ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

পালকের ব্লাউজ | শিপা সুলতানা

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৫ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৫
পালকের ব্লাউজ | শিপা সুলতানা

বুলবুলির পুচ্ছের লাল একগাছি রোম গেঁথেছিল জুনিয়া গাছের কাঁটার আগায়, হাত বাড়িয়ে অতি সাবধানে পালকগাছা অক্ষত তুলে আনে কমল। বামহাতের মুঠোর ভেতর শালিকের তিনগাছা পালক, বশিরদের শিমুল গাছের আগা থেকে কুঠা দিয়ে নামানো তোতাপাখির ডানার একগাছা, বিমানদা’দের লিচুগাছের খোড়ল থেকে কাঠঠোকরা পাখির লেজের আরেকগাছা, দক্ষিণপাড়ার ছয় চৌধুরীদের আমবাগান থেকে কুড়ানো মুনিয়া পাখির বুকের নরম দুইগাছা পালক মুঠো করে ধরা, সারা পাহাড় ঘুরে ঘুরেও একগাছা ময়ূরের পালক পেল না সে! লাল রোমখানি আলতো করে বুকপকেটে রাখে কমল, পালকগুচ্ছের মাথায় লাল রোম গাছা রিবনের মতো বেঁধে দিলে কেমন করে যে জ্বলে উঠবে আফিয়া!

ছড়ার পানি এক লাফে পেরিয়ে পাহাড়ে উঠতে গিয়েও ফের এপারে ফিরে আসে কমল, ছড়ার কাছ ঘেঁষে কাঁকড়া-ছুবার গোড়ায় ধবল সাদা একটি নুড়ি পাথর, ছোটবেলায় তারা বলত দুধপাথর, পালকের গুচ্ছ সাবধানে রেখে পাথরটি তুলে আনে সে, তারপর উরুর কাছে লুঙ্গিতে মুছে কোমরের ভাঁজে লুকিয়ে রাখে, এখন দুপুরের আগে আগেই যদি কোণাকুণি মেরে উত্তরপাড়ার গোরস্থানে যাওয়া যায়, দু’একগাছা ডাহুকের পালক পেলে পেয়েও যেতে পারে।



-তুমি হাসর ফৈড় দিয়া কিতা করতায় আফিয়া?
-জমাইতাম, জমাইয়া একটা ব্লাউজ বানাইতাম, আর হুনো কমল ভাই, তুমার সবতাত কেনে অত আগ্রহ? খালি বেটিনতর মাতো থাকো, বাড়িত যাও!
বাড়িত যাও বললেও রেশমি রুমালের ওপর সুপারগ্লো দিয়ে কাঁচপাথর বসাতে থাকে আফিয়া।
-আমি তুমারে হাসর ফৈড় আনিয়া দিমু আফিয়া, তুমি ফৈড়র ব্লাউজ বানাইবায়।
-পাগল!

পাখির পালক খুঁজতে পাহাড়ে বেরিয়ে ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষায় বসা হলো না আজ, এইসব বৈষয়িক বিষয়আশয় কত আসবে যাবে, আফিয়া একটা শখ করেছে এটাই বড় কথা। পাথরটি কোমরে ঠিকঠাক গুঁজে আবার ছড়ার পানিতে উবু হয় কমল, সাদা বলির ওপর এক গাছা বালিগড়া মাছ রোদ মাথায় দুপুরের ঘুম সেরে নিচ্ছে, অদূরে এক ঝাঁক ডানকিনে মাছের ছানাপোনা ডুব সাঁতার ডুব সাঁতার খেলছে, আরেকটু দূর খাবারদাবারের প্রতি প্রবল অনীহা দেখিয়ে লুকটি বনের মাথায় বসে আছে এক কিশোরী মাছরাঙ্গা। কমল ঝুঁকে এক আজলা পানি মাথায় দেয়, আফিয়া সাঁতার শিখেছিল তার কাছে, ‘কমল ভাই, দেখিও আমারে ছাড়িও না, ছাড়লে আমি ডুবি যাইমু!’ আফিয়ার ছোটো চাচা হাল ছেড়ে দিলেন, এত বয়সে বোকা ছাড়া কেউ সাঁতার শিখে! কমল যেন আফিয়াকে পেয়ে গেল, বিবিজি পুকুর ঘাটে সুপারি কুঠনি নিয়ে বসতেন আর রাজবাড়ির রাজহংসীর মতো তার বুকের কাছে সাঁতার কাটত আফিয়া। বিবিজি বলতেন, ‘ও বইন, পানি থাকি উঠিয়া আও। ’
কমল আর এক আঁজলা পানি তুলে মুখে দেয়, অনেকক্ষণ ধরে দূরে কোথাও থেকে একটা কাঠঠুকরার ঘর বানানোর শব্দ আসছিল, কমল আন্দাজ করে সেটা কতদূর!

-আফিয়া, তুমার লাগি পিঙ্গলা পাহাড়র মাথাত ঘর বানাইমু, বটর ডালে কাঠর ঘর, দিন রাইত তুমি আর আমি কাঠর ঘরও বইয়া আসমান আর আসমান দেখমু!
-কেনে? মাটিয়ে তুমারে তার উপরে আর জায়গা দের নায় নি?
-তুমারে লইয়া মাটিত ঘর বানতে মন চায় না, তুমি মাটিত বাস করার মানুষ নি!
-কিতা যে কও পাগলর লাখান! বাড়িত যাও কমল ভাই।

পুবের কুঠে তুকমা বন পেঁকে উঠেছে, বাড়ির ছেলেমেয়েরা যার যার কাস্তে আর ডালা নিয়ে ঢুকেছে বনের ভেতর, আফিয়াও তার ভাগের তুকমা ডাল কেটে এনে কমলের পায়ের কাছের ডালায় রাখছিল, রেখেই আবার ঢুকে যাচ্ছে বনে, পাঁকা তুকমা খোসা থেকে বেরিয়ে যেন জড়িয়ে ধরেছে আফিয়ার জামা, রেশম চুল, ঠোঁটের পাশে দেখো কেমন তিলের মতো কামড়ে আছে একটি কালো বিচি! তুচ্ছ একটি তুকমা বিচিরও কী ভাগ্য!

-আমি তোড়া কাটিয়া দেই আফিয়া? তুমারতো গরম লাগি যার।
-চুপচাপ যেখানো আছ, বই থাকো, তাইন আমারে হেল্প করতা!
ফের বনের ভেতর ঢুকে যায় আফিয়া, কমলও ওঠে, ‘দা দেও আফিয়া, তুমি গাছর তলে গিয়া বও। ’
-চকুর সামনে থাকি যাও চাই কমল ভাই, আর হুনো, সারাদিন খালি পিছে পিছে ঘুরো কেনে? মানষে দেখলে কিতা কইবো?

তুকমা কাঁটা মাথায় ওঠে আফিয়ার, হাত ভারী হয়ে আসে, বনের ভেতর পা ছড়িয়ে বসে, কমল ভাই সামনে এসে ঘুরঘুর করলেও ভালো লাগে না, আবার হোস্টেল থেকে কোনো এক শুক্রবারে যদি বাড়ি আসে না, সারা স্বর্ণপাশা গ্রামখানি যেন বিদ্রূপ করে তাকে নিয়ে, কমল ভাইও যতই যাও যাও বলে, তার যেন কানে তালা, দেখো কেমন হাসি হাসি মুখ করে কাঁঠাল গাছের গোঁড়ায় বসে আছে, ডাল কাটা শেষ হলে ডালা বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে, বারান্দায় বসে বিবিজির কুঠনি থেকে কুঠা সুপারি খেতে খেতে তার ডাল ঝাড়া থেকে বয়ামে ভরা পর্যন্ত চোখের নজর সরাবে না।

-তুমি ইখান থাকি যাও, হাতের চিকন রামদা খানা শক্ত মাটির উপর ঠুকতে থাকে আফিয়া।
-তুমি আমার লগে ইতা করো কেনে? আমার ভিতর পুড়ি যায়, আমিতো তুমারে ছাতাইয়ার না, বই থাকছি, তুমি তুমার কাম করো।

কমলের ভেতরটা যেন বনপোড়া শালকাঠের মতো চড়াত চড়াত করে ফাটতে থাকে। বাড়ি আসা, সেটাতো শুধু আফিয়ার জন্য। আজ পর্যন্ত দশটা দিন একনাগাড়ে শহরে থাকতে পারেনি সে, সেই ছোটো বেলায় তার পায়ের নিচ থেকে মনফলের কাঁটাটাও দাঁত দিয়ে তুলে এনেছে কমল! আফিয়া কি কোনোদিন আর শৈশবটা এনে গাঁথবে না আজকের সাথে?

-তুমার লাগি এখতা আনছি, কক্সবাজার গেছলাম।
-তুমার জিনিস আমি কেনে নিতাম? যাও ইকান থাকি।
-সামান্য একটা জিনিস, নেও না প্লিজ?
-কিতা যন্ত্রণা করো খালি? যাও কইলাম!
-দেখলেই খালি যাও যাও করো কেনে? একদিন কই থাকি কই জায়মুগী দেখিও!
-কই আর যাইবায়? আইজ কাইল লন্ডন আমেরিকাও বাড়ির বাল্লাত!
-আরো দূরই! নিবায় নি তে?
-দেখি জিনিস কিতা?
-সেন্টমার্টিন গেছলাম, কোরাল মাছর একটা দাঁত আনছি, লকেট বানাইছি টাউন থাকি, আর কয়টা লাল রঙ্গর পাথর।
-মাছর দাঁত? তাও সুনা দিয়া লকেট? তুমার পড়ার টেবিলো রাখিও, শক্তি পাইবায়।

কমলের চোখের ভেতর পানি জমতে শুরু করে, দাঁতটি সে সারাটি পথ বুকপকেটে করে এনেছে, ঘুম লেগে গেলেও ছাত করে উঠে দেখেছে যে দাঁতটি ঠিকটাক আছে কিনা, আর পাথর নিয়ে বন্ধুদের কী রসিকতা! তার কেবলই মনে হচ্ছিল আফিয়ার দুধরাজ সাপের মতো ধবল চিকন গলায় সোনার চিরল সুতায় বাঁধা কোরাল মাছের কালো দাঁতটি লম্বা একটা জরুলের মতো সেঁটে থাকবে কামিজের ভেতর।

তিন আঁজলা পানি খেয়ে ছড়ার ওপারে এসে পাহাড়ে উঠতে থাকে কমল, গ্রামের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে বড়পুতার মুকাম, পাথুরে সিঁড়ির দুপাশে ঘন ফণীমনসার ঝুপ, ঝুপের মাথায় কুণ্ডলি পাঁকিয়ে ঘুমিয়ে আছে একটি পাটোয়া সাপের বাচ্চা, মাজারের উঠানে উঠে পা থেকে জুতো খুলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর বড় ঝামা পাথরখানার দিকে এগুতে থাকে, কঠিন মানতের মুকাম বড়পুতা, হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্ট যাওয়া যাবে না, গেলেও মামলা জেতা অনিশ্চিত, সেখানে বড়পুতা, পাঁচ বন্ধুর এক আস্তানা, চারজন মুসলমান, একজন হিন্ধু, এমন গরম মাজার এই ইউনিয়নে আর নাই, হেজিপাজি দাবি নিয়া কেউ আসে না এই মুকামে, কতজন ভয়ে অজু নষ্ট করে বাড়ি ফিরে গেছে জোড় অজগর দেখে, জোড় অজগর দেখাই ভাগ্য, এক পলকে কপাল খুলে যায় তার দেখা পেলে, তাই বারে বারে আসে কমল, আজও মাথার উপর বটের ঝুরিতে সরসর শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকায় সে, দূরে শরিফা গাছের মাথায় কী যেন মেঘের মতো! শূন্য পাথরখানায় জোড়সাপের অস্থিত্ব কল্পনা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কমল, সে হয়ত দেখছে না, সাপযুগল তাকে দেখছে, যদি দয়া হয়, একটিবার ইশারা করে, আফিয়া আর দূর দূর করে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেবে না তাকে, একদিন ঠিকই স্বপ্নে দেখবে সে ছাড়া আর কোনো ঠিকানা নাই কমলের।

