোমার দিকে তাকানো নিষেধ আছে? কই আন্টি তো তেমন কোনও নিয়মের কথা বললেন না।

ও এত মজা করে কথাটা বলল যে আমি খুব জোরে হেসে দিলাম। ও তখন হাত দিয়ে আমার কপালের টিপটা ঠিক করে দিল। আমি তাকিয়ে পড়লে বলল বাঁকা হয়ে ছিল। এরপর আমরা যখন চপলার বাসায় আসলাম তখন আমার সব বান্ধবীরা আমাকে জড়িয়ে ধরল। সৌমিককে দেখে মুন এগিয়ে এসে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল এবং সৌমিক খুব স্বাভাবিক ভাবে ওদের সাথে মিশে গেল। মনে হলো, ও আগে থেকেই সবাইকে যেন চেনে।

আমার খুব ভালো লাগল, আমি বুঝতে পারছিলাম আমি হেরে যাচ্ছি আমার নিজের কাছে, আমার মনের কাছে। এরই মধ্যে চপলার আম্মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।   সৌমিকের দিকে তাঁকিয়ে বললেন, সৌমিক তুমি বসো। আমি চপলার আম্মু। এই মেয়েরা! তোমরা সৌমিকের দিকে খেয়াল রেখ—বলেই আন্টি অন্য মেহমানদের কাছে চলে গেলেন। আমরা সবাই চপলাকে ঘিরে ওর পাশে বসলাম। একে একে সব আত্মীয়রা ওকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে আর ও খুব সাবধানে মুখের কাছে টিস্যু নিয়ে সেই মিষ্টি মুখ থেকে বের করে ফেলে দিচ্ছে। আমরা সব বান্ধবীরা এটা নিয়ে অনেক মজার মজার কথা বলে ওকে বিরক্ত করার চেষ্টা করছিলাম।

সৌমিক মনে মনে ভাবছে ভাগিস্য মুন ওকে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তা-না হলে একা একা বসে থাকতে নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগত। এরই মধ্যে একটা ছেলের ভাইও ওর সাথে খড়গপুর আইআইটি পড়েছিল। তাই ওর সাথে খুব জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে বারবার শুধু শিউলীকে দেখছিল। যদিও শিউলীর বান্ধবীরা খুব ভালো, তারা শিউলীকে চোখে চোখে রাখছে। তারপরও কেন জানি না ওর ওপর থেকে চোখই সরছে না। সব মেয়েদের মধ্যে ওকে অনেক বেশি সুন্দরী আর স্নিগ্ধ, নিষ্পাপ লাগছে। সৌমিক সিদ্বান্ত নিয়ে নিল, খুব তাড়াতাড়ি শিউলীকে কথাটা বলতে হবে। হাতে একদম সময় নেই। চপলার আম্মা এসে ওদেরকে খেতে বসতে বললেন, কিন্ত ছেলেরা সবাই জিদ ধরল ওরা আজ সব বন্ধুরা একসাথে খাবে। সৌমিক খুব খুশি হলো, কারণ শিউলীকে ছেড়ে ওর খেতে মন চাইছিল না। তারপর সব বন্ধুরা একসাথে খেতে বসে গেল। শিউলী কিছুই খেতে পারল না শুধু পোলাও নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। সৌমিক উঠে এসে ওর পিছনে ঝুঁকে আস্তে করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তুমি পোলাও রেখে পায়েসটা খেয়ে নাও। মিষ্টি তোমার খেতে ভালো লাগবে।

শিউলী খুব অবাক হয়ে গেল। সৌমিক কিভাবে জানে একমাত্র মিষ্টি জিনিসটা খেতেই  ওর ভালো লাগে? ও কোনও তর্ক না করে পোলাও রেখে পায়েস খেল। ওর খাওয়া দেখে মুন তার পায়েসটা শিউলীকে দিয়ে দিল। ও পায়েস খাচ্ছে দেখে সবাই এখন তাদের পায়েস ওকে দিয়ে দিতে চাইল। শিউলীর এত ভালো লাগল যে ওর চোখে পানি চলে এলো। কিছুতেই ও এই মায়া দেখতে চায় না কারণ যত মায়া তত কষ্ট। শিউলী বলল, আর পারব নারে বন্ধু। ও টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে এসে দেখে সৌমিক এক হাতে পানি আর অন্য হাতে ঔষধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিউলী খুব অবাক হলো কিন্ত কিছুই বলল না, চুপ করে ঔষধগুলি খেয়ে নিল। তারপর আবার বন্ধুদের গল্প শুরু হলো। এইবার সবাই একসাথে বসে আড্ডা শুরু করল কিন্ত শিউলী কোনওভাবেই বসতে পারছে না। ও সৌমিকের দিকে তাকালেই, সৌমিক উঠে দাঁড়িয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিউলীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।

