ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ব্রয়লার | মাহবুব আলী

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০১ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৫
ব্রয়লার | মাহবুব আলী

এই নিয়ে তিনবার ঢুঁ মারা হলো। হামিদুল স্যার আসেন নি।

রোজা রমজানের দিন। দেরি হতেই পারে। তিনি ক্রেডিট সেকশন অফিসার। তার হাতে ফাইল। যদি সেটি দয়া করে পাস করে দেন, লোন হয়ে যায়। আবুল হাসিম খুব সকালে এসেছেন। কয়েক রাত ধরে ঘুমোতে পারছেন না। ভোরের দিকে দু’চোখ খুব চেপে আসে, কিন্তু উপায় নেই; কাজটির জন্য তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়েন। ডায়াবেটিসে ভোর থেকে চারবার হয়েছে। চেহারা সবসময় ক্লান্ত শ্রান্ত। পঞ্চাশ-বাহান্ন বছরের মানুষ চকচকে থাকে না। কেউ কেউ থাকে। তারা সমাজের উপরতলার মানুষ। সুখাদ্য আছে, উন্নত চিকিৎসা... আরামের জীবন। তারা স্বর্গের মানুষ। তিনি নরকের। নরক যন্ত্রণা মেনে নিয়েই বেঁচে আছেন। যদি এই টিকে থাকা বেঁচে থাকা হয়।

প্রচণ্ড শীতে চার-পাঁচ মাস আগে ফার্ম চলে গেল। মরার উপর খাঁড়ার ঘা। পত্রিকায় ফ্লু-ফ্লু লিখে বিশাল কভারেজ। বেশি না মাত্র সাড়ে তিনশ’ থেকে নব্বই ছিল। দু’এক ডজন বিক্রি করতে পেরেছেন। একদিন দুপুরের আগে সাহেবেরা এলেন। পরীক্ষা করা হবে। একজন পাশে ডেকে নিয়ে আবদারের কথা জানালেন। তখন হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা নেই। কোত্থেকে দেবেন? রুনি বেগমের যক্ষের ধন সোনার চেইন, এক ভরি ওজন; মেয়ের বিয়ের জন্য রেখেছিলেন। সেটি বিক্রি করে অবলম্বন খুঁজলেন। স্ত্রীকে কোনোদিন কোনোকিছু কিনে দিতে পারেন নাই। বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস তার মধ্যে থাকলেও রুনি বেগমের ছিল না। তিনি আলগোছে তুলে দিয়েছেন সম্পদ। ছেলেমেয়েরা কলেজ শেষ করতে পারে নাই। তারাই তো আসল সম্পদ।



আবুল হাসিম আবদার শুনে দিশেহারা। উপায় নেই এটিই নিয়ম। কালচার। বড় সাহেবকে দশ হাজার সাধলেন। অনুনয় বিনয় বৃথা গেল। সে টাকা যদিও ধারকর্জ করে আনতে হতো। তারা মানলেন না। সুতরাং লাল সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে কঠিন নির্দেশ। বিপজ্জনক। মধ্য দুপুরে বড় একটি কবর খুঁড়ে সব ঢেলে দিলেন। তার দু’চোখ ঝাপসা, ঠিকমতো কিছু দেখতে পেলেন না। উপলব্ধি শুধু, যেভাবে কবর দেয়া হলো; তার সঙ্গে আশা-ভরসাও মাটির নিচে চলে গেছে। তিনি মনের চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে জেনে নিলেন, কবরের অন্ধকার কত তীব্র!

সরকার নতুন করে দাঁড়ানোর জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার প্রকল্প ছেড়েছে। মাসখানেক ধরে তারই তোড়জোড়। হামিদুল স্যার বড় অফিসার। কাচ ঘেরা ঘরে বসেন। এসি আছে। সামনে ডেস্কটপ কম্পিউটার আছে। তার মনিটরে নীল রঙের ছককাটা ঘর। কখনো থেকে থেকে কালো হয়ে যায়। ইংরেজিতে লেখা একটি লাইন একেবেঁকে ঢেউ খেলে ভেসে ভেসে চলে। “stop corruption now” ডানের অন্ধকার থেকে লেখাটি জেগে ওঠে বাঁয়ে হারিয়ে যায়।

আবুল হাসিম দেখছেন। তার দৃষ্টি ঝাপসা। ক্যাটারেক্ট ফরম করছে। সামনে পার্টেক্সের ঝাপসা দরজা। উপরের অর্ধেক কাচ। তার পাশে বাইরে টুল। সেটিতে বসে থাকে রমজান। কুচকানো চেহারা। গালে ছাগল দাড়ি। পান খেয়ে ঠোঁট লালচে কালো। আচমকা খেঁকিয়ে ওঠে। গত দুবার চা খাওয়ার পয়সা পায়নি সে।

‘এখন দেখা হবে না। স্যার ব্যস্ত। ’
‘কখন এসেছেন তিনি?’
‘সে আপনের জাইনা কী হইব?’
‘সে তো বটেই... তিনবার এলাম কি না!’
‘কাজ থাকলে একশ’ বার আইসতে হইব, ঠ্যাকা কার?’



আবুল হাসিম চুপ করে গেলেন। শক্তিহীন মানুষকে অনেককিছু সহ্য করতে হয়। গরজ তার নিজের। বিকল্প কোনো পথ বা অবলম্বন নেই। বেসরকারি ফার্মে চাকুরি করতেন। কোনোদিন ক্ষমতা দেখাতে পারেন নাই। সে শখ নেই। কাজ করেছেন দিনরাত। মালিক যতদিন পেরেছেন দেখেছেন। খাতির করেছেন। এখন আবুল হাসিমের দৌড়ঝাঁপের কেন, ঠিকমতো হাঁটার শক্তি নেই। এঙ্কেল জয়েন্টে আর কোমরে ব্যথা। দেড় বছর আগে অফিসের মটরসাইকেল থেকে পড়ে ডান পা ভেঙে গিয়েছিল। কুকুরের তাড়া খাওয়া কুকুরের জীবন বাঁচাতে যত বিভ্রাট। বড় এক গর্তে পড়ে গিয়েছিলেন। এরপর বিছানায় শুয়ে থাকলেন চার মাস। পা থাকবে কি না দুর্ভাবনায় অবশেষে ঠিক হলো বটে, ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কোম্পানি ধন্যবাদ চিঠি দিয়ে বিদায় দিয়েছে। হাতে কিছু টাকা। সেই টাকায়... সে যাক, যদি আবার দাঁড় করানো যায়। যদি যায়।

হামিদুল চৌধুরি। ডাকসাইটে মানুষ। চুলে কলপ, গাঢ় গোঁফ আর চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। কথা বলেন, বাংলা সাহিত্যের প্রমিত ভাষায়। শুদ্ধ উচ্চারণ। কথার মধ্যে দু-চারটি ইংরেজি থাকে। অদ্ভুত একসেন্ট। প্রাণ ভরে যায়। তিনি জ্ঞানী... মহাজ্ঞানী মানুষ। ক্ষমতাবান মানুষ। আবুল হাসিম পঁচাত্তর সালের বি.এ। সে বছর কত পার্সেন্ট পাস করেছিল? মাত্র ছয়। তার কলেজে নয় দশমিক সাত দুই। একশত পঁচাশি জনের মধ্যে আঠারো জন। তিনি তাদের মধ্যে দ্বিতীয়, কিন্তু থার্ড ডিভিশন। সরকারি নীতিমালায় চাকুরি পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। অন্যত্র খেটে খেটে জীবন শেষ করে ফেললেন। এখন ভেবে কী হবে? তবু দৃষ্টি ভিজে যায়। ঝাপসা সবকিছু হয়ে পড়ে ঘোলা।

রমজানের দিন। সকাল নয়টা থেকে সাড়ে তিনটা অফিস। রাস্তায় জ্যাম। ইফতারির বাজার। শাহী হালিম। বড়লোকের পোলা খায় কাবাব। খাসির ঠ্যাং তুলে ধরে দোকানের লোকজন। সামনে বড় কড়াই। ফুটন্ত তেল। তার রং কালো। ভাজাভুজি চলছে। তাদের মাথায় টুপি। আতরের সুবাস। চারিদিকে কোলাহল ব্যস্ততা। বছর ঘুরে আসে রমজান, এ মাসে ভালো কিছু খেতে না পারলে রোজা আবার কি? হামিদুল স্যারের আবদার। আবুল হাসিম হাত উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন।

‘দাম?’
‘বারো শ টাকা পিস। ’

আবুল হাসিম হেঁটে চলেন। দুটো পিস কিনেছেন। দু হাজার টাকা। বেশ ভারী, গরম আর মসলার সৌরভ। তাকে এবার বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে চার-পাঁচটি ব্রয়লার। মেশিনে দিয়ে সাইজ। স্যারের নির্দেশ আবদার। ম্যাডামের পছন্দ। অভেনের গ্রিলে বারবিকিউ করবেন। ভুনা খাবেন। আবুল হাসিমের নিজের ফার্ম নেই। থাকলে বাড়তি খরচ হতো না। আবার নতুন করে হবে। দুর্বল দু’ পায়ে আবার উঠে দাঁড়াবেন। কথা পেয়েছেন। আগামীকাল ফাইলে নড়বে। এর জন্য... সে কিছু নয়; সামান্যকিছু। রোজা রমজানের দিন। ভালো মন্দ খেতে হয়।

সামনে ঈদ। তাই অল্পতে কাজ করা আর কি! সে হোক। আবুল হাসিম ধার করে নিয়েছেন সে খরচ। এখন জোরে হাঁটার চেষ্টা করেন। সিএনজি’র ভাড়া নেই। নয় নম্বর বাস ধরতে হবে। সূর্য ডুবু ডুবু। ক্লান্ত শরীর। তিনি একটু থেমে ঠিকানা মনে করার চেষ্টা করলেন। দিন পনেরো কিংবা কুড়ি আগে স্টাফ কোয়াটারে গিয়েছিলেন। ছায়া ছায়া সন্ধ্যে তখন। স্যার ছিলেন না। ম্যাডাম দরজা থেকে জানান। স্বাস্থ্যবতী মহিলা। ছেলেটিও বেশ থলথলে নাদুসনুদুস। আবুল হাসিমের চোখে ফার্মের ছবি ভেসে ওঠে। শত শত ব্রয়লার। ঝিম মেরে বসে আছে... নাদুসনুদুস। সন্ধ্যের অন্ধকারে ঝিলিক মারে।

আবুল হাসিম বারবার ব্যাগ হাতবদল করছেন। বেশ ভারী। সামলাতে পারছেন না। বাসে উঠতে পারবেন কি না কে জানে! তিনিও ব্রয়লার হয়ে উঠেছেন। ব্যাগের মধ্যে বিষ্ঠার গন্ধ। আজ অনেকে মল মুত্র খায়। সে খাক... তার কাজ হলেই হলো। এ কি ভাবছেন আবুল হাসিম? সারাদিনের রোজায় তার মুখে দুর্গন্ধ ভুর ভুর করে।



বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।