ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মায়াবন বিহারিণী | সরোজ মেহেদী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪২ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৬
মায়াবন বিহারিণী | সরোজ মেহেদী

দুঃখ কি আঁকা যায়! শব্দ ও শব্দে যে খেলা হয় তাতে কি উঠে আসে বুকের ভেতর এক পলকসম বয়ে চলা ঝড়ের তাণ্ডব! মানসপটে প্রতিদিন হারিয়ে যাওয়া যে ব্যথা প্রতিনিয়ত জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন দুঃখ কথার, তাকে চিত্রকলা বা লেখায় তুলে ধরা যায় না। যা যায় তা কেবল তীব্রতাহীন খোলস মাত্র।

ভালোবাসার ব্যথা বুঝি এতোটাই নিজে জ্বলে, জ্বালায়। হয়ে উঠে দগ্ধকারী আগুনদেবী।

এই যে লিখছি, কি-বোর্ডের প্রতিটি বাটনের সঙ্গে যেনো ব্যথা বেজে উঠছে। সবাই মিলে সুর তুলছে এক করুণ কোরাসের। হয়তো এ সুর অমিতের বা মুরাদনগরের দৌলতপুরে হারিয়ে যাওয়া সে সন্ধ্যার। আজও যে করুণ বীণের সাক্ষী হয়ে আছে এক মরা আম গাছ।

আজকের সন্ধ্যায় যেমন আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। হয়তো সন্ধ্যাটা খুব উজ্জ্বল ছিলো বলে। আমি ছাদে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আনমনা হয়ে যাই বলে। ছাদের উপর দিয়ে চলে যাওয়া বিদ্যুতের তারে বসা দুই চড়ুইয়ের ভালোবাসা আমার মনের আগুনকে উছলে দেয় বলে। আমি তার কাছে আবারও ফিরে আসি। বরাবরের মতো আরও একবার আত্মসমর্পণ করি। যেখানে কোন আব্রু থাকে না। ব্যক্তিগত শব্দগুলো এবেলা নির্বাসনে। সেখানে কেবল শিশুমন, খেলাছল, অকারণে খেলে যায়। বহু পুরনো সেই দরখাস্ত। আবার নতুন করে লিখি। ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্নরকম আবেগের মাত্রায়। কি-বোর্ড সজোরে চাপি। চেপে যাই। শেষ হয় না।

কোনো এক বিশেষ সন্ধ্যায় তাকে ইনবক্স করি, নববর্ষের শুভেচ্ছা হৃদয়ের গহীণ গোলাপ। ও জবাব দেয় না। এবার লিখি আই লাভ ইউ। এবারও কোনো জবাব আসে না। এই জবাব কতবছর ধরে আসে না জানি না। আসার নামও কোনোদিন নেওয়া হবে কিনা তাও জানতে পারি না। ভেবেছিলাম, বিশেষ দিন বলে হয়তো অন্তত শুভেচ্ছা উত্তর আসবে, আসেনি। তবু লিখে চলেছি অবিরাম। লিখতে গিয়ে কোনোদিন লাভ বা লোকসানের হিসাব করিনি। ডানে বা বামেও তাকাইনি। আমি শুধু লিখে যাই- তাকে, তার জন্য। কাঁচা হাতে ব্যথায় ব্যথায় পেকে যাওয়া ভালোবাসার কথা।