গাড়িতে উঠেই শিউলী মাথাটা কাত করে দিল সিটের ওপর। সৌমিক আস্তে করে পরম যত্নে মাথাটা নিজের কোলের ওপর তুলে নিল। বাধা দেবার মতো কোনও শক্তি শিউলী পেল না। পুরো শরীরটা ছেড়ে ও অচেতন হয়ে পড়ে রইল সৌমিকের কোলে। গাড়ি বাসার সামনে আসলে খুব আস্তে করে সৌমিক ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাক দিলে শিউলী খুব কষ্ট করে উঠে বসল। ওকে ধরে গাড়ির থেকে নেমে উপরে নিয়ে গেল। তারপর ওকে বাসায় দিয়ে সৌমিক চারতলায় চলে গেল।

সৌমিকের এত অসহায় লাগছিল, কিছুতেই শিউলীকে ছেড়ে ওর আসতে মন চাইছিল না। খালা দরজা খোলার পর সৌমিক একটা হাসি দিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। এমন ভাব করল যেন খুব ক্লান্ত, কাপড় বদলেই বিছানায় ঝাঁপ দিবে। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। ওর কারও সাথেই এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। খুব কাঁদতে মন চাইছে, নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।

শিউলী ঘরে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। আম্মা বললেন, খুব কি খারাপ লাগছে? মাথা ব্যথা করছে? আম্মার অস্থিরতা দেখে খুব জোর করে উঠে বসে বলল, না আম্মা! অনেকক্ষণ বিছানাটাকে দেখি না তো, তাই বিছানাটা খুব মিস করছিলাম। বলেই হাসলো।

আম্মা বললেন, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, তুমি কাপড় বদলে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি পরে এসে লাইট বন্ধ করে দিব। আম্মা চলে গেলেই আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন খুব হালকা লাগল। রাতের শাড়ি পরাই ছিলাম, তাই হাতে সেলোয়ার কামিজ নিয়েই বাথরুমে গেলাম। একেবারে গোসল করে বের হয়ে আম্মাকে বললাম, আম্মা খুব খিদে পেয়েছে। আম্মা টেবিলে খাবার দিয়েই আমাকে বললেন এই যে! আমি তো টেবিলেই বসে আছি আমার রাজকুমারী!

আম্মা মাঝে মাঝে আদর করে আমাকে রাজকুমারী ডাকেন। আমারও খুব ভালো লাগে।   আমি বুঝতে পারি আজ আম্মার মন খুব ভালো। আমি খেতে বসলেই কলিংবেলের শব্দ হলো। বুয়া দরজা খুলেই বললো, ভাইয়া আসেন।

সৌমিক একটা হাসি দিয়ে টেবিলের কাছে চলে এলো। আম্মা নাস্তা খেতে বললে, ও বলল খেয়ে এসেছে, শুধু চা খেতে চাইল। আম্মা বুয়াকে চা বানাতে বলে ওর সাথে গল্প শুরু করল। আমার খাওয়া শেষ হলে আম্মা ঔষধের বাক্সটা নিয়ে আমাকে একটা একটা করে ঔষধ দিলেন। আমি চোখ মুখ বন্ধ করে খেয়ে নিলাম। সৌমিক হঠাৎ বলল, শিউলী তোমার না অনেক গল্পের বই আছে? আমি কি কিছু বই নিতে পারি পড়ার জন্য? পড়া শেষ হলে আবার ফেরত দিয়ে দিব। সাথে সাথে আম্মা বললেন, শিউলীর ঘরে সব বইই পাবে। শিউলী, তুমি ওকে নিয়ে বইয়ের আলমারিটা খুলে দাও। সৌমিক, তোমার যেটা ভালো লাগে নিয়ে যাও বাবা।