যে পথে উঠেছিল সেই পথ বাদ দিয়ে বনের পথ ধরে কমল, দুপুরের নিঝুম বনে দু’এক কাঠবিড়ালি, ছড়ার পারে কেয়াবনের ভেতর ছানাপোনাসহ এক বনমুরগি, ডালে ডালে কিছু বাঁদর। বাদবাকি সব ভাতঘুমে কাতর, ছায়া দেখে চিকন একটি ছড়াতে পা ডুবিয়ে বসে কমল, বোশেখ মাসের গরম যেন মাথার মগজ গলিয়ে দেবে। পায়ের পাতার ওপর ডানকিনে মাছের ঝাক হামলে পড়েছে, সে ঘুমানোর চেষ্টা করে, সিঁড়ির ওপর হেলে পড়েছে বুড়ো একটি তেজপাতা গাছ, সেই গাছে পা ঝুলিয়ে বসেছে আফিয়া, তাকে উপরে উঠে আসতে দেখে ডাল ধরে ঝাকুনি দেয়, সুগন্ধি পাতারা কমলের নাকমুখে কোন এক অদেখা জগতের যেন দুয়ার খুলে ধরে, এরই মাঝে দেখে সে আশ্বিন মাসি একজোড়া চাঁদ গড়িয়ে নামছে হেলেপড়া তেজপাতা গাছ থেকে, চকিতে লুফে নেয় সে, কী ঠাণ্ডা কোমল পেলব, যেন ভেনাসের মুকুট থেকে খসে পড়া একজোড়া মুক্তা পাথর! জোড়া চাঁদের কোমলতা তার হাত বাহু কণ্ঠ হয়ে ছুটাছুটি করতে করতে নাভিমূল সহ পেঁচিয়ে ধরে।

-তুমি ইলা গাছর ডালও বইও না আফিয়া, কুনদিন পড়ি যাইবায়।
কমল দুধরাজ সাপের মতো ধবল গ্রীবার নিচে ভয়ে ভয়ে তাকায়, তারপর সিঁড়ির নিচ হয়ে ফের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে আফিয়ার জোড় চাঁদের দেশে,
-চিন্তা করছি আর পড়াশোনা করতাম নায়, গাউ ছাড়িয়া দূরই যাইতে ভালা লাগে না, তুমি কিতা কও?
-আমি তুমার কে যে কইমু? তুমার হাতও কিতা?
-তেলর বিচি।
কমল এক মুঠো তেলবিচি আফিয়ার হাতে দেয়, গ্রামে এখন একমাত্র তাদের বাড়ি তেলগাছ অবশিষ্ট আছে, লম্বা চ্যাপটা রক্তরঙ্গা চকমকি বিচি কোচড় ভরে এনে বারান্দায় বসে খেলত আফিয়া, কমল দিনভর গাছের দিকে তাকিয়ে থাকত কখন ঝুপ ঝুপ করে পড়বে বিচিগুলো,
-তেলর বিচি? দূর ইতা দিয়া আমি কিতা করতাম!
মুঠোভর্তি তেলবিচি বাড়ির বাল্লায় ছুঁড়ে ফেলে আফিয়া।