আজ কেন যেনো জানতে চাইলাম। শোনো, এই যে অবিরাম তোমাকে এসব-ওসব বলি, তুমি বিরক্ত হচ্ছো নাতো? ও এবার জবাব দেয়, সেরকম কিছু নয়। আচ্ছা আমি কি তোমাকে ভালোবেসে যাবো? ও খুব নির্মোহভাবে জানায়, আপনার উচিৎ, আমার পিছু ছেড়ে দেওয়া। আমি আবার ওকে লিখি- আমি তোমাকে ভালোবাসি, এটা তুমি জানো। ওর কণ্ঠ আরও নিরাসক্ত শোনায়, আমি কিছুই বলবো না। যেকোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। আচ্ছা, এটাতো অন্তত বলবে, এই এতোটা বছরে আমি কি কোনোদিনও তোমার চিন্তায় এসেছি। একটু সময় নেয় ও। এই সময় নেওয়াতেই আমি আশায় বুক বাঁধতে দ্বিধা করি না। না আমার আশাভঙ্গ হয়। ও খুব শান্তভাবেই জানায়, আমি কখনও চিন্তা করিনি।

আমার এতো বছরের অপেক্ষা, চাপা চিৎকার আর হাহাকার নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে আসে। কান্না যেনো কাঁদার যৌক্তিকতা হারিয়ে বোবা হয়ে যায়। আমি স্থির ও অচলের মতো জবাবটা বারবার পড়ি। এর মধ্যে হঠাৎই হারিয়ে যায় ও। কোথাও খুঁজে পাই না। না ফেসবুক না হোয়াটসঅ্যাপে। কোথাও নেই। আমি যেনো হাড্ডিসার কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার আমিতে একটা দেহ আছে বটে, তবে সে দেহে কোনো জীবন নেই। ওর মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করি। না কিছুই হয় না। জানলা খুলে দেই। বাইরে থেকে গায়ে কাঁপন ধরানো বাতাস আসছে। আমার প্রচণ্ড গরম লাগছে। তৃষ্ণা হচ্ছে খুব, যে তৃষ্ণা পানিতে মেটে না।

তারপর অনেকটা সময় চলে গেলো। এতো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কেন! বাইরে হৈ-হল্লা হচ্ছে। পটকা ফুটছে। প্রচণ্ড আনন্দ। বিশেষ এ দিনটি বরণ করে নিচ্ছে বোধহয় সবাই। ভুলে গেলাম কখন আবার। আমি ঘুমের ঘোরে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছি নাতো!

পুরো রাস্তাজুড়ে মিছিল। দুরন্ত ছেলের দল পটকা ফুটাচ্ছে রাজপথে আর সে পটকা যেনো এসে ফুটছে আমার বুকে। গন্ধে গন্ধে ছেয়ে গেছে বুক। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মুখ। আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। এতোক্ষণে আওয়াজও কমে এসেছে বোধহয়। শুধু একটা শাড়ির আঁচল চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একি, আঁচল ভাসিয়ে ও আমার সামনে দিয়েই হেসে যাচ্ছে।

আমি ওকে বলে ফেলি- শোনো, আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তুমি আমাকে একটু করুণা দেখাবে? ও হাসে। চুলগুলো মাথা বেয়ে নেমে আসে ঘাড়ে। ঘাড় থেকে বাতাসে দোলা চুল এসে পড়ে মুখে। ফর্সা মুখের কালো চুলে ঢাকা সে হাসি কয়েকটি নদীর কালি দিয়ে লিখতে পারবো আমি। না থাক। আমি ওকে বলি। বিড় বিড় করে বলে যাই, কী অদ্ভুত না দেখো! বাইরে ককটেল ফুটলেও মিডিয়ায় খবর হয়। কে করলো, কারা করলো, কেন করলো- এমনসব কারণ উদঘাটনে অনুসন্ধান কমিটি হয়। অথচ তুমি প্রতিদিনই আমার ভেতরে ভারী বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছো। রক্তক্ষরণ করছো, খুন করছো। বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে, কেউ ঘুণাক্ষরে জানতেও পারে না এসব নির্মমতা...।

এবার ও হি হি করে হেসে ওঠে। সে হাসিই বোধহয় আমার চোখে অপমানের কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। এমন ঘোর অন্ধকার রাতে কেউ কি এই নির্বোধ অর্থহীন কান্নার সাক্ষী‍ হবে!

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।