সৌমিক পিছন পিছন আমার ঘরে চলে এলো। আমি চাইছি না সৌমিককে আমার ঘরে আনতে। কিন্ত আমার মন খুব চাইছে ওকে আমার ঘর, আমার বইয়ের আলমারি, গানের সিডিগুলি দেখাতে। ও খুব মন দিয়ে বইয়ের আলমারি দেখতে লাগল আর অবাক হয়ে বলল, তোমার এত বই! বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ইন্ডিয়া, ব্রিটিশ সব দেশের লেখকের বই আছে। আমি চুপ করে আছি দেখে ও আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আমাকে বলল, ওই পাশে কি তোমার বারান্দা? বলেই বারান্দায় গিয়ে আমাকে ডাকল।

আমিও ওর পিছন পিছন গেলাম। বাইরে অনেক রোদ কিন্ত সেই সাথে হালকা বাতাস থাকায় বারান্দায় খুব ভালো লাগছে। বারান্দায় এক সময় আমি অনেক গাছ লাগিয়েছিলাম তারা এখন লকলকিয়ে বড় হয়েছে। তাই বাইরে যতটুকু বাতাস আছে সেটা এই গাছে লেগে আরও ঠাণ্ডা একটা পরিবেশ তৈরি করে দেয়।

সৌমিক আমার দিকে গভীরভাবে তাঁকিয়ে বলল, শিউলী! তোমাকে আমার খুব জরুরি আর গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই বলা হয়নি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কী কথা?

ও খুব হাসি খুশিভাবে বলল, ভয় পেওনা। তোমাকে বলাই হয়নি যেদিন আমি প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম সেই দিনই এবং সেইক্ষণেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন আমি আমার বাকি জীবনটা তোমার সাথে কাটাতে চাই।

এত সাবলীলভাবে কথাটা ও বলল যে আমি রাগ হব নাকি লজ্জা পাব বুঝতে পারছিলাম না। আমি খুব আস্তে করে বললাম, আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না।

সৌমিক এমন ভাব করল যেন ও আমার উওরটা জানত। ও আরও স্বাভাবিকভাবে বলল, আমি তো তোমার কাছে জানতে চাইনি তুমি আমাকে ভালোবাসো কি বাসো না। ভালোবাসা কি এই ভেবে হয় যে, ওকে আমার পেতেই হবে? আমাকেও ওর ভালোবাসতেই হবে? না! তা হয় না, ভালোবাসা হঠাৎ হয়ে যায়। আমার হাতে সময় খুব কম, তাই দেরি না করে তোমাকে আজই জানালাম। একদিন দেরি করা মানে তো তুমি জানো। তোমাকে পাওয়া, তোমার সাথে থাকা, গল্প করাটা একদিন কমে যাবে আমার জীবন থেকে।

আমার খুব কান্না পেতে থাকল। মনে হলো, চিৎকার করে বলি, আমি কেন? কেন আমিই? এত দেরিতে কেন এলে? সৃষ্টিকর্তা আমার হাতে সময় কেন এত কম? আমার এখন বাঁচতে মন চাইছে, মনে হচ্ছে আবার নতুন করে জীবনটাকে শুরু করি। কিন্ত কিছুতেই কাঁদতে পারলাম না। এমনকি সৌমিককে বলতে পারলাম না, আমার হাতে কোনও সময় নেই, তুমি বড় বেশি দেরি করে ফেলেছো অথবা আমার অনেক তাড়া আছে। এরমধ্যে আম্মা শিউলী বলে ডাক দিলেন। সৌমিক থেমে গিয়ে পিছনে তাকালে, আম্মা বললেন, শিউলী মুন ফোন করেছে, লাইনে আছে। আমি ফোন ধরতে চলে গেলাম। মুন জানতে চাইছে, আজ কখন বের হব। পার্লারে যাব কিনা তাহলে ও সাথে করে নিয়ে যাবে। আমি বললাম, পার্লারে গিয়ে আমি কী করব? আমি কি তোদের মতো কেশবতী? মুন বলল, সব সময় নেতিবাচক কথা বলবি না তো! আমি কি চুল বাঁধতে যাচ্ছি? আমি যাচ্ছি মেকআপ আর মেহেদি লাগাতে। আমি বললাম তোরা যা, আমি যাব না। মুন বলল, ঠিক আছে তুই সৌমিক ভাইকে নিয়ে সাতটার মধ্যে চলে আসবি, রাখি এখন।

আমি ফোন রেখে দিলে, আম্মা পিছন থেকে বললেন, আজ সাতটায় যেতে হবে? ভালো হয়েছে, তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আমি আম্মাকে বললাম, আজ আমার যেতে মন চাইছে না। আম্মা খুব চিন্তিত হয়ে বললেন, শরীর ঠিক আছে তো? জ্বর আসেনি তো? আম্মা কাছে এসে কপালে হাত দিলেন কান্না কান্না ভাবে। আমি বললাম, না আম্মা! আমি ভালো আছি, তুমি চিন্তা করো না। আমি যাব। আম্মা হেসে দিলেন। আম্মাকে আমার চিন্তায় ফেলতে ইচ্ছা করে না। আর মাত্র কয়েকদিন, এই সময়ও যদি তাদের চিন্তায় ফেলি তাহলে তারা বাঁচবে কী নিয়ে?

সৌমিক হাতে বুদ্ধদেব গুহের লেখা হলুদ বসন্ত পাখি বইটা নিয়ে বলল, খালাম্মা আমি আসি। ঠিক সাতটায় আমি আসব শিউলীকে নিতে। আম্মা বললেন, ঠিক আছে বাবা। তুমি যাচ্ছো তাই তো আমরা নিশ্চিন্ত আছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা। সৌমিক হেসে বলল, আমি ধন্যবাদ দিব আপনাদেরকে আর চপলাদেরকে কারণ দেশের বাইরে থাকার কারণে কতদিন যে বিয়ে বাড়ির মজার খাবার খেতে পারিনি। বিয়ে বাড়ির খাবারের মজাই আলাদা খালাম্মা! আপনি চাইলে ঢাকা শহরের আর কার কার বিয়ে আছে খুঁজে আমাকে লিস্ট দিতে পারেন। আমি খুব খুশি মনে চলে যাব। আম্মা জোরে হেসে দিলেন। হাসলে আম্মাকে খুব সুন্দর লাগে, গালে টোল পড়ে। আমার আবার সৌমিকের প্রতি ভালোলাগা বাড়তে লাগল। লোভ হতে লাগল ওর সাথে সারাক্ষণ থাকার। আম্মা কতদিন পরে যে এত মন খুলে হাসলেন! আমাকে ব্যাঙ্গালোর থেকে আনার পর আম্মা তো হাসতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। সৌমিক চলে গেলে আমি আবার বারান্দায় এসে আমার দোলনায় বসলাম। আগে খুব দোল খেতাম, এখন আর পারি না। কেমন যেন মাথাটা ঘুরতে থাকে, বমি বমি ভাব হয়, খুব কষ্ট হয়। দূরের আকাশে এক টুকরা কালো মেঘ জমে আছে আর সব জায়গায় সাদা আকাশ। বাতাসটা কেমন জানি থমকে আছে। চারপাশে নানা রকম শব্দ। আমার যখন শব্দ খুব বিরক্ত লাগে তখন আমি শব্দকে একটা তালে নিয়ে আসি। তখন সব শব্দগুলি এক হয়ে সে নিজেই তার টিউন ঠিক করে বাজতে থাকে আর আমি শব্দকে অনুভব করি। এটাতে অনেক লাভ হয়। আশেপাশের সব শব্দ তো আমি বন্ধ করতে পারব না! কিন্ত সেই শব্দকে সুরে নিয়ে আসলে ও আমাকে বিরক্ত করতে পারে না। আমি নিজের সাথে নিজেই কত রকমের খেলা করি। কাউকে এই কথাগুলি বলা হয়নি কখনও। আচ্ছা! অন্যরাও কি এই রকম করে? সেটাও জানা হয়নি। কত কিছুই যে জানা হয়নি, দেখা হয়নি তাহলে কেন যাব আমি? কেন কেন?

সন্ধ্যায় একটা লাল পাড়ের ক্রিম রঙের শাড়ি পরলাম। আম্মা দুই হাত ভরে মেহেদি দিয়ে দিয়েছিলেন। সৌমিক আমাকে দেখে আবার তাকিয়ে থাকল। বাবা এসে সৌমিকের সাথে কথা বললেন, কবে ও চাকরিতে যোগ দিবে সেটা জানতে চাইলেন। তারপর সৌমিক আমাকে নিয়ে নিচে নেমে আসলো। গাড়িতে উঠেই ও বলল, আজ রাতে মনে হয় বৃষ্টি হবে। আমি শুধু আকাশের দিকে তাকালাম। গাড়িতে আর কোনও  কথা হলো না। আমি অনুভব করতে পারছিলাম সৌমিক আমাকে দেখছে! একটা মানুষের চোখে এত ভালোবাসা কিভাবে থাকে? আসলেই কি ভালোবাসা হঠাৎ করে আসে আর ঝড় তুলে যায়? আমার ভিতরে একটা ঝড় হচ্ছে, খুব ভালোলাগার একটা ঝড়। এই ঝড়ে আমার নিজেকে বিলীন করে দিতে মন চাইছে। মন চাইছে বলতে, আমিও তোমাকে কিভাবে জানি ভালোবেসে ফেলেছি। মন চাইছে বলতে, সৌমিক তুমি কি জানো, আমি তোমার ওপর নির্ভর করা শুরু করেছি? গাড়িটা কমিউনিটি সেন্টারে এসে থামলে মুন এসে দরজা খুলে দিল।

সব বান্ধবীরা এত সুন্দর করে চুল বেঁধেছে কিন্ত কেউই চুলে ফুল দেয়নি। আমি বুঝতে পারলাম আমার জন্য ওরা ফুল দেয়নি কারণ চুলে ফুল দেওয়া আমার খুব পছন্দ। একসময় আমার মাথায় অনেক চুল ছিল। আমি কোথাও গেলেই চুল বেঁধে ফুল দিতাম। অন্য বান্ধবীরা না দিলে আমি নিজেই ফুল কিনে তাকে দিতে বাধ্য করতাম। চপলার বরটা খুব সুন্দর। আমার সব বান্ধবীরা স্টেজে বরের কাছে গেল। মুন শুধু আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। সৌমিক এসে মুনকে বলল তুমি যাও, আমি আছি। মুন চলে গেলে সৌমিক আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, একটুও নড়বে না। তোমার একটা ছবি নেব। আমি না বলার আগেই ক্লিকের শব্দ হলো। সৌমিক বলল, জীবন থেকে ‘না’ শব্দটা মুছে দাও। দুই হাত ভরে এখন শুধু জীবনকে দিয়ে যাও শিউলী। এইটুকু নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে, বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।

চপলাকে বিদায় দেওয়ার আগেই সৌমিক আমাকে নিয়ে খালাম্মার কাছ থেকে বিদায় নিল। আমার আজ শরীর ভালো, তারপরও ও যে কেন থাকতে চাইল না বুঝলাম না। গাড়িতে উঠেই আমি বললাম, আজ তো আমার শরীর ভালো তারপরও কেন আমরা আগে চলে আসলাম? সৌমিক হেসে বলল, কারণ এখনই চপলা চলে যাওয়ার সময় সবাই কাঁদবে আর সেই সাথে আকাশও। তাই চলে এলাম। এই সময়টুকু তুমি আমার সাথে থাকো। চলো, তোমাকে কফি খাওয়াই। আমি বললাম না, এই অবস্থায় যাব না। ও বলল আমার জন্য তুমি কি কিছুই রেখে যাবে না? কোনও স্মৃতিই কি থাকবে না? আমি বাঁচব কী নিয়ে?

আমি বললাম, আপনি কি সব জানেন?

সৌমিক বলল, হ্যাঁ আমি জানি। তাই তো আমার এত তাড়া। আমি চাই শেষ সময়টা তোমার হাত ধরে বসে থাকতে, তোমাকে বোঝাতে তুমি একা না। আমিও আছি তোমার পাশে।

আমি বললাম কাউকে বিদায় দেওয়াটা কত কষ্টের এটা কি আপনি জানেন?

