ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আলো | রাজিয়া সুলতানা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৬
আলো | রাজিয়া সুলতানা

প্রচণ্ড গরমে সকাল হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেলো আলোর। ঘরে গুমোট অন্ধকার তার সঙ্গে প্রচণ্ড গরম।

হাতড়ে হাতড়ে বালিশের তলা থেকে নিজের প্রথম আয়ের টাকায় কেনা মোবাইলটা বের করে সুইচ টিপে দেখে- সাড়ে চারটা বাজে। তাকে নয়টার মধ্যেই কাজে যেতে হয়, তার মানে এখনও অনেক সময় বাকি। আলোর মাথার ওপর ঘুরছে ছোট একটি ফ্যান। আলো যে ঘরটায় থাকে সেটি টিনে মোড়ানো একটি ঘুপচি। ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালারা আদর করে যাকে বারান্দা বলে।

আলো ধীরে ধীরে পা ফেলে টিনের দরজাটা খুলে দেয়, দম বন্ধ করা গরমে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে ঊষাদেবী তার কচি হলুদ রঙ মাখাতে শুরু করেছে পৃথিবীর গায়ে। আলো আবার তার চৌকিটাতে এসে বসে। মনে করার চেষ্টা করে, আজ কত তারিখ। শ্রাবণ মাসের ২৫। বাপরে, গত তিন দিন ধরে গরমটা পড়েছে খুব! আজ কতোদিন হবে সে ঢাকা এসেছে- তিন মাস। না, তিন মাস হয়নি। কেমন আছে আব্বা, আম্মা? কেমন আছে তার ছোটবেলার খেলার সাথীরা, কেমন আছে বাড়ির পাশে নবগঙ্গা নদী, বিল, ধান ক্ষেত, বাড়ির পেছনের সেই তেঁতুল গাছটা? আহা, নদীর কথা মনে আসতেই নবগঙ্গা থেকে বয়ে আসা এক ঝাপটা শীতল বাতাস তার চোখে-মুখে লাগে।

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই ঢাকা এসেছে আলো। ইচ্ছা নিজের আয়ে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া। ঢাকার তেজগাঁওয়ে তার ভাই-ভাবির কাছে এসে বলেছে, আধবেলার জন্য তাকে যেকোনো কাজ খুঁজে দিতে, যেটা করে সে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে। ভাই-ভাবি দু’জনেই একই গার্মেন্টসে চাকরি করেন। তারা থাকেন একরুমের টিনশেড বাড়িতে, আলো আসায় বারান্দাসহ অন্য একটি ঘর ভাড়া করতে হয়েছে। এতে খরচ বেশি হবে বলে ভাবি প্রথম দিকে খুব বিরক্ত ছিলেন।

ভাবিতো একদিন বলেই ফেললেন, ঢাকায় কতো পুলাপান ঘুরতাছে পাশ কইরা আর তুমি আইসাই চাকরি করবা? চাকরি কি গাছের পাতা, ঝাঁকি দিলেই হইলো?

কিন্তু সত্যি সত্যিই এই চাকরি নাইয়ের বাজারে কিছুদিনের মধ্যে আলোর একটা চাকরি হয়ে গেলো। আলো দেখতে ফর্সা নয় কিন্তু সুশ্রী, সুন্দর করে কথা বলার চেষ্টা করে এবং বেশ দেরিতে স্কুলে যাওয়া শুরু করায় শরীরের কচি ভাবটা কেটে গেছে।

এক ওষুধ কারখানায় ভাইয়ের এক কথিত বন্ধুর সুবাদে আলোর এ চাকরিটা হয়। নয়টাÑ তিনটা ডিউটি, শিফটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। খাবার বইবার ঝামেলায় তাকে যেতে হয় না। ছুটির পর বাসায় এসেই দুপুরের ভাত খাওয়া যায়।

আলো দেখে, ভাবি ঘুম থেকে উঠে জামা কাপড় হাতে গোসলখানায় যাচ্ছে। আলোও উঠে দাঁড়ায়, ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে কলপাড়ের দিকে এগোয়।

আলো আজ খানিকটা সাজগোজ করে ডিউটিতে এসেছে। চোখে কাজল পরেছে, হালকা করে ঠোঁট রাঙিয়েছে। আলো যে বিভাগে ডিউটি করে সেখানেই কাজ করে তার ভাইয়ের কথিত বন্ধু শরীফ মিয়া। বয়স ৩০ কী ৩২। লেখাপড়া কলেজ পাশ, দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে অভিজ্ঞতা অনেক। ম্যানেজার পর্যন্ত তাকে সমীহ করে চলে। শোনা যায়, মালিকপক্ষের লোকজনের সঙ্গেও নাকি তার চাÑসিগারেট খাওয়ার সম্পর্ক। বিদেশ থেকে যতো দামী ঔষধের ফর্মুলা আসে ও এই কারখানায় যেসব দামি ঔষধ তৈরি হয়- এগুলো ফ্রিজিংয়ের দায়িত্ব শরিফেরই। কারখানার ভেতরে কিছুটা ফাঁকা ও নিরিবিলি জায়গায় একটা বড় স্টোররুম আছে। যেখানে প্রবেশের একমাত্র অধিকার কেবