ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ | সালেহা চৌধুরী

বুক রিভিউ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৫
আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ | সালেহা চৌধুরী

গল্পগ্রন্থ : আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ। লেখক : মোজাফ্ফর হোসেন।

রাত্রি প্রকাশনী । প্রকাশ ২০১৩, বইমেলা। দাম ১৬০ টাকা।

আমি এই তরুণ লেখককে জানতাম না। অল্পদিন হলো তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি তাঁর লেখা একটি বই আমাকে পড়তে দিয়েছেন। সমালোচনা ঠিক নয় আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছি।

প্রথমেই আমি আমার প্রিয় লেখক হাসান আজিজুল হকের মন্তব্য তুলে ধরছি, ‘একেবারেই নতুন ধাঁচের গল্প। কথাবস্তু চিরকাল নির্মাণ-নবীন লেখকের উপযুক্ত। পরিপক্ক পূর্ণ সম্পন্ন, একই সঙ্গে সবুজ আর কাঁচা। গল্পহীন গল্পবলার ঝোঁক। ’

এখানে তাহলে যে কথা উঠে আসছে সে হলো গল্পহীন গল্প। যে রীতি এখনকার অনেক লেখকের। পড়বার পর মনে হয় গল্প কোথায়? তবে মোজাফফরের সব গল্প নিয়ে এমন কথা বলা যাবে না। কিছু গল্প নিয়ে অবশ্যই। বর্তমান যুগে এটাও একটি শৈলী—গল্পহীন গল্প। কথা যেখানে প্রধান।

কিছু লেখা মোটা কলমের নিবে আবার কিছু লেখা সরু নিবে। কুড়িটি গল্প আছে ১২৮ পাতায়। গল্পের আকার ছোট। এখানে ভাষা ভালো, ম্যাজিক রিয়ালিজমের ছাপ, পরাবাস্তবতা এসবও আছে। আবার আছে সব কিছু না-বলার ঘেরাটোপ। অনেক সময় পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া—তোমাদের কী মনে হয়? আমার যা মনে হয়েছে তা বলবার আগে ওর নিজের লেখা সম্বন্ধে নিজের মন্তব্য বলছি। ‘সমস্ত গল্পের যে বাস্তবতা তা খানিকটা আমার দেখা, খানিকটা কল্পনা। খানিকটা আমার যাপিত, খানিকটা অযাপিত। গল্পের মধ্যে দিয়ে আমার মতো করে একটি বক্তব্য তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। আর কিছু গল্প লিখেছি মনের আনন্দে। গল্পটা সেখানে প্রধান নয়, মুডটাই আসল। চেষ্টা করেছি ফর্ম ও ফ্যাক্ট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। ’

তাহলে তাঁর কথা এমন—যে বাস্তবতা তিনি এঁকেছেন তার সবটা চোখের দেখা নয়, কল্পনা। একটি বক্তব্য আছে। আবার কখনো মনের আনন্দে লেখা।

প্রথম গল্প ‘পুনরুত্থানে’ আছে তেমনি কোনো বাস্তবতা। কী হয় যদি কোনো মানুষ কবর থেকে উঠে আসে। কেন উঠে আসবে বা কী কারণে ওঠে আসবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেবল ওঠে আসার পর কী ঘটছে সেটা নিয়েই হৈচৈ। ঠিক এমন একটি গল্প আছে হুমায়ূন আহমেদের। এমন মিল অস্বাভাবিক নয়। আমরা যখন লিখি মনে রাখতে হবে সেই গল্প একেবারে আনকোরা নয়, আগেও এমন গল্প লেখা হয়েছে। মার্কেজের কথা—একটি মহৎ গ্রন্থ আর একটি গ্রন্থের জন্ম দেয়। ‘গতকাল মধ্যরাতে কবর থেকে উঠে এসেছেন রহমান’—এবং এই ভাবেই গল্প এগিয়ে গেছে। রহমান যে উঠে আসবে সেইটি লেখক জানতেন কারণ রহমান কোনোখানেই বেশিদিন টিকতে পারেন না।

এরপর যা হচ্ছে, রহমান হয়ে গেছেন হযরত রহমান। যে পুকুরে তিনি ডুব দিয়েছেন বলে ধারণা তার পানিও বিক্রি হচ্ছে। এবং প্রশাসন বিভাগ এসেছেন সে পানির উপর ভ্যাট বসাতে। মজার ব্যাপার। তিনি বলতে চান  সে হয়ত এই—আমরা যা জানি তার বাইরে কিছু হলেই সেটা অলৌকিক হয়ে যায়। আমরা আর কোনো ব্যাখ্যা পছন্দ করি না। ভালো গল্প। এবং শেষমেষ দেখা হলো উত্তমপুরুষের স্ত্রীও রহমানের ফুঁ দেওয়া পানিপড়া খেয়ে ব্যথা বেদনা সারিয়ে ফেলছেন যদিও সেই পানিতে রহমান ফুঁ দেয়নি, দিয়েছেন উত্তমপুরুষ।

