ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

চঞ্চলা সুইপার | জয়শ্রী সরকার

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
চঞ্চলা সুইপার | জয়শ্রী সরকার

ছেলেবেলায় বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা টাকা অনেকদিন পর পেলে যেমন আনন্দ হতো তেমনই হলো মরিচাপরা পলিথিনটি পেয়ে। চালের গুঁড়ি।

মা দিয়েছিল পিঠা খাওয়ার জন্যে। পিঠা বানানো দূরে থাক, পলিথিনটি পর্যন্ত খোলা হয়নি। অনেকদিনে ধুলোয় ধুলোময় হয়ে আছে। আমার যদিও ছুঁচিবায় আছে তবু পলিথিন থেকে গুঁড়ি ক’টা নামালাম। লবণ মরিচ রসে গুলিয়ে দু’খানা চটা রুটি বানালাম। আহ্! যেন বিন্নিধানের ধোয়া ওঠা ভাত। তর সইছিল না। গরম রুটিতে আঙ্গুল ডুবিয়ে হামহাম করে বেশ খাচ্ছিলাম। এমন সময়;
 
বাবু বখশিস দিবেন না?

কেটাকেটা গোলাপি-কালো মিশাল রঙের শাড়ি পরে দরজায় দাঁড়িয়েছে চঞ্চলা সুইপার। হাতে একখানা লম্বা ঝাড়। ঝাড়সমেত দু’হাত কপালে ঠেকাল। চঞ্চলা সুইপারকে দেখার কিছু নেই তবু আমি তার দিকে তাকালাম। চোখ তাঁতানো শাড়ি পরা। নিরীহ গোবেচার চাহনি। তাছাড়া বাবু ডাকের একটা মাজেজা আছে তো? কোনো কোনো সম্বোধনের সাথে এমন কিছু জুড়ে থাকে যে চাইলেও অবহেলা করা যায় না। যদিও ঘেন্নায় রুটির শেষাংশটা শেষ হলো না। মনে মনে বিরক্ত হলাম। ওর দিকে মনোনিবেশও করতে হলো। ঐ যে বললাম বাবু ডাকের একটা মাজেজা আছে। চাইলেও অবহেলা করা যায় না।  



চারদিকে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো। চঞ্চলার পা দুটো ছিটে ছাটা হলুদ মলের সাথে এঁটে আছে। হাত দুটো কমোডের দু’পাশে ঘুরছে। আমার জিভ উগড়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মলের ভাগাড় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চঞ্চলাকে বললাম, ‘সুইপার দিদি, স্নান করা নিয়ে মাথা ফাটাফাটি অবস্থা। জলটা সরিয়ে দিয়ে যেও। ও, যাওয়ার সময় লুঙ্গিটা নিয়ে যেও। ’ সুবোধ বালিকার মতো মাথা নাড়ল চঞ্চলা। বুঝলাম আজ স্নানঘরের জল আটকে থাকবে না



কিসের বখশিস?
বাবু সামনে পূজা, বখশিশ দিবেন না?
বখশিস!
পুরান লুঙ্গি আছে বাবু? ছেলেটা কাজে যায়। লুঙ্গি হলে সুবিধা।   
খুঁজে দেখতে হবে।   
ঠিকাছে। খুঁজে রাখবেন আমি পরে আসব।

আশ্বাস পেয়ে চঞ্চলা খুশি হয়। ঝাড় দোলাতে দোলাতে চলে যায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে।

বারান্দার শেষ মাথায় কবুতরের খোপের মতো চারটি ছোট ঘর। দুইটা স্নানঘর, দুইটা প্রাতঃঘর। এ কোয়ার্টারটি পাঁচটি পরিবারের জন্যে বরাদ্দ। একটি পরিবার ছাড়া বাকি সবার স্ত্রী সন্তান দেশের বাড়ি। ফলে সাবলেট সংখ্যা বেশি। আর সাবলেটের সবাই আমি গোত্রের ব্যাচেলর। ব্যাচেলরদের বদৌলতে সারাবছর খোপগুলি পালাক্রমে নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে চঞ্চলাই আমাদের একমাত্র ভরসা। তাকে ছাড়া কারো গতি নেই। চঞ্চলা সারাবছর দু’হাত দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে। পরিষ্কার করে আবার নষ্ট হয়। নষ্ট হয় আবার পরিষ্কার করে। কখনো কখনো এগুলোর সৎগতি না করেই সে চলে যায়। বললে কিছুই বলে না, কিছু করেও না। আজ তিনদিন স্নানঘরে জল আটকে আছে। চঞ্চলা তা না সরিয়েই চলে যাচ্ছে। যেহেতু চঞ্চলার ছেলের জন্যে লুঙ্গি দেব বলেছি তাই আজ সে কথা ফেলবে না। এমনটা ভেবেই আমি চঞ্চলার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।

চারদিকে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো। চঞ্চলার পা দুটো ছিটে ছাটা হলুদ মলের সাথে এঁটে আছে। হাত দুটো কমোডের দু’পাশে ঘুরছে। আমার জিভ উগড়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মলের ভাগাড় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চঞ্চলাকে বললাম, ‘সুইপার দিদি, স্নান করা নিয়ে মাথা ফাটাফাটি অবস্থা। জলটা সরিয়ে দিয়ে যেও। ও, যাওয়ার সময় লুঙ্গিটা নিয়ে যেও। ’ সুবোধ বালিকার মতো মাথা নাড়ল চঞ্চলা। বুঝলাম আজ স্নানঘরের জল আটকে থাকবে না।

‘আজকাল ঘরে প্রায়ই চাল থাকে না। ডাল থাকে না, নুন থাকে না। মাস শেষে ভাড়া থাকে না। সব না থাকার সময় জবা ফুল আমার ইশ্বর। করজোড়ে আমি তার সামনে গিয়ে বসি। একমনে বলি, সব ঠিক করে দাও জবাফুল, সব ঠিক করে দাও। ’—রাতে লেখা শব্দগুলোতে চোখ ঠেসে ধরে আছি। মূলত পড়ার ছলে হলদে মলে এঁটে থাকা পা দুটো  ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এমন সময় আবার চঞ্চলা। ‘দাদা দেখেন! একবার এদিকে চেয়ে দেখেন, এসব পাইপে ফেললে জল তো আটকাবেই’। তাকিয়ে দেখি বাঁশের কঞ্চির ডগায় একটি প্যাড ঝুলছে। সেখান থেকে পঁচা লাল জল টুপটুপ করে দরজায় পড়ছে। এহেন দৃশ্যটা দেখে কিছুক্ষণ আগে খাওয়া চালের রুটিটা যেন উগড়ে আসতে চাইল। ‘এই, এই তোমার কোনো কমনসেন্স নেই? আশ্চর্য! এইটা আমাকে দেখানোর কী হলো?’ থু থা করে কোনোভাবে ঘেন্না থেকে মুক্ত হলাম। মনে মনে ঠিক করলাম লুঙ্গি ওকে দেব না। ওর গন্ধ মাখা শরীরটা নিয়ে আমার হাত থেকে জিনিস নিয়ে যাবে সেটা কোনোভাবেই বরদাস্ত করব না। যেমনটি ভাবলাম তেমনটিই করলাম। আমি ওকে আমার পুরনো তালি দেয়া লুঙ্গিটা দিলাম না।

দুইদিন পর ঘুম ভেঙে বাথরুমের দিকে গিয়ে দেখি চঞ্চলা সুইপার খিটিমিটি করছে। ‘নবাবদের  তো কিছু বলা যাবে না। সুইচ টিপলেই জল পড়ে তবু জল ঢালে না। তোমাদের ঘু আমরা হাত দিয়া পরিষ্কার করি কিভাবে? আমাদের ঘেন্না নাই!” আমার সাড়া পেয়ে চঞ্চলা থেমে গেল। ‘বাবু, লুঙ্গি দিবেন না?’ ‘হ্যাঁ, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও’ বলে  পিছু ফিরলাম। কিছুক্ষণ পর চঞ্চলা এসে দরজায় দাঁড়াল। পরনে লাল পাড়ে কমলা বাটিক শাড়ি। যেন শ্যাওলা পড়া দেয়ালে চুনকাম রঙ। চঞ্চলার গা থেকে মলের গন্ধ আসছে। ওকে দরজায় দাঁড়াতে দিতে আমার ইচ্ছে করছে না। ওকে ছুঁয়ে লুঙ্গিটা দিতে আমার ইচ্ছে করছে না। তাই চক্ষু লজ্জা রেখে বলেই ফেললাম ‘শোন, স্নান সেরে এসো। তোমাকে ছুঁলে আমার স্নান করতে হবে। ’ চঞ্চলা সুইপার রাগ করল না। জোর হাত কপালে ঠেকিয়ে ঘণ্টা দেড়েক পরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেল।

যেই কথা সেই কাজ। ঘণ্টা দেড়েক পর সে ফিরে এলো। পরনে হলদে নীলে তাঁতের শাড়ি। কাঁধের পেছন দিক থেকে আসা আঁচলটি কুচির ওপর পাখার মতো ছড়ানো। একপিঠ ভেজা চুল। সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর। কপালে কালো টিপ। আমি লুঙ্গিটি নিয়ে ওর হাতে দিলাম। চঞ্চলার চোখ খুশিতে ঝলকে উঠল। ওর হাসি হাসি মুখ দেখে আমি ঘেন্নার কথা ভুলে গেলাম। চঞ্চলা হাসি হাসি মুখে নমস্কার ঠুকে চলে গেল। চঞ্চলাকে দেখার মতো কিছু নেই। তবু আমি চঞ্চলার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম।

আমি সুকেশ। বেকার মানুষ। পত্রিকায় মাঝে মধ্যে নামে ও বেনামে ফিচার টিচার লিখি। কখনো টাকা দেয়, কখনো সংশ্লিষ্ট এডিটর নিজেই বিল তুলে হজম করে দেয়। তবু লিখি। সবাই যখন কাজেকর্মে বাইরে ছুটে আমি তখন চেয়ার টেবিলে বসে দিব্বি আরামে কাটিয়ে দেই। খেয়ে না খেয়ে কাটিয়ে দেই। মাসের যে সময়টা আমি লেখার ফরমায়েশ পাই সে সময় অবশ্য এদিক সেদিক যাই। এটা সেটা খাই। মাস শেষে ভাড়া দেই। কখনো বা দিচ্ছি দিচ্ছি করি। এই মাসে তেমনটিই হয়েছে। তাই আজ চালের গুঁড়ির চটাই খেয়েছি। তবে আজ আমি চটা খেলেও আগামী সপ্তাহে ভালো খাব। আজ একটি ফরমায়েশ পেয়েছি। প্রান্তজনদের নিয়ে মোট পাঁচটি ফিচার লিখতে হবে। যদিও পত্রিকায় আমার নাম পাবেন না তবে আমি মজুরি পাব। এই টাকার জন্যেই চঞ্চলাকে এতক্ষণ আমি সহ্য করছিলাম। চঞ্চলার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ভাবছিলাম। চঞ্চলা ইস্যু পাঠক শোনে ভালো। সুতরাং চঞ্চলার সাথে কথা আমার বলতেই হবে। তাছাড়া সে তো এমনি কথা বলছে না। তাকে আমি আমার পুরনো লুঙ্গি দিয়েছি। প্রয়োজনে আরো দেব। কিন্তু চঞ্চলাকে নিয়ে কিছু একটা লিখব। চঞ্চলা ইস্যু পাঠক খাবে ভালো! 

ফিচার বিষয়ক ভাবনার চর্তুথ দিনে চঞ্চলা দরজায়। ‘বাবু আপনার লুঙ্গিটি কেটে ছেলের মাপে বানিয়ে দিয়েছি। খুব খুশি হয়েছে। ঠাকুর আপনার ভালা করবে বাবু। ’ একঝলক হাসি ছড়িয়ে চঞ্চলাকে ঘরে এসে বসতে বললাম। ‘শোনো সুইপার দি, একটা পুরনো শার্ট আছে। এক বছরের মতো পরেছি। পাকা রঙ। ছিটেফোঁটো নেই। বের করে রাখবো ক্ষণ। পরে নিয়ে যেও। আর আজ তোমার একটু সময় হবে? কয়টা প্রশ্ন ছিল। সময় আছে? তাহলে এসো না, ঘরে এসে বসো। ’
 
