ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লিও’র পৃথিবী | পিয়ের ভিট্টরিও তনদেল্লি | অনুবাদ : সোহরাব সুমন

অনুবাদ গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৫
লিও’র পৃথিবী | পিয়ের ভিট্টরিও তনদেল্লি | অনুবাদ : সোহরাব সুমন

পো উপত্যকার ভাটির এক ছোট্ট শহর। এতে রয়েছে স্তম্ভের সারি, সাধারণের চলাচলের মূল সড়কের পাশে পাথরে বাঁধানো চত্বর, শহরের পৃষ্ঠপোষক সন্তর উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটা চার্চ, একটা রেনেসাঁ প্রাসাদ, একটা দুর্গ, উনিশ শতকের ঘর বাড়ির পুরাতন এক এলাকা, এবং আঠারো শতকের দু একটা দালান।

পুরাতন শহরের দেয়াল থেকে সংগ্রহ করা শহরের কাপড়গুলো এখনও অক্ষত রয়েছে। এই শহরেরই মূল চত্বরের বাইরের দিকে মুখ করে থাকা বিশাল একটা পুরাতন বাড়িতে লিও’র জন্ম, বাড়িটা এখনও আছে, কিন্তু খুব বেশিদিন সেটা আর সেখানে থাকছে না। বাড়িটা এখন পরিত্যক্ত। ভাড়াটেরা বাড়িটা ছেড়ে চলে গেছে, কেবল নাপিত ছাড়া নিচতলার সব দোকানদারও তাদের দোকান ছেড়ে দিয়েছে। ভেঙে ফেলার কাজ যথাসময়ের অনেক আগেই শুরু হবে এবং ইতিহাস আর স্থাপত্যশৈলির সঙ্গে সম্পর্কহীন আরও একটা দালান এই শহরে যোগ হতে চলেছে।

নিচু সিলিং, মুখছাড়া জানালা, এবং গোলাপি-কমলা বা নীলচে-সবুজে উত্তরাধুনিক ধাঁচে রঙ করা দুই কি এক কামরার এপার্টমেন্টে ঠাসা একটা দালান। কিন্তু তাতে সে মোটেই বিচলিত নয়। তার বাবা মাও সবকিছু একইভাবে দেখতে অভ্যস্ত। কেবল কয়েদিদেরই জায়গার দরকার। এবং শহরের বাসিন্দা লিও অতীতের প্রতি তার শ্রদ্ধার কারণে সব কিছু যেমন আছে তেমনি রাখার পক্ষে। বিস্ময় নিয়ে সে আশপাশের সব কিছু দেখে, এর অন্যতম উদাহরণ, উনিশ শতকে তৈরি ভক্তিমূলক ছোট ওই উপাসনালয়, সে যেখানে জন্মেছে তার কয়েক ফুট দূরে মূল সড়কের ওপর আজও সেটা অবহেলা আর অনাদরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

যখন ছোট ছিল, লিও’র দাদী তাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে ছোট্ট সেই চার্চের সামনে নিয়ে যেতেন, হাত ধরে তাকে পাশের বেদীটা দেখাতেন, সেই সঙ্গে কুমারী মেরীর মূর্তি আর ফুলদানি। শহরের আর সব জিনিসের মতোই সেখানকার একটা গাছ এতসব পরিবর্তন, উন্নয়ন দেখে দেখে কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। এখানকার অনেকেরই মনে আছে পঁয়ষট্টি ফুট লম্বা এই ফার গাছটা একসময় তাদের বাবা রোপণ করেছিল। পপলার গাছটা লাগাবার কথা লিও’রও মনে আছে, সেটা এখন অনেক লম্বা, কোনও এক অক্টোবরে হাইস্কুল বিল্ডিংয়ের সামনে অন্যান্য গাছের উদ্দেশ্যে ওকে উৎসর্গ করা হয়। কিন্তু গাছের সেই সারি তার মনে আলাদা কোনও অনুভূতি জাগায় না। তবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চ্যাপেল পেরুবার সময় এমনটা হয় না। সেটা তাকে ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়, তখন সে ভেতরটা দেখবার জন্য লোহার গ্রিল বেয়ে উঁকি দিত। কিন্তু এখন এর ভেতরটা দেখতে তাকে কোনও সমস্যা পোহাতে হয় না। এখন সে আগের চেয়ে অনেক লম্বা। আর উপাসনালয়টা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি খাটো, গাদাগাদি আর এর অবয়বটাকে অনেক বেশি সুচালো বলে মনে হয়। হতে পারে এটা আগের চেয়ে অনেক বেশি একা। কিন্তু তার কাছে এখনও এটা সময় পরিমাপের একটা উপায় মাত্র।

বৃক্ষ ছাওয়া পথের একপাশে সে তার গাড়িটা থামায়, চ্যাপেল থেকে সেটা খুব বেশি দূরে নয়। দেখতে পায় সেটার সামনে ওরা ধাতব দুটা ময়লার পাত্র রেখেছে, আর চ্যাপেলের একপাশ নানা রকম পোস্টার আর ফ্লেয়ারে ঢাকা পড়ে আছে। এটা তাকে তার বাস্তবতা অটুট রাখার অনুভূতি, অথবা সে যা জানে বা পছন্দ করে সে সম্পর্কে সচেতন করে, খুব বুঝতে পারে অন্যদের থেকে তা অনেক আলাদা। সে পুরোপুরি নিশ্চিত চ্যাপেলের ভেতরকার ধর্মীয় চিত্রকর্ম, ফুলদানি, এবং কুমারী মেরীর নামাঙ্কিত জংধরা গ্রিল সম্পর্কে যদি সঙ্গী অন্য নাগরিকদের কাউকে জিজ্ঞেস করে—কয়েক হাজার জনকে—তাহলে তাদের কেউই তাকে সে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবে না। এমন কি, হতে পারে তার মাও এসবের কিছুই জানেন না। সে বুঝতে পারে, যে শহরটাতে সে জন্মেছে তাকে সে যেভাবে জানে বোঝে তা একেবারেই আলাদা। এখনও দূর থেকে বিচ্ছিন্ন সেই শহরটাকে সে খুব আবেগের সঙ্গে স্মরণ করে।

