ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভিন্ন রোমিও জুলিয়েট: সরল উপলব্ধির গভীর ক্ষত | মেহেদী তানজির

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৬
ভিন্ন রোমিও জুলিয়েট: সরল উপলব্ধির গভীর ক্ষত | মেহেদী তানজির

‘ভিন্ন রোমিও জুলিয়েট’ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন জেনি সেলী ও আর্টিস্টিক ডিরেক্টর গ্রে থিয়েটার কোম্পানি। ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটার, বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ব্র্যাক ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় বাংলাদেশ ব্রিটিশ কাউন্সিল নাটকটি সোমবার (২৮ মার্চ) সন্ধ্যা ৭টায় একাডেমির মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ করে।

মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) নাটকটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হবে একই সময়ে একই স্থানে।  

ভিন্ন রোমিও জুলেয়েট নাটকটির ভিন্নতা এর অভিনয় শিল্পী, নাট্যকাঠামো ও দার্শনিক ভঙ্গিতে। নাটকটির অভিনয়শিল্পী সবাই ‘ভিন্নভাবে সক্ষম’। সবারই শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর ফলেই রয়েছে নাট্যভাষার ভিন্ন প্রকাশ। প্রায় প্রতিটি চরিত্রেরই দু’জন করে অভিনয়শিল্পী। কেউ হয়তো শরীরের সঙ্গে লড়াই করে সংলাপ প্রক্ষেপণ করছেন, অন্যজন শরীর ও মনে অংশ নিচ্ছেন। এ এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। মূলত ঢাকার শিল্পকলাকেন্দ্রিক দর্শকের জন্য ভিন্ন বৈকি।

নাটকটির শুরুতেই মঞ্চে আসেন সঙ্গীত শিল্পীরা। গভীর মনোযোগ আর ভালোবাসায় একটানা বাজিয়ে যান বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় সব গান। পেছনে প্রজেক্টারের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে দেশের নানা স্থানের বিভিন্ন ‘ভিন্নভাবে সক্ষম’ মানুষের ছবি, হাতে প্ল্যাকার্ড। প্রত্যেকের প্ল্যাকার্ডে ‘সুখ’ বলতে তাদের নিজেদের অভিমত।

হঠাৎ ক্রিকেট খেলার আদলে শুরু হয় নাটক। উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের ক্লাসিক নাটক ‘রোমিও জুলিয়েট’র এ এক ভিন্ন প্রকাশ। অধিকাংশ দর্শকের তখনই হোঁচট খেতে বাকি নেই। অসম্ভব ক্রীড়ানৈপুণ্যে অভিনয়শিল্পীরা পরিচয় দিয়ে চলেন তাদের। এতো সরল উপস্থাপন মঞ্চে সত্যিই দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। একইসঙ্গে অভনয়শিল্পীদের নিজেদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার অকপট স্বীকার ও তা নিয়ে তামাশা সংশয়ে ফেলে দর্শকদের। আসলে নিজের দুর্বলতা নিয়ে যদি নিজেরা রসিকতা করি, তাহলে বোধহয় নিজেদের হীনমন্যতা কর্পূরের মতোই মিলিয়ে যাবে।

‘খান পরিবার আর চৌধুরী পরিবারের মধ্যে খেলা’ ও বাংলা সিনেমার ‘দুর্ধর্ষ প্রেমিক’ সিনেমার পোস্টার দিয়ে তৈরি হয় মঞ্চের পেছনের চিত্র। এরই সঙ্গে সাবলীল উপস্থাপনা। অভিনয়শিল্পী আর চরিত্রের মধ্যে দেখা যায়, দ্বৈতাদ্বৈত অবস্থান। একই সঙ্গে শরীর, মন ও ভাষার সমন্বয়ের এক অভূতপূর্ব ক্রীড়া। প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রে দু’জন করে অংশ নেওয়ার ফলে একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রায়ন ও মানসিক অংশগ্রহণ পরিলক্ষত হয় নাটকে।

শরীর আর শব্দের সঙ্গে যুঝতে চাওয়ার প্রক্রিয়াটি দর্শকের মধ্যে অনবদ্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে। অসাধরণ রিদমের সঙ্গে এগিয়ে চলে নাটক। সেইসঙ্গে তামাশা তো রয়েছেই। যেমন ব্যালকনির দৃশ্যে উপরে থাকে রোমিওদল আর নিচে জুলিয়েটরা। হাসির রোল আরও পড়ে যখন রোমিও বলে, ‘এ নাটকে রোমিও ব্যলকনির উপরে থাকলে শেক্সপীয়ার কিছু মনে করবেন না’। ফিরে ফিরে খেলার মাঠ আর নাট্যবাস্তবতা স্থলাভিষিক্ত হতে থাকে। যেনো ঠিক খেলার মাঠে নিয়ে আসা হয়েছে রোমিও জুলিয়েট নাটকটিকে।

কোনো নাটক দর্শকের সহযোগিতায় যে কী রকমের আবহ তৈরি হতে পারে, তার বোধকরি আদর্শ উদাহরণ এ নাটকটির ২৮ তারিখের প্রযোজনা। যখন পাশে বসে থাকা একজন দর্শক যিনি কিনা নিজেও কথা বলতে পারেন না কিন্তু অভিনয়শিল্পীদের সংলাপ প্রক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ‘সাইন ল্যাংগুয়েজ’ ব্যবহারের ফলে বুঝতে পারেন তখন সে উপলব্ধি ও উচ্ছ্বাস এক ঐশ্বরিক আবহ তৈরি করে। শেষ দৃশ্যে অভিনয়শিল্পীরা মঞ্চে একত্রে অবস্থান নিয়ে যখন বলেন, ‘কী চেয়েছিলো রোমিও ও জুলিয়েট, ভালোবাসাই তো, আমরাও তো তাই চাই’। তারপর তারা ঘুরে পেছনের প্রজেক্টরের দিকে তাকান, যেখানে পুনরায় নাটকের প্রথমে প্রদর্শিত প্ল্যাকার্ড হাতে বিভিন্ন ‘ভিন্নভাবে সক্রিয়’ মানুষদের ছবি দেখা যায়। মিলনায়তন জুড়ে নেমে আসে হৃদয়স্পর্শী নীরবতা আর চোখজোড়া ঘোলা হয়ে আসে। এ নাটক ক্ষত তৈরি করতে সক্ষম তথাকথিত ‘সুস্থ’ মানুষের মনে। সক্ষমতার সংজ্ঞার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয় অকপটে।

বাংলাদেশ শিল্পকলায় এটিই এ ধরনের প্রথম প্রচেষ্টা। লিয়াকত আলী লাকি, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের নাট্যপরবর্তী কথনেও নাটকটির কার্যকারিতা ও সফলতার কথা উঠে আসে। বাংলাদেশে শেক্সপিয়রের চারশো বছর উদযাপন উপলক্ষে এ প্রচেষ্টা যেনো শেষ না হয় তার আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রীসহ উপস্থিত দর্শকরাও। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে এ নাটক প্রযোজনার মাধ্যমে নতুন ইতিহাস নির্মাণ হলো এবং এ প্রক্রিয়া অব্যহত থাক।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।