নিজের জন্য কফি আর আমার জন্য আইসক্রিমের কথা বলে, আমার দিকে তাকিয়ে বলল, উওরটা দিতে পারি একটা শর্তে।

আমি বললাম, কী শর্ত?

ও বলল,  আমাকে ‘তুমি’ এবং ‘সৌমিক’ বলবে, তাহলে আমি উত্তরটা দেব।

আমি হেসে বললাম, বলব।

সৌমিক বাচ্চাদের মতো আবদার করল। তাহলে এখনই এই প্রশ্নটাই তুমি এবং সৌমিক বলে করো।

আমি হেসে দিয়ে তা-ই বললাম, প্রশ্নটা আবার করলাম। ও কোনও মজা না করেই  উত্তর দিল, না, জানি না। কিন্তু জানো? ভালোবাসা মানুষকে অনেক সাহসী করে তোলে? আমিও নিজের অজান্তেই কিভাবে যেন অনেক সাহসী হয়ে উঠেছি। এই দেখ, আমার চোখে কোনও পানি নেই। আমি কালকের কথা চিন্তা করে আজকে নষ্ট করতে চাই না। তাই তো কোনও ভনিতা, নাটক সিনেমার নায়কদের মতো কোনও নাটকীয়তা করে তোমাকে বোঝাইনি যে আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।

আমি চুপ করে ছিলাম। কোনও কথা বলতে পারছি না। গলার কাছে অনেক কিছু আটকে ছিল। তার মধ্যে কিছু কথা, কিছু ভালোলাগার কান্না আর চলে যাবার কষ্ট।

ও বলল কই কিছু বলো? একটু অপেক্ষা করো, আগে তোমার আম্মাকে জানাই যে আমি তোমাকে নিয়ে কফি খেতে এসেছি। তা-না হলে উনারা চিন্তা করবেন। ও আম্মাকে ফোন করে কথাটা বলল। ওই পাশ থেকে আম্মা কী বললেন আমি শুনতে পাইনি। ওকে শুধু বলতে শুনলাম, ঠিক আছে খালাম্মা।

আমার সবচেয়ে ভালো লাগে সবদিকে সৌমিকের নজর থাকে, খেয়াল থাকে। বেশিরভাগ মানুষই অন্ধের মতো ভালোবাসে। নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, বুঝতে চায় না। সৌমিক আমার দিকে তাকালে আমি বললাম, মাঝে মাঝে আমার খুব রাগ হয়, আমার নামটা কেন শিউলী? শিউলী ফুল যেমন সকাল হলেই ঝরে পড়ে আমাকেও ঠিক সেই রকম আমার জীবনের সুন্দর দিন শুরু হবার আগেই চলে যেতে হবে। কেন এমন হলো?

ওয়েটার কফি আর আইসক্রিম দিয়ে গেল। সৌমিক টেবিলের দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিল। আমার দিকে আর তাকাল না, মাথা উঁচু করল না কিন্ত তারপরও আমি ওর চোখের পানি দেখতে পেলাম।

অনেকক্ষণ পরে সৌমিক বলল, শোন! ভালোবাসা কখনও মরে না। তুমি বেঁচে থাকবে আমার মধ্যে। আমি বেঁচে থাকব তোমার মধ্যে। এত মন খারাপ করো না। তুমি ভাবছো তুমি চলে যাবে, এমনও তো হতে পারে যে তোমার আগে আমিই কোনও একটা এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলাম।

আমি বললাম, এইগুলি কী কথা?

সৌমিক হেসে বলল, যাক বাঁচা গেল। বুঝতে পারলাম, তুমি আমাকে ভালোবাসো। এটা বলে খুব জোরে হাসতে লাগল। বলল এইবার চলো যাই। তোমার ঘুমের দরকার।

বাসায় ফেরার পর আমার মনটা খুব ভালো লাগছিল। অনেকদিন পর গুনগুন করে গান গাইছিলাম। আম্মা ঔষধ আর পানি নিয়ে আসলে আমি কোনও বিরক্তি ছাড়াই লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঔষধ খেয়ে নিলাম। আম্মা বললেন, আমাকে কি বলা যাবে আজ কী হলো?