তার জন্মের সময়কার আশপাশের ঘরদোর সব হারিয়ে গেছে, তখন যে চ্যাপেলটার ভেতর দৃশ্য দেখবার জন্য সে বেয়ে উঠত সেসব ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, পুরাতন সেইসব পাথরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, এর সঙ্গে তার ছেলেবেলার ভালোবাসার মানুষদেরই কেবল মৃত্যু হয়নি, বলতে গেলে তার নিজের ভেতরটাও একপ্রকার মরে গেছে। নতুন প্রজন্ম ছোট্ট এই জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারবে না, জায়গাটার ইতিহাসের সঙ্গে যারা অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে রয়েছে—তাদের কোনও চিহ্ন এখানে থাকবে না, কেউ কখনও তাদের কথা মনে রাখবে না। নম্র, নামপরিচয়হীন, কিন্তু এই লোকগুলোই যেন সবসময় তাকে জড়িয়ে রয়েছে, যেমন করে তারা তার সমস্ত ভবিষ্যতকেও জড়িয়ে আছে। ছোট্ট চ্যাপেলটা যখন ধ্বংসস্তূপের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, সন্দেহ নেই কালে এর ভাগ্যেও সেই একই পরিণতি ঘটবে, তখন সেটাকে আরও বেশি একা বলে মনে হবে। আর কোনও কিছু জানান না দিয়েই শহরটাও তার আরও একটা ছোট অংশ হারাবে। সেই সঙ্গে হারাবে অনুভূতির খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ।

গোরস্থানটা তার মা বাবা এখন যেখানে থাকে সেখান থেকে আরও অনেক দূরে, এই হিসেবে বলা চলে যেখানে জন্মেছে সে এখন তার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে—পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে তার পরিবার সেই বাড়িটা ছেড়ে এসেছে। বৃক্ষ ছাওয়া পথের শেষে, মাইল খানেকের বেশি দূরে, রাস্তাটা বেঁকে গিয়ে নতুন একটা সড়কের সঙ্গে মিলেছে, সেখানেই মিউনিসিপ্যাল পানির-টাওয়ারের কাছাকাছি গোরস্থানটা অবস্থিত। বিশ্বের কতো জায়গাতে লিও ঘুরে বেড়িয়েছে, কত কত জায়গায় থেকেছে বা থাকবে এবং ইউরোপের কতোটা জুড়ে দাপড়ে বেরিয়েছে তাতে আসলে কিছু যায় আসে না, তারপরও তার পুরো জীবনটা আসলে এই হাঁটা পথটুকুর দূরত্বের মাঝেই রয়ে যাবে যেটা তার জন্মানোর জায়গা থেকে গোরস্থান পর্যন্ত গেছে। মাইল খানেক বা তারও বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত তাকে, ঠিক ক্রুশের স্টেশনের মতো ভোগান্তির আদর্শ একপথ পেরিয়ে যেতে হবে। গাছে ছাওয়া এই পথ আর যে জানালা দিয়ে জীবনে প্রথম সে বাইরে তাকিয়েছিল এখন ‘এখান থেকে ওখানে’ একটা মানসিক অনুভূতি বারবার তার মনের ভেতরে খেলে যেতে থাকে। ‘এখান থেকে ওখানে’ তার পুরোটা জীবন। বারান্দা থেকে হাত নেড়ে মা তাকে ডাকত। পথের মাঝামাঝি চলে আসার পরও দূর থেকে মা তার ওপর নজর রাখত এবং গ্রাম্য তরুণী মেয়ের মতো কর্কশ স্বরে ডেকে উঠত, পরের দশ দশটা বছরেও যার কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। তখনও সে একজন বালিকা যে কিনা সব সময় চিৎকার করে তার বোনদের ডাকতে ডাকতে তাদের বিশাল খামার বাড়ির এঘর থেকে ও ঘরে ছুটে বেড়াত, যেখানে সেও জন্মেছে। যখন অন্যান্য তরুণীরা একত্র হতো, তারাও সেই একই মুখভঙ্গি করত আর আগের মতোই হট্টগোল জুড়ে দিত। বিয়ের পর এই চার বোন আলাদা হয়ে যায় এবং ভিন্ন ভিন্ন শহর আর রাজধানীর ছোট্ট এপার্টমেন্টে বসবাস করতে থাকে, এবং এঘর থেকে ওঘরে চেঁচামেচি করে বেড়াতে থাকে যেন আগের মতোই তারা তখনও গ্রামেই বসবাস করছে।

রোববারের নৈশ ভোজের আগে, চার বোন শোবার ঘরের ভেতর একত্র হবার পর দল বেঁধে আয়নার সামনে জড়ো হতো আর নিজেদের গায় সুগন্ধি ছিটাত এবং একে অপরের কাপড় ঠিক করে দিত, ব্লাউজ আর মাথার স্কার্ফে গিঁট মেরে দিত, এর পুরোটা সময় তারা—কে কোথায় বাড়ি বানিয়েছে, কোথায় কে মারা গেছে, কে তার বউয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কে শহরের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছে, বাস ট্রেন, আঙ্গুর চাষ আর নাতিনাতনিদের নিয়ে—উত্তেজনাকর আলাপচারিতায় মেতে থাকত, লিও তখন এক কোণায় দাঁড়িয়ে জড়তা মেশানো কৌতূহলে দুষ্কর্মে ধরা পড়বার ভয় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। তাদের আরও কাছ থেকে দেখবার জন্য সে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করত। সে তাদের বিজড়িত কথাবার্তার কূলকিনারা বুঝতে চেষ্টা করত—গোপনে প্রায়ই সে কাজটা করত—তাদের কথাবার্তার ধরন, তুচ্ছ চেঁচামেচি, শাপশাপান্ত, ফুঁ-ফুঁৎকার, আর জাদুটোনার মতো প্রত্যেকের যখন তখন হাত নেড়ে ক্রস কাটা দেখত। কিভাবে ছোটদের ওপর বড়দের কর্তৃত্ব প্রকাশ পেত তা খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করত। ছোট দুজন আর বড় দুজনের মাঝে খুনসুটিটা সে বুঝতে পারত। অথবা হঠাৎ অন্য তিনজনের মাঝে কোনও কারণে জোট গড়ে উঠলে যেভাবে অন্যদের কাছে তাদের কেউ একজন একঘরে হয়ে পড়ত। আর এর সবই ঘটত উঁচু হিল, লোমের পোশাক, ন্যাপথালিনের গুলি, ফেইস পাউডার, কানের দুল, ফাউন্ডেশন ক্রিমের মতো তুচ্ছ সব জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ির কারণে, ষাট পেরিয়ে আসার পরও তারা পরিমিতভাবে সেসবের ব্যবহার শিখে উঠতে পারেনি। আর একে অন্যেরটা ধরতে গেলেই তাদের সবাই একযোগে দ্রুততর কর্কশ ভাষায় চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিত। শেষে হড়বড়ে চাহনিতে বোনেরা সবাই ঘরের এদিক সেদিক তাকাত আর আয়নার সামনে হাসিতে ফেটে পড়ত, এবং তারপর হঠাৎই চুপ মেরে যেত—এক কথায় বলতে গেলে, ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ত, সম্ভবত চার্চে যাবার আগপর্যন্ত রোববারের সকালগুলোতে তাদের ঘরে এমনই পরিবেশ বিরাজ করত, তারপর সবাই একসঙ্গে হুড়োহুড়ি করে গাড়িতে গিয়ে উঠত। এবং লাইন ধরে বেরোবার পর, আবারও সবাই এক এক করে বারবার সজোরে দরজা, জানালা আর কব্জাগুলো বন্ধ করত, কেননা সেগুলো ঠিকঠাক বন্ধ হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে তাদের কেউই কারও ওপর আস্থা রাখতে পারত না, তাই প্রত্যেকেই নিজের সন্তুষ্টির জন্য বিদ্রূপের হাসি হেসে আবারও সেগুলো খুলে তারপর ভালোভাবে বন্ধ করত, তারপর লিও সেই সারির শেষে গিয়ে যোগ দিত, এসময় সামান্য ঝুঁকে নীরবে হাঁটার ফাঁকে সে নিশ্চিত থাকত যেসব পুরুষেরা বিশ্বের সকল ক্ষমতা ধরে রেখেছে তা আসলে পুরুষদের নাগালে নেই বরং নারীদের হাতেই কুক্ষিগত। এইসব নারীদের দিকে সে খুব মনোযোগ সহকারে তাকায়, যারা ষাট পেরিয়ে এসেছে, এখনও তাদের মাঝ থেকে তারুণ্যের সব ধরনের তেজ ঠিকরে বেরুচ্ছে। তাদেরকে সে তাদের স্বামীদের কবর দিয়ে আসতে দেখেছে আর এখনও তারা অপ্রতিরোধ্যভাবে টিকে আছে, সময়ের তীর আর টান তাদের কাউকেই বিদ্ধ করতে পারেনি, কাউকে কখনওই হাসপাতালে যেতে হয়নি, বরং সব সময়ই দুর্বল আর অসুস্থ শরীরের অবসাদগ্রস্ত পুরুষদের সাহায্যের জন্য তৈরি থেকেছে।

যখনই সে নানুর সঙ্গে শহরের স্তম্ভের সারি ধরে তার মায়ের হেঁটে যাওয়া কল্পনা করে, তখন তার পরনে থাকে সুন্দর লোমের কোর্ট, আর সব সময়ই তার মুখে খুব বেশি মেকআপ এবং ফেইস পাউডার থাকে, অথবা যখন সে চার্চে তার মায়ের মুখে ‘আমেন’ শুনতে পায়, প্রতিবার তার মনে হয় সে যেন আবার সেই শৈশবে ফিরে এসেছে, তখন তার মনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আগের মতো আবারও ভয় খেলে যায়। মনে মনে সে প্রর্থনা করে গির্জার মাঝখানে যেন কোনও মোরগ ডেকে না ওঠে, বা এর চলাচলের পথের ওপর দিয়ে যেন কোনও ফিজনট দৌড়ে না যায়, কারণ যদি এমন কিছু একটা ঘটে তাহলে সে তার লোমের কোর্ট ছুড়ে ফেলে, স্কার্ট উঁচিয়ে, অথোর্পেডিক জুতা জোড়া টেনে খুলে, চার্চে আসা লোকেদের ভিড় ঠেলে ওর পিছু ধাওয়া করবে, আর ধরবার আগপর্যন্ত হাততালি দিয়ে চেঁচাতে থাকবে। আর সেটাকে পাকড়াও করবার পর, একগাল হেসে সেটার ঘাড় মটকে দিবে, বা দ্রুত মাথা বাকিয়ে মেরুদণ্ডটা ভেঙ্গে দিবে। তারপর সে চার্চের উপাসকদের মাঝে ফিরে গিয়ে বা চত্বরে ভিড় করে থাকা লোকেদের, সগর্বে তার বিজয়ের স্মারকটা দেখাতে থাকবে। লোকের ভিড়ে নিজের মাকে দেখার পর সব সময়ই তার মনে একইরকম ভয়ের অনুভূতি কাজ করে এবং সে বিচলিতভাবে চারপাশে তাকিয়ে, নিশ্চিত হতে চায় যেন হাতের কাছে কোনও অসহায় মুরগি ঘুরে না বেড়ায়। কেননা আজকে এত বছর পেরিয়ে যাবার পরও সে তার মায়ের মাঝে আগেকার সেই চাষার মেয়েকে দেখতে পায়। এবং হাজার হাজার মাইল দূর থেকে, যখনই সে কল্পনায় মায়ের কথা ভাবে, সব সময়ই সে নিজেকে একই কথা বলে, একটা কথাই শুধু মনে পড়ে: ‘অসহায়ের মতো দেখতে, চিরন্তন, সবচেয়ে সুন্দরী ইহুদি মেয়ে। ’

এবার সে লিফটে করে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কোনও কিছু বলে ওঠার আগেই তাড়াহুড়া করে তার ব্যাগগুলো নিতে চায়। সে আচমকা পিছিয়ে আসে: ‘এগুলো আমাকেই নিতে দাও, মা। ’

তারা এপার্টমেন্টে উঠে আসে। ভেতরে অন্ধকার, শুধু টেলিভিশনের নীলচে আলো বসার ঘরটাকে হালকা আলোকিত করে রেখেছে। তার বাবা আরাম চেয়ারে হেলান দিয়ে রিমোটকন্ট্রোল হাতে বিরসভাবে অবিরাম থ্রিলার আর মিনি সিরিজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। দুজন দুজনকে কেবল বেমানানভাবে একটা হ্যালো বলে, যেন দুজনেই খুব ভালো করে জানে তাদের জীবন এখন অনেক আলাদা। তার বাবা চেয়ার থেকে নেমে বাতি জ্বালায়। লিও তাকে বিরক্ত করতে চায় না বলে থামায়। রান্না ঘরে খাবার টেবিলের আধাআধি অংশে ছোট্ট একটা পরিষ্কার টেবিলক্লথ পাতা। তার ওপর এক বোল সালাদ আর খোলার জন্য একটা রেড ওয়াইনের বোতল রাখা আছে। তার মা স্টু গরম করছে। কোনও কথা না বলে তারা একে ওপরের দিকে তাকায়। পাশের ঘর থেকে গুলি আর পুলিশের গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। লিও এক হাত তার চুলের ভেতর গলিয়ে ভাবতে থাকে, শেষ যেবার দেখা হয়েছিল সেবারের চেয়ে তার মাকে অনেক বেশি নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। তখনই তাকে স্কার্ট ঠিক করতে দেখা যায়, অনেকটা আনমনা ভঙ্গিতে টেনে পাশটা ঠিক করে। হতে পারে তার ওজন খানিকটা বেড়েছে লিও সেটা বুঝতে পেরেছে জানলে সে খুব অবাক হবে। একসঙ্গে দুজনেই দুজনের দিকে তাকায় এবং চোখাচোখি হয়, এবং দুজনেই জিজ্ঞেস করে বসে: ‘সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো?’
লিও দ্রুত বলে: ‘আমার এখন ক্ষুধা নেই, মা। ’
কথাটা বলার জন্য মনে মনে খেদ অনুভব করে, কারণ এর মাধ্যমে সে বিশ্বজোড়া জঞ্জাল রেঁধে বেড়ানো লোকগুলোর আর সব সময় তার রেস্তোরাঁয় খেয়ে পেট ভরানোর ওপর তার মায়ের বিরক্তির কথাটা নতুন করে মনে করিয়ে দিল, তিনি একে কেবল অবমাননাকরই মনে করেন না, তার কাছে এসব অধর্মাচরণও—চাইনিজ রান্না। তোমার বাবা যেখানে কাজ করত সেখানে আমি ওসব চাইনিজ লোকেদের দেখেছি। একটা সেদ্ধ মাছ আর কয়েক পাউন্ড ভাত, সব একসঙ্গে মিশিয়ে রান্না করা হয়, নাড়িভুঁড়ি, রসুন, সুগন্ধিগুল্ম, একই পাত্রে প্রচুর পরিমাণে ফেলে, ঠিক যুদ্ধের সময়কার মতো, তখন ওরা সবাই হাত দিয়ে এক পাত্র থেকে খাবার তুলে খেত। তোমার রেস্টুরেন্টেও তোমার সঙ্গে এমনই করা হয়।

লিও হাসে, কেননা তার মায়ের রান্নাই আসলে সে মোটেই হজম করে উঠতে পারে না—তার নিজেদের জমি থেকে আসা খাবার। কিন্তু কথাটা সে জানায় না। সে এক গ্লাস ওয়াইন ঢালে এবং এক চুমুক পান করে। তরতাজা এই সুগন্ধি ওয়াইনের কথা ভাবতে তার সব সময়ই ভালো লাগে।