‘মিডিয়া ভার্সেস নো বডি’ এমনি আর একটি গল্প। লেখক মারা গেছেন ভেবে তাঁকে নিয়ে যা শুরু হয়েছে তার শেষ নেই। লেখক আসলে মারা যাননি। কোনো এ্যাকসিডেন্টে তিনি মারা যাননি। কারণ আগের স্টপে তিনি নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু বিকৃত লাশের কোনো একজন তিনি ভেবে হৈচৈ। যে সম্মান তিনি বেঁচে থাকতে পাননি, এখন সেই সম্মান তিনি পেতে শুরু করেছেন। মরণোত্তর ব্যাপারই এমন। আমরা অনেককে জানি যারা মরণোত্তর পাবার সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন তাদের অনেক আগেই পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। যদি সেই মরণোত্তর জেগে ওঠেন তাহলে কী হবে। গল্পটি ফার্স বা প্রহসন আমাদের জানা। আর একটি দুই পাতার ছোটগল্প ‘ছায়া ছিনতাই’ বেশ ভাবায়। কারণ যে ছায়া আমার সেকি কেবল আমার? নাকি এ ছায়া আর কারো। আয়নায় যে মুখ আমি দেখি, আমি কি তাকে সব সময় চিনি। এটি মিনি গল্প। বড় গল্প হয়ে উঠবার সম্ভাবনা আছে।

‘ট্রিটমেন্ট’ পড়তে গিয়ে আমার মনে পড়ল ‘গোয়েবলসিয়ান লাই’ বলতে যা বোঝে সকলে। হিটলারের ইয়েসম্যান গোয়েবলস বলতেন—একটি মিথ্যাকে কমসে কম একশবার বলবে, তাহলে তা সত্য হয়ে যাবে। এখানেও তাই হয়েছে। প্রথম একজন বলল—সফেলা বেশ্যা। তারপর সকলে বলে ফেলল। এবং সফেলা বেশ্যা, এটাই সাব্যস্ত হলো। এবং এরপর সে বলা থেকে তার বিচার হলো। এবং বিচারে যা হবার তাই হলো। সফেলার মৃত্যুর একমাস যেতে না যেতে আর একজন বলল—আকলির মা বেশ্যা। এরপর যা হবে, সে এই একশবার বা তার চেয়ে বেশিবার একই কথা বলতে বলতে, তারও একদিন বিচার হবে। আকলির মায়ের পর আর একজন। এসব গল্প অল্প সময়ের জন্যে হলেও আমাদের ভাবায়।

‘লেখকের মৃত্যু’ এই গ্রন্থের একটি বড় গল্প। মজার গল্প। যেখানে চরিত্রগুলো তাঁর সঙ্গে কথা বলে। যখন তাঁদের লেখক আঁকেন ওরা মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করে। কিন্তু তিনি নিজের মতো করে আঁকেন। একবার কুদ্দুস নামে একটি চরিত্র প্রতিবাদ করে বলেছিল তাঁকে, ‘সবাই চেনে আপনার উপন্যাসের কুদ্দুসকে। সবাই জানে নীল আকাশ দেখলে কুদ্দুসের খাওন লাগে না। কিন্তু ভুখ যে আমারে শ্যাষ কইরা দিল। আপনি ম্যালা পুরস্কার, টাকা পাইলেন কিন্তু আমার তো কিছুই হইল না, আমি রাস্তার কুদ্দুস রাস্তায়-ই-থ্যাইকা গেলাম। ’ আশাকরি কুদ্দুসের এই আক্ষেপের ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই।

একটি নদীর গল্প পড়তে পড়তে আমি ভেবেছি ডিলোন টমাসের গল্প—দাদার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া বা ‘ভিজিট টু গ্রান পা’। সেই গল্পটির সঙ্গে নদীর গল্পের বেশ মিল। যে  নদীর ওপারে থাকে আর এক জগৎ। নদীটা কল্পনা কিন্তু যে কল্পনা করছে তার কাছে সত্য।

এমনি ভাবে প্রতিটি গল্পই আমাদের একটা না একটা কিছু বলতে চায়। তবে যেসব নিজের খেয়ালে লিখেছেন বলে দাবি করেন সেগুলো যখন পাঠকের সামনে তুলে ধরেন তখন একটু দায়বদ্ধতা এসে যায়। যেমন তেমন করে নিজের জন্য লেখায় আর একটু ঘষামাজার প্রয়োজন হয়। সেইটি মনে রেখে নিজের এলোমেলো ভাবনাকে আর একটু গোছাতে বলি।

অনেক ভালোলাগা পঙক্তির একটি—আল্লাহ আর ভগবান এক আকাশেই থাকেন, সমস্যা যত মাটিতে।

আর একটি পঙক্তি এমন—দেবতারা মৃত্যুহীন, অভিশপ্ত।

মোজাফফর আহমদের লেখার শুরু। ভালোভাবেই শুরু হয়েছে বলতে হবে। আর একটু পরিশ্রম, আর একটু চিন্তা, আর একটু আলস্যমুক্ত হয়ে আর একটু বড়গল্প তিনি আমাদের উপহার দেবেন আশা করছি। একদিন তিনি গল্পকারের জগতে চিরস্থায়ী আসন করতে পারবেন বলে আমার ধারণা।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৬ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।