আড়ষ্ট পায়ে চঞ্চলা ঘরে ঢোকে। বসতে বলায় কিছুটা ইতস্তত করে। যে মানুষ তাকে বারবার দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে সেই ঘরে ডেকে বসতে বলছে, কিছুটা বিহ্বল হওয়ার ব্যাপারই বটে। তবে আমার অনুরোধ সে ফেলল না। বিছানার সামনের চিলতে মেঝেতে ঝপ করে বসে গেল।

বলেন বাবু, কী বলবেন।
আচ্ছা এই কাজ তোমার কেমন লাগে?
কাজ যেমন লাগে তেমনই।
তোমার গা থেকে মলের গন্ধ বেরোয়, টের পাও?
নাহ্! আগে পেতাম। এখন পাই না। তাছাড়া গন্ধ পেলেই কী? আমাদের কাজ করবে কে?
লেখাপড়া কতদূর?
স্কুলে যাওয়া আসা করেছি। নাম ঠিকানা লিখতে পারি।
তোমার স্বামী কী করে?
পৌরসভার জমাদার আছে।
নাম কী?
স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই।
এইসব এখনো আছে নাকি! আচ্ছা তাইলে বাবা মায়ের নাম বলো।
বাবা সুশীল দত্ত, মা লিলি দত্ত।  
দত্ত! এই টাইটেল আবার কোথায় পেলে?
টাইটেল পাইনি এইটা ছিলই।
বানিয়ে কিছু বলার দরকার নেই সুইপার দি।
বানাব কেন বাবু? সত্য কথা। ’
সুইপারদের দত্ত টাইটেল হয় না সে আমি জানি। তুমি বোধহয় জানো না। আমি লেখক! সবার খবরা খববরই আমাদের রাখতে হয়।
এতসব তো জানি না বাবু। তবে মিথ্যা বলছি না। আমার বাবা মা সুইপার ছিলেন না।
তাহলে তুমি সুইপার হলে কেমন করে?
বিয়ের পর।
তোমাকে সুইপারের সাথে বিয়ে দিল?
না গো। সে অনেক কথা।
প্লিজ, আমায় সে কথা বলো। আর শোনো, কাল তুমি তোমার ছেলের  জন্যে শার্টটি  নিয়ে যাবে। পাকা রঙ। এক বছরের মতো পরেছি। কেটে ছোট করতে হবে এই যা। এখন বলো। কিভাবে দত্ত থেকে সুইপার হলে!

‘আমার বাবা সুশীল দত্ত। ময়মনসিংহ ছায়াবানী সিনেমা হলের অপারেটর। সকালে খেয়ে কাজে যেতেন ফিরতেন মধ্যরাতে। মর্নিং শো, মেটিনি শো, পাঁচশো, সেকেন্ড শো, নাইট শো বাবাই চালাতেন। দুপুরে বাবার খাবার নিয়ে যেতাম আমি। পথে দাঁড়িয়ে থাকত একটি ছেলে। গায়ের রং ফর্সা, স্বাস্থ্য সুরৎ ভালো। সিনেমায় তো দেখতাম নায়ক নায়িকার জন্যে পথে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যাস এই ভাবেই হয়ে গেল। একদিন বাবাকে ভাত খাইয়ে আর ফিরে যাইনি বাড়ি।

কী! তখন তোমার বয়স কত?
দশ বার বছর হবে দাদা।

‘তাই বলে সুইপারের সাথে চলে গেলে! মুসলমানের সাথে হিন্দুর মেয়ে চলে যায়। খ্রিস্টানের সাথে পাহাড়ি। কিন্তু! কায়স্থের মেয়ে সুইপারের সাথে! তোমার বাবা মা কিছু টের পেল না?’

না টের পেলে কি আর এই হয়! পরে জেনেছিল!

রাগে গা জ্বলছে আমার! কেমন কাণ্ডটা করল! মেথরের সঙ্গে পিরিত! স্বেচ্ছায় ময়লার ভাগাড়ে গিয়ে মরা! ইচ্ছা করছে চঞ্চলা সুইপারকে চলে যেতে বলি। যে লুঙ্গিটা দিয়েছি সেটি ফেরত নেই। যে শার্টটি দেয়ার কথা বলেছি সেটি না দেই। কিন্তু পুরো গল্পটা শুনতে হবে। তাকে নিয়ে একটি টানটান ফিচার লিখতে হবে। তাই হাসিহাসি মুখে বললাম ‘পরে কী হলো? তুমি কোথায় গেলে?’
কই আর যাব! মেথর পট্টি।
আচ্ছা তুমি কি জানতে ঐ ছেলে মেথর পট্টিতে থাকে?
না জানতাম না! কিন্তু মন দিয়েছি, ঘর ছেড়েছি তাই মেনে নিয়েছিলাম।

হু! মুখটা যেন তেতো হয়ে গেল। সিগারেট খাওয়া দরকার। কিন্তু চঞ্চলাকে থামিয়ে দিলে আর ইমোশনটা থাকবে না। তাই তেতো মুখেই চালিয়ে গেলাম ‘আচ্ছা চঞ্চলা ঐ পল্লীতে তুমি কেমন করে থাকলে?’

‘থেকেছি। ছোট্ট ছাপড়া ঘরে শ্বশুর শাশুড়ি, শাশুড়ির দুই ছানা পোনা, ভাসুর-জা, দাদি শাশুড়ি। মাঝখানে পর্দা দিয়ে একপাশে আমরা। নিশ্বাসের বোটকা গন্ধ নাকের ভিতর ঢুকে যায়! ময়লা গন্ধ গরাসের সাথে ঢুকে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসে! দরজা ঘেষে শহরের ড্রেন। ড্রেনভরা পলিথিন, কাপড় চোপড়, মাছের আশ্টে, মুরগি গরু খাসির নাড়িভুঁড়ি, পঁচা রক্ত। একবার তো মরা লাশও পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া এখানে সেখানে পোলাপানের ঘু। শুকরের তাণ্ডব তো আছেই। সারাক্ষণ মাটি গলে পঁচে পুঁজ পড়ত! দারুর গন্ধের কথা আর কী বলব! দুঃখে যে একটু কাঁদব তারও উপায় ছিল না। কিন্তু তাকে তো মন দিয়েছিলাম। তার জন্যে ঘর ছেড়েছিলাম!’

আচ্ছা হরিজনরা নিশ্চয়ই তোমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল?

‘খুশি হয়েছিল তবে ওদের নিজেদের তো নিয়ম আছে। নিজ গোত্রে বিয়ের নিয়ম। বাসফোর বাসফোরের মেয়ে বিয়ে করবে, হেলা হেলার মেয়ে, লালবেগী লালবেগী মানে যে যার গোত্রে। আমি গোত্রের বাইরে। তাই সাত দিন আমরা একঘরে হয়ে ছিলাম। কেউ আমাদের সাথে কথা বলেনি। কারো ঘরে ঢুকতে দেয়নি। তারপর পঞ্চায়েতে সব সমাধান হলো। তিনি কান ধরে একশ বার উঠবস করলেন। শ্বশুরমশাই সকলকে নিমন্ত্রণ করে শুকরের মাংস আর দারু খাওয়ালেন। আমরা জাতে উঠলাম! সে যে কত গল্প। এক দুনিয়া বইয়ের সমান গল্প বাবু!’

তোমার বাবা মা? তারা? তারা এলো না?

‘নাহ! জাত দিয়েছি! নিলে কি আর গন্ধ মুছবে! লজ্জা ঢাকতে তারা ভিটে ছেড়ে চলে গেল! শুনেছি ওপারে আছে! সেসব কতদিন আগের কথা! ভাই বোনগুলোকে দেখলে আজ আর চিনব না। মা বাবা আছে না নেই তাও জানি না!’

মুক্তোর দানা ঝনাৎ ঝনাৎ করে পড়ছে চঞ্চলার চোখ থেকে। পাখার মতো ছড়িয়ে থাকা আঁচল দিয়ে চঞ্চলা তা মুছে দিচ্ছে। আমার মাথায় এখন চঞ্চলা ঘুরছে। কোনো কারণ নেই তবু চঞ্চলার ঘোরে আমার দুপুর ঘুরছে।

চঞ্চলাকে দেখার কিছুই নেই তবু আমি চঞ্চলার দিকেই চেয়ে রইলাম।



বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।