তার বাবা এমন একজন মানুষ জীবনে যে কখনওই সফল হতে পারেননি। খুব বেশি অর্থকড়ি তিনি বানাতে পারেননি। খুব একটা কথাও তিনি বলেন না। এখনও তিনি খুব ভোরে উঠে এপেনাইনস পাহাড়ি এলাকায় শিকারে যান। বা নিজের কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের দিকে ঘুরতে বের হন। অতিসম্প্রতি তিনি যা করেছেন, সেটা কমবেশি সবারই জানা, গ্রামের বাইরে, প্রাকৃতিক এক ঝরনার কাছে তিনি ছোট্ট একটা পাখির খোঁয়াড় বানিয়েছেন। প্রতিদিন তিনি মাছ আর পাখিদের জন্য খাবার তৈরি করেন—পাঁতিহাস, ময়ূর, ফিজন্ট, এবং মুরগির। মিশরের এক বন্ধু তাকে এক জোড়া ফ্লেমিঙ্গো উপহার দিয়েছে, আর যে জায়গাটাকে তিনি একগুঁয়ের মতন মরূদ্যান হিসেবে দাবি করেন সেখানে সেগুলো খুব সুন্দরভাবেই টিকে আছে। তিনি চান জোড় বেঁধে সেগুলো বাচ্চাকাচ্চা দিক, তারপর সেখান থেকে বড় একটা দল তৈরি করা যাবে। বন্ধুবান্ধব আর তাদের বউদের নিয়ে প্রায়ই সেখানে মাছ ধরা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বা ডজন খানেক মুরগি মেরে আগে থেকে বানানো চালার ভেতরে বসে সেসব রান্না করা হয়।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো রোববারটা তারা সেখানেই কাটাবে।

মহিলারা ময়দার তাল নিয়ে দলাইমলাই করে এবং ছোট ছোট পিণ্ড তৈরি করে তাতে পুর ভরে ভাজতে থাকে। পুরুষ বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে বড়শি দিয়ে বান, মাগুর, আর পার্চ জাতীয় মাছ মারে। প্রত্যেক মাসের শেষে দলটিতে দীর্ঘদিনের জীবন সঙ্গী হারানো আরও বেশি বিপত্নীক আর বিধবারা যোগ হতে থাকে। তবু সেই মরূদ্যানে একত্রে জড়ো হবার পর তাদের মাঝে মন খারাপ করবার মতো কোনও কিছুই আর ঠাঁই পেতে পারে না।

বেশ কয়েকটা পুকুর মিলেমিশে অত্যধিক বড় একটা জলাশয় তৈরি হয়ে তাতে সামান্য সংখ্যক মাছ আর তার আশপাশের বেশ কিছু সংখ্যক পশুপাখি জড়ো হবার কারণে জায়গাটাতে একটা বুনো পরিবেশ তৈরি হয়েছে মাত্র, তবে লিও বুঝতে পারে জায়গাটা তার বাবার খুব পছন্দের। এটা তার ব্যক্তিগত স্বর্গ, এমন একটা জায়গা যেখানে তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। সম্ভবত এটা তাকে তার ছোটবেলা আর আগেকার গ্রাম্য জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। আগেকার নির্জনতার কথা মনে করিয়ে দেয়। লিও তার বাবার সেই নিঃসঙ্গ, অমিশুক দিকটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তার ভেতরও সেই একই বোধ কাজ করে।

তারা দুজন এমন ধরনের পুরুষ একে অপরের সঙ্গে যাদের কোনও যোগাযোগ নেই, বা বিগত অন্তত বিশ বছর ধরে যারা একজন অপরজনকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি। তারা একজন অপরজনকে এড়িয়ে চলে। তাই বাইরে কোথাও গিয়ে পরস্পরের সাহচর্য খোঁজার প্রশ্নই উঠতে পারে না। একজন অন্যজনকে একবারের জন্যে কোনও কিছুই জিজ্ঞেস করে না। একজন অন্যজনের আয়না, লিও নিজেও সেটা জানে। তার বাবাও এ ব্যাপারে সচেতন হলে লিও বরং অবাকই হবে।