আমি বললাম, কিছু হয়নি আম্মা। বলেই আম্মাকে আদর করে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা আমার দরজার কাছে এসে বললেন, তুমি এখনও কেন জেগে আছো মা? তোমার বিশ্রাম খুব দরকার। আম্মাকে বকা শুরু করলেন লাইট অফ করে দেবার জন্য। আম্মাকে আর কিছুই বলা হলো না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসতেই মাথাটা চক্কর মেরে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার আর সময় নেই। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন থেকেই আমার খুব মাথা ব্যথা হতো। প্রথমে কেউ এটা গুরুত্ব দেয়নি। তারপর যখন এটা সহ্যের বাইরে চলে গেল তখন চোখের ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার ভালো করে চোখ দেখলেন কিন্ত কোনও সমস্যাই পেলেন না। এরপর নিউরোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেলেন বাবা। প্রথম দিকে ওই ডাক্তারও কিছুই পেলেন না। আমি  অসহ্য ব্যথায় চিৎকার করে কান্না করতাম। এরপর বাবার এক বন্ধু ব্যাঙ্গালোরে তারই এক ডাক্তার বন্ধুর ঠিকানা দিল।

বাবা এবং আম্মা আমাকে নিয়ে সেখানে গেল। ওই ডাক্তার সবকিছু টেস্ট করে মাথায় দুইটা টিউমার পেলেন। টিউমারগুলি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থায় চলে এসেছিল। উনি বাবা আর আম্মার সাথে কথা বলে বোঝালেন অপারেশন করতে হবে কিন্ত বাঁচার চান্স মাত্র ৫% । বাবা তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। ৫% তো চান্স আছে? এই-বা কম কী? ওই সময় আমার সব চুল কেটে ফেলে দেওয়া হলো। আমার অপারেশন হয়ে গেল। সবই ঠিক ছিল কিন্ত দুর্ভাগ্য মনে হয় আমার পিছনে দাঁড়িয়ে হাসছিল। তাই আরও যে একটা খুবই ছোট টিউমার ছিল সেটা ডাক্তার অপারেশন করে বের করতে পারেননি। সুস্থ হওয়ার পর আবার যখন স্ক্যান করানো হলো তখন সেই টিউমারটির সামান্য অস্তিত্ব পাওয়া গেল। ডাক্তার বললেন, এটা বড় হওয়ার আগে যদি ফেটে না যায় তাহলে পরে আবার অপারেশন করতে হবে। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ফেটে গেলে কী হবে? ডাক্তার চুপ করে গেলেন। তারপর বললেন, তাহলে আর বাঁচার কোনও চান্স থাকবে না। এটা শুনে আমরা পাথর হয়ে গেলাম। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না।

এখনও কত কিছু দেখা আমার বাকি। কত কিছু করা বাকি। তাহলে, কেন এত তাড়াতাড়ি আমাকে যেতে হবে? ডাক্তার সব ঔষধ দিয়ে দিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন যেন মাথায় চাপ লাগে এমন কোনও কাজ আমি করতে পারব না। চিন্তা-তো একদমই না। এরপর আমরা ঢাকায় চলে এলাম।

বেঁচে থাকার জন্য আমি সবকিছু ছেড়ে দিলাম। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়াটাও বন্ধ করে দিলাম। নিজের জীবনটা এই ঘর আর ছাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললাম। সেই সাথে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকলাম পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার জন্য। কিন্তু প্রস্তুত করতে চাইলেই কি করা যায়? বাবা এবং আম্মার জন্য খুব খারাপ লাগত কারণ আমি তাদের একমাত্র সন্তান। আমি চলে গেলে ওরা খুব একা হয়ে যাবেন। তারপর আবার চিন্তা করতাম এই পৃথিবী কারও জন্য থেমে থাকে না। সবাইকেই চলতে হয়।