ধড়ফড় করে উঠে বসে কমল, ঘুমের ভেতর কি একজীবন পার হয়ে গেছে? উঠতে চেষ্টা করে, কালঘুমকে প্রশ্রয় দিতে নেই, পা দুখানা ভারী হয়ে গেছে, এমনিতে ছড়ার পানি জগতের সবচেয়ে ঠাণ্ডা পানি, কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল কে জানে, কিন্তু বনের মাথায় যেই সেই রোদ, অনেকক্ষণ ঘুমালে রোদের ওপর পর্দা থাকত, তাহলে হয়ত ঘুমায়নি সে, কী যে হয়েছে আজকাল, জেগে থাকলে মনে হয় আফিয়া চুরি হয়ে গেছে, বুক ধড়ফড় করে, ঘুমিয়ে থাকলে মনে হয় আফিয়া চুরি হয়ে যাবে, তাই উঠে গিয়ে তাদের বাড়ির সিঁড়ির নিচে বসে থাকে…

বন থেকে বেরিয়ে দেখে এখনো সেই বাচ্চাগুলো ছড়ার ভেতর মাছ খুঁজছে, মুকামের ওপর থেকে দেখেছিল পরনের লুঙ্গি, গায়ের জামা খুলে হাটু পানিতে মাছ খুঁজছে, এখনও আছে যখন, তখন গোরস্থানে যাওয়া যায়, ঠিকঠিক দুপুর বেলা চরতে ফিরতে আসে এক জোড়া ডাহুক ডাহুকি, খেলতে খেলতে দু’এক গাছা পালক যদি ফেলে যায়! পালকের ব্লাউজ বানাবে আফিয়া, নরম কোমল!

পনেরোটা দিন থেকে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে এর কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না কমল,
-তুমি হাছা হাছা আমার কলিজা চাওনি আফিয়া?
-কিতা কও পাগলর লাখান? হুনলেউ ঘিন করে!
-ঔদিন নু কইলায়?
-কুনদিন? কুনসময় ঢং করি কিতা কইছি, মনো আছেনি?
-তুমি আমারে চাও না আফিয়া?
-কিতা করো কমল ভাই? হাত ছাড়ো কইলাম...
-সরি আফিয়া, একটা বার খালি কও তুমি আমারে চাও...
-বাড়িত যাও।

বাড়িত যাও, বাড়িত যাও, বাড়িত যাও—পালক ধরা হাতে কপাল চেপে ধরে কমল, অঘ্রাণ মাস, এরই ভেতর বন ফাঁকা হাওয়া লেগেছে, আজও মুকামে এসেছিল, জোড়সাপের দেখা মিলল না, যতদিন না মিলছে, আফিয়াকে পাওয়া হবে না তার! শীতের খবর বুঝতে না বুঝতে দেখো নাবতলার পানিতে টান ধরেছে, পাহাড় ভর্তি নাবতলাতে, দিনভর পানির ঝিরি ঝিরি শব্দ, সারা পাহাড় জোড়ে সুতানালি সাপের মতো ছড়িয়ে আছে পানির ধারা, সমতলে জড়ো হয়ে ছড়ার যেন হাট বসিয়েছে, অথচ খাবার মতো পানি মিলল না কমলের।

ধবধবা চন্নি রাত, এমন রাতে মাথার দিকের জানলা খুলে রাখে আফিয়া, সেই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁপে ওঠে কমল, জানলা বন্ধ, আজ আফিয়াদের বাড়ি আসতে আসতে মাঝরাত হয়ে গেল, মাঝরাতের আগে কোনোদিন জানলা বন্ধ করে না আফিয়া, মনাদাদার কবরের কোণায় গিয়ে সেই যে শুয়েছিল ঘাপটি মেরে, দুপুর গিয়ে সারাটা বিকাল চলে গেল মাথার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে, সাথে কি সন্ধ্যাও? সন্ধ্যারাতে চাঁদের গুঁড়া গায়ে মেখে মেখে ডাহুকের মেয়েগুলো যৈবনবতী হয়ে ওঠে, নাচতে নাচতে যদি দু’একগাছা পালক ফেলে যায়! পাহাড় ভরা বন বাদাড়, ছড়া, কোথাও একখানা ময়ূরের পালক পেল না যে আফিয়ার পাটোয়া সাপের মতো কালো পিচ্ছিল চুলের বিনুনিতে একগাছি পালক গুঁজে দেয়, এখন যদি একগাছা ডাহুকের পালক না নিয়ে যায়, আফিয়ার সামনে দীনহীন অধম ভিখারি মনে হবে নিজেকে, কাঠবাদাম গাছের তলায় বাদাম খেতে কাঠবিড়ালি এলো, শেয়ালের সাড়া পেয়ে খরগোশের ছানাটি এসে লুকালো মতি দাদার কবরের ফাটলে, বাকি রাত কাঁধে নিয়ে উড়ে গেল বিরাট মেঘের চাকতি তবু না মিলল একগাছা নরম পালক!
-আফিয়া, আফিয়া...