রাতের খাবারের পর রান্না ঘরে বসে সে তার মায়ের সঙ্গে আলাপ করে। তার প্রশ্ন ঠেকাতে, শহরে কী কী ঘটেছে সবকিছু এক এক করে জানতে চায়, কে কে বিয়ে করেছে, চুরি করতে গিয়ে কে ধরা পড়েছে, কার কার তালাক হয়ে গেছে, নতুন কে জন্মেছে। এর সবই জিজ্ঞেস করা কেবল তার মায়ের মুখের ছোট্ট একটা প্রশ্ন আটকাতে, তার দেখা বাকি বিশ্ব আর বউ নিয়ে তিনি যেন কিছু জানতে চাইবার সুযোগ না পান, তাই সে একের পর এক এলোমেলো গল্প আওড়াতে থাকে। শেষে তার মা বোতলটা টেবিল থেকে সরিয়ে রাখার আগপর্যন্ত সে মুখ টিপে হেসে হেসে চুপি চুপি নিজে থেকে গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে থাকে, এরপরও তার কথা বন্ধ হয় না, এবং তার স্পষ্ট উপেক্ষার চাহনির পরও সে তার দিকে স্থির চেয়ে থাকে। যে খবরগুলো তার কাছ থেকে জানা যায় সেসব তার জন্য স্বস্তিদায়ক। এমনকি তারা যখন ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রী এক বন্ধুকে নিয়ে কথা বলছিল, তার মা তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে মাথা ঝাঁকিয়ে এপ্রোনে চোখের জল মুছে, তখনও লিও তার মাঝে ‘শোকের’ কিছুই খুঁজে পায় না। যেন এর সবই শহুরে জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। জন্ম, মৃত্যু, আর লোকেদের বিচ্ছেদ, এর সবকিছু নিয়েই তারা সেখানকার যৌথ যাপনে অংশ নিচ্ছে। এইসব জীবনের মাঝে সব সময়ই আশার জন্য একটা ঘর ফাঁকা থাকে আর তাই সমাজ টিকে থাকে এবং ক্রমশ বদলায়। সবাই পেছনে সন্তান, বন্ধুবান্ধব আর সুখস্মৃতি রেখে যায়, আর শহুরে জীবনের প্রতি ইঞ্চি সময় এইসব গভীর বন্ধন আর অনুভূতি দিয়ে গড়া। লিও তার মায়ের দুঃখটা বুঝতে পারে, আর খালা ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যাবার সময় তার ভেতর যে উৎসাহটা কাজ করে তাও টের পায়, তার কাছে সে এমনভাবে ফেরি বোটের কেবিনের বর্ণনা দেন যেন লিও সেসব কখনওই চোখে দেখেনি বা কোন গ্র্যান্ড হোটেলের লাউঞ্জের কথা বলেন যার ভেতর বোধ হয় লিও কখনওই পা ফেলেনি। সবকিছু বুঝতে পারলেও সে ক্ষোভ বা আনন্দ এর কোনওটাই অনুভব করতে পারে না। এর কোনওটাই তার জীবনের অংশ নয়, এমন একটা জীবনে কখনওই তার পা ফেলার মতো জায়গা হবে না। কেবল শুনে হাসতে পারবে আর সেই শূন্যতা অনুভব করতে পারবে। জীবনে কখনও তার নিজ শহরের লোকেদের ভালো বা মন্দ সামনাসামনি উপভোগ করার সুযোগ হয়নি। নিজের মাকে দেখে দেখে সেসব সে উপভোগ করে। যে গল্পগুলো তাকে হাসাচ্ছে কাঁদাচ্ছে সে সেসব উপভোগ করে। কিন্তু অতি তুচ্ছ কিছু একটা যেন তার মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে। যেন খুব দূর থেকে বসে সে শহরটাকে দেখছে। যখনই তার ভাবনার মাঝে নিজের দুঃখগুলো উঁকি দেয়, আবারও সে ভয় আর হতাশা অনুভব করতে থাকে। কারণ সে জানে এই নাটকটা তার নিজের, এবং তার একার। সে জানে, সামনের বছরগুলোতে, কেউই তার বিগত ভালোবাসাকে মনে রাখবে না, কাঁধে হাত রেখে বলবে না সব কিছুরই আসলে শেষ আছে। শহরের এই নিজ বাড়িতে বসে মূল সড়কের সকালগুলো তার আর দেখা হবে না। অন্যদের চোখে তার বেদনার প্রতিবিম্ব সে দেখতে পাবে না। কারও সঙ্গে সে আর হাত মেলাবে না বা কাউকে জড়িয়ে ধরবে না। এবং কেউই আর কবরস্থানে গিয়ে টমাসের সঙ্গে দিবে না, এমনকি সেও। সে এও বুঝতে পারে, লোকটা এখন অন্য এক শহরের বাসিন্দা। একটা আলাদা জগতের অংশ, সত্যি বলতে, এখন সে যেখানে অবস্থান করছে সেখানকার সব দুঃখ আর আনন্দ অন্যসব শহরের সমান্তরাল। সে জানে অন্য জগতে চলে যাওয়া সেইসব লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ খুবই কঠিন। বাইরে গিয়ে আন্তরিকভাবে অন্যদের সঙ্গে দেখা করে, লিও ভিন্ন আর দূরবর্তী এই জগতকে এক করবার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা তার কাছে অসম্ভবই ঠেকে। জানা সবকিছুর মাধ্যমে চেষ্টা করলেও সেটা অসম্ভবই থেকে যাবে। হয়ত ভবিষ্যতে কখনও সেটা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু সে দিন আসতে এখনও অনেক বাকি। ভবিষ্যতে যারা জন্মাবে তারা অন্য কোনও উপায়ে ভিন্ন জগতে চলে যাওয়া আগেকার লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। ঘটনাক্রমে, একসময় এমন কেউ একজন আসবে যার কাছে ‘লিও এবং টমাসের স্মৃতি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে এবং তা জীবনদায়ী আর আশাব্যঞ্জক কোনও কিছুর মতো সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু তার আগে সেই সময়টাকে আসতে হবে। হতে পারে শত বছরের আগে সেটা সম্ভব নয়। যে ঘরটাতে সে বিশ বছর ধরে বসবাস করছে অনেক দিক থেকেই সেটা আর আগের মতো নেই। তারপরও সেটা তার শোবার ঘরই রয়ে গেছে, আগেকার সেই পুরাতন বিছানা, সাদা লেখার টেবিল আর দেয়ালের সঙ্গে সাঁটা পেপারব্যাক আর স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বইতে ঠাসা সেই একই সেলফ। কিন্তু তারপরও সেটা সেই আগেকার ঘর নয়। এর চার দেয়ালের মাঝে এখন আর লিও নামের কেউ থাকে না। এর মাঝে এখন যা কিছু রয়েছে তার সবই অতীতের অতৃপ্তির স্মারক বা অর্থহীন অবশেষ, সবই এখন জীবনহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