এরইমধ্যে জীবনে আসলো ভালোলাগা আর ভালোবাসা নিয়ে সৌমিক। এখন পৃথিবী ছেড়ে যাওয়াটা আরও কঠিন হয়ে গেল। উফ! মাথায় আবার খুব ব্যথা করছে। আবার আমি অচেতন হয়ে যাচ্ছি। সকালে অনেক দেরি করে বিছানা থেকে উঠলাম। রাতের কথা কিছুই বললাম না আম্মাকে। ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখি আম্মা আর সৌমিক গল্প করছেন। সৌমিক কী যেন বলেছে আর আম্মা খুব হাসছেন। আমার সব ব্যথা চলে গেল। মনে হলো আমি চলে যাওয়ার পর বাবা-আম্মা একা হয়ে যাবেন না।   সৌমিক তাদের জীবনে থাকবে। ও অন্য দশটা ছেলের মতো না। ওর ভালোবাসা অন্যরকম। এই ভালোবাসায় পাওয়ার কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। আছে শুধু দুই হাত ভরে দেবার ইচ্ছা। কিভাবে এই মানুষটাকে ছেড়ে আমি যাব? আমার খুব কান্না পেতে থাকল। আমি চেয়ারে না বসেই আবার রুমে চলে এলাম। আল্লাহকে বললাম আমাকে শক্তি দাও। এই ভালোবাসার মানুষদের ছেড়ে যাবার শক্তি দাও।

হঠাৎ পিছন থেকে সৌমিক বলল, চোখে পানি মুছে কিছু খেয়ে নাও। ঔষধ খেতে হবে। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিব না। তাহলে আমি কিভাবে বাঁচব? হাতটা ধরে সৌমিক আমাকে টেবিলে নিয়ে আসলো। আমি খাবার মুখে দিলেই ও জানতে চাইল, ফুল বিবি! তুমি সব সময় সন্ধ্যার আগে ছাদে যাও কেন? দিনের আলোকে বিদায় দিতে? যেন ওর বিদায় বেলায় ও নিজেকে একা, একদম একা মনে না করে?

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তুমি বুঝলে কী করে? আর তুমি আমাকে ফুল বিবি বলে ডাকলে কেন? বলেই আমি হাসতে লাগলাম।

সৌমিক খুব স্বাভাবিক গলায় বলল আমি তো তোমাকে বিভিন্ন নামে ডাকি।

আমি জানতে চাইলাম কী কী নাম?

ও বলল অনেক কিছু! স্বপ্ন কুমারী, শান্তি কুমারী।

আমি হাসতে হাসতে শেষ। তারপর ও ঔষধ খুলে হাতে দিল। আমি সবগুলি ঠিক মতো খেলাম। তারপর অনেকক্ষণ আমরা গল্প করলাম। মাঝে মাঝে আম্মা এসে যোগ দিলেন আমাদের গল্পে। দুপুরে আম্মা ওকে আমার সাথে ভাত খেতে বললেন। ও সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পরও ও আমাকে ঔষধ দিল। তারপর বলল,  তুমি রুমে গিয়ে একটু ঘুমাও। সন্ধ্যার আগে ছাদে চলে এসো, আমি অপেক্ষা করব।

আমার আবার মাথা ব্যথা শুরু হলো। একবার বমিও হলো। আমি চুপ করে শুয়ে থাকলাম। সন্ধ্যার আগে যখন ছাদে যাওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠলাম, দরজার কাছে যাবার পরপরই সবকিছু অন্ধকার লাগল। নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলাম না। পড়ে যেতে যেতে আম্মার চিৎকার শুনতে পেলাম। এরপর অনুভব করলাম সৌমিকের হাত আমার হাতের মধ্যে আর মাথাটা ওর কোলের ওপর। ও পাগলের মতো শিউলী শিউলী বলে চিৎকার করছে। কিন্ত আমি এত আস্তে কেন শুনতে পারছি? আস্তে আস্তে আমি গভীর ঘুমের দেশে যেতে যেতে শুনতে পেলাম সন্ধ্যার আজান শুরু হলো। আর দূর থেকে থেকে ভেসে এলো অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। আজ দিনের আলোকে একা যেতে হবে না। দিনের শেষ আলোর সাথে আমিও অন্ধকারে পথে চলে যাচ্ছি।



বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, মে ২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।