ফিসফিস করে জানলায় ঠোকা দিতে থাকে কমল,
-আফিয়া...

ধীরে ধীরে জানলার পাল্লা যেন আফিয়ার দুবাহু মেলে ধরা ডানা তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে আসছে, এমন ভাবে খুলে যায়,
-তুমি?
কমল বোঝে না এতটা অবাক হওয়ার কী আছে?
-তুমার লাগি ওই দেখো কিতা আনছি?
-অতো রাইত তুমি এখানো?
-তুমার লাগি পাখির ফইড় আনছি, ডাহুকর ফইড় পাইলাম না আফিয়া!
-ফইড়? ইতা দিয়া আমি কার শিন্নি করতাম?
-তুমিনু কইলায় ব্লাউজ বানায়তায়? কমল মরিয়া হয়ে উঠে কথাটা মনে করিয়ে দিতে,
-কুনদিন কইছি?
রাগে কি ঘামতে শুরু করেছে আফিয়া! কিন্তু এতটা রাগবেই বা কেন? কমল কি একটা ব্লাউজ বানাতে সাহায্য করতে পারে না তাকে?
-আইজ সকালেনু কইলায়?
-কমল ভাই, আইজ পঁচিশদিন বাদে তুমি আমরার বাড়িত আইছও, অখন যাও, কেও দেখলে সর্বনাশ অইব!
কমলের বুকের পাড় ভাঙতে থাকে হুড়মুর করে,
-তুমি ভুলি গেছ আফিয়া?
-আচ্ছা ভুলছি, অখন ইখান থাকি যাও
-তুমি ব্লাউজ বানায়তায় নায়? কত পাহাড় থাকি তুকাইয়া আনলাম...
-না বানাইতাম নায়,

সারাদিনের কুড়ানো পালকের গুচ্ছ জানলার নিচে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকায় কমল,
-যাইয়ার, তুমার লাগি আমার বুক ফাটবো গো আফিয়া, আমার কবর ফাটবো...

কয়েক মুহূর্ত যেন নিঃশব্দ শুনশান মনে হলো আফিয়ার, কী যেন একটি অলক্ষুণে শব্দ কানের পাশে ঘুরে গেল! ধীরে ধীরে ফের জানলা খুলে সে, কে জানে কী হয় অঘ্রাণের চাঁদে, শরীর ভেদ করে আলো এসে ঢুকে পড়ে রক্তের ভেতর, জানলা বন্ধ করার মুহূর্তে কমল ভাইয়ের রক্তের ভেতর কী যেন এক ছায়া চোখে পড়ল তার, কিন্তু কমল ভাই কই? ঐযে আলোর ভেতর শিমুল তুলার মতো উড়ে উড়ে ভরশূন্য হেঁটে যাচ্ছে যে আলো, ওটা কমল ভাই? কিন্তু কোথায় ছুটে যাচ্ছে সে! আফিয়া নিজের ভেতর মরণ চিৎকার দিয়ে ওঠে, হাঁটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসে পড়ে, কমল যে রেখা ধরে হেঁটে যাচ্ছে, তার কোনো গন্তব্য নেই, ভিটামাটি নেই, ভাঙ্গা বাসন, বাতিল টিন লোহা লক্কর ফেলার তিন সাড়ে তিনশ’ ফুট এক গভীর খাদ।



বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।