এটা এখন জাদুঘরের শোকেসে রাখা পাঠযোগ্য কোনও পাণ্ডুলিপির মতন। দেয়ালের এখানে সেখানে স্নিকার, আর লেভি জিনসের প্রচারণার পোস্টার ঝুলছে, পাইরেটেড রেডিও স্টেশনের মতো কেন্দ্রীয় সিটি রেডিও, এন্টি-রেডিও রক স্টেশন এবং ওয়ার্ল্ড রেডিও সেই শ্লোগান, ‘মারিজুয়ানা চলবে’ এবং ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার চাই না’ লেখা স্টিকার আর সেই নীলচে সবুজাভ প্রতীকসহ ডলোমাইট রঙের হলদে ইঁদুরের সুপারস্কি টিকেট ‘একটিভ জেজেন বেরুফসভেরবটি!’ ডব্লিউডব্লিউ পাণ্ডা এখনও দরজায় সাঁটা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। স্টেরিও রেকর্ডারের ওপর থেকে এখনও তার সাদা কালো একটা ছবি তাকিয়ে রয়েছে, আর রেকর্ডারের কাছে এখনও তার লিওনার্দো কোহেন, নিনা সিমনে, টিম বুকক্লে, ক্যাট স্টেভেনস এবং নেইল ইয়াংয়ের অ্যালবামগুলো মায়ের রাখা এডিথ পিয়াফ এবং লুসিয়ানো পাভারোট্টির অ্যালবামগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে আছে। কোণার দিকে একটা ঘন রঙের কাঠের আসবাবের ভেতর একটা সেলাই মেশিন রাখা। ওয়ারড্রবের উল্টোদিকে বড় একটা আয়রন-বোর্ড হেলান দিয়ে রাখা। আর ডেস্কের নিচে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার।

ঘরের যাবতীয় যন্ত্রপাতিও তার ঘরে এসে ঢুকেছে। আর ঘরটা এখন আগের মতো নেই, বদলে গেছে। প্রতিবার যখনই সে বাড়ি ফিরে আসে সবকিছু নতুন অবস্থায় দেখতে পায়, অবশ্য শেষে সবকিছু একেবারে গায়েব হয়ে যায়। চারপাশের দেয়ালের কোথাও আর তার সেই ক্যাবারে এবং স্ট্রু ডগসের পোস্টারগুলো নেই, সম্ভবত পুরাতন কাগজের বাস্কেটে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। ১৯৭৩ এর ইতালিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভেলের ছবিগুলোও হাওয়া হয়ে গেছে, একইভাবে তার বন্ধুবান্ধবদের ছবিগুলোও। এক সময় বিছানার পাশে কর্ক বোর্ডের ওপর পিন দিয়ে সাঁটা ক্লেস ওল্ডেনবার্গ আর ইভেস ক্লেইনের ছবিগুলোও নেই। এই সময়ের মাঝে দেয়ালের রঙও বদলেছে। আগে তা খুব হালকা ছিল, একেবারে স্বচ্ছ সবুজাভ। এখন সেগুলো উজ্জ্বল হলদে।

তার ঘরটা ছোট্ট একটা বাক্স পেটরার ঘরে পরিণত হয়েছে। ভেতর থেকে দেখলে, ঘরটাকে ঝাড়ু রাখার ছোট একটা কক্ষ বলেই মনে হবে, এখানে বসেই সে তার প্রথম শব্দগুলো লিখেছে, ডায়রি লিখেছে, ডিগ্রির জন্য রচনা লিখেছে, তার প্রথম বইটাও এখান থেকেই লেখা।

লেখার সময় বেলকনি দিয়ে সে দূর পাহাড় চূড়ার নিচে শহরের মিটি মিটি আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। বাইরে, যখন চলমান জীবনের কতশত ঘটনা ঘটে চলছিল, আর তখন এই সাততলার ওপর, শোচনীয়ভাবে তার ছেলেবেলাটা কেটেছে, সেসব নিয়ে সে কেবল স্বপ্নই দেখে গেছে আর বর্ণনায় তুলে ধরেছে। ঘটনার ঘূর্ণির মতো একবার থেকে অন্যবারে আর ডিসকো পার্টিতে লোকেদের নাচ গান কল্পনা করেছে। স্বপ্নের মাঝে এক ঝলক দেখতে পাওয়া কোনও রাতের শহরের মতো সেসবের বর্ণনা তুলে ধরেছে, যেখানে সবাই বিয়ে থা করছে আর জবড়জং সাজ পোশাকে সেজে আনন্দ করতে করতে গাড়িতে চেপে সমতলের ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে ধেয়ে যাচ্ছে। এখন সে সেই টেবিলের পাশে বসে রয়েছে, আগে সব সময় যেখানটাতে বসত। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবার জন্য তাকে স্টিম আয়রন আর ডিস্টিল ওয়াটারের কয়েকটা বোতল সরিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু তারপরও কিছুই দেখতে পায় না। সে ভারী কাঠের শাটারটা সরাতে চেষ্টা করে, কিন্তু তাতেও কোনও লাভ হয় না। আধাআধি গিয়ে সেটা গিলোটিন ব্লেডের মতো তীর্যকভাবে আটকে যায়।

শেষবার যে বইগুলো সে রেখে গিয়েছিল সেগুলো এখনও টেবিলের পাশেই রয়েছে। এই ঘরে বসেই একবার কেবল বইগুলো পড়তে পেরেছিল। এন্টোনিও ডেলফিনি আর সিলভিও ড’আরজোর লেখা বই। বেলকনি থেকে সে যেখানটায় জন্মেছিল, মাইল খানেক দূরের সেই জায়গাটা দেখতে পায়। তার বইগুলোতেই কেবল সে ভিন্ন এক ধরনের পাগলামি, একঘেয়েমি আর একাকীত্বের সন্ধান পায় যার সঙ্গে তার দেশের স্থানীয় লোকেদের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু সে সেইসব জীবন্ত, মুক্ত, হাসিখুশি, আর ভোগাসক্ত লোকেদের বর্ণনা পড়তে পড়তে মনে মনে বিরক্ত বোধ করে। মানুষের চরিত্রের লুকানো দিকগুলোই এখন তাকে বেশি টানে, অন্ধকারাচ্ছন্ন যে দিকটার জন্য লোকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, একে অপরের মাথা ফাটায়, আস্ত গ্রামসুদ্ধ লোকেদের বোকা বানায়। কেবল এই দুজন লেখকের লেখাতেই, তাদের ভিন্ন আঙ্গিকের মাঝে, সে নির্দিষ্ট ধরনের এমিলিয়ান চরিত্রের দুর্ভেদ্যতার খোঁজ পায়, নির্দিষ্ট সেই ভাবলেশহীনতা, সেই খামখেয়ালিপনা, পাগলপারা একাকীত্ব এখন সে কেবল তার বাবা আর নিজের মাঝেই দেখতে পাচ্ছে। কাপড় চোপর ছেড়ে সে বিছানায় যায়। ডেলফিনির বইগুলোর একটি খুলে পড়তে শুরু করে: ‘কখনও আমরা এই বিপর্যয়গ্রস্ত পৃথিবীতে এবং সময়ের অনুকম্পাহীন পথ চলার মাঝে, মানুষের দিন যাপনে—বিলাপ এবং অশুভ ইচ্ছে, হতাশা এবং নাছোড়বান্দা আশা, তিক্ত আকাঙ্ক্ষার দেখ পাই তখন অসম্ভব ত্যাগের ভালোবাসা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়; তখন আমরা বলে উঠি...’

আবারও তার জীবনে আগেকার সময়গুলো ফিরে আসে, আবারও সে আগের মতো খানিকটা আগেভাগেই শুতে যায়, অনেক দিন আগে যেভাবে বিছানায় যেত।

___________________________________

পিয়ের ভিট্টরিও তনদেল্লি (Pier Vittorio Tondelli)
___________________________________

ইতালিয়ান লেখক পিয়ের ভিট্টরিও তনদেল্লি ১৯৫৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর, ইতালির ছোট্ট শহর করেগিও’র এমিলিয়া-রোম্যাগনা এলাকাতে জন্মগ্রহণ করেন। বয়ঃসন্ধিকালে সাহিত্য পাঠে তিনি সমবয়সীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেও বয়স বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে তাতে আমূল পরিবর্তন আসে। যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় ষোল বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাসে, এতে তিনি বয়ঃসন্ধিকালের হতাশা, বিশ্বাসের পরিবর্তন এবং সমকামিতার প্রতি আগ্রহ ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৯৪৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে তনদেল্লি বোলগানা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিউজিক এবং পারফর্মিং আর্টের ওপর অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে ইতালির বিখ্যাত দুজন শিক্ষক ও লেখক উমবের্টো একো এবং ঘিয়ান্নি সেলাটি’র অধীনে পাঠ নেবার সুযোগ পান। ১৯৭৯-তে তিনি এলডো ত্যাগলিয়াফেরি’র কাছে একটি পাণ্ডুলিপি পাঠান। তার কাছ থেকে লেখালেখি বিষয়ে শিখে এবং দিক নির্দেশনা পেয়ে তরুণ লেখক হিসেবে নতুন উদ্যমে লিখতে শুরু করেন এবং আগের একটি কাজ পুনর্লিখনে অনুপ্রেরিত হন। এর এক বছর পর ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে তার আদার লিবার্টিনি উপন্যাসটি ছাপা হয়। একই বছর তিনি বোলগানা থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। সেবছর এপ্রিলে তিনি সেনাবাহিনীর ডাকে সাড়া দিয়ে বাধ্যতামূলক কাজে যোগ দেন এবং দায়িত্ব পালনে প্রথমে ওরভিয়েটো এবং পরে রোমে গমন করেন। সামরিক বাহিনীর চাকুরির এই অভিজ্ঞতা তাকে দ্যা ডায়রি অব আ সোলজার এবং এক্কি পো পো উপন্যাস দুটি লেখার অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করে। খুব কম লিখলেও, তার কাজ যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। লেখালেখিতে যথেষ্ট সফলতার মুখ দেখলেও, বিষয় হিসেবে সমকামিতাকে বেছে নেয়ায় প্রায়ই তাকে সেন্সরসহ আরও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তিনি ইতালির পোস্টমর্ডান সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আল্টরি লিবেরটিনি, সেপারেট রুমস, প্যাও প্যাও: রোমান তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের নাম। ডিনার পার্টি তার লেখা একটি বহুল আলোচিত নাটক। তানদেল্লির বেশ কিছু উপন্যাস, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধসহ আরও বেশ কিছু লেখালেখি নিয়ে সিমন অ্যান্ড স্চুস্টার দুটি খণ্ড প্রকাশ করে। মরণ ব্যাধি এইডসে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৯১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ইতালির রেগিও এমিলিয়ায় মৃত্যু বরণ করেন। করেগিও’র বাইরে হেমলেট অব ক্যানোলোর ছোট্ট এক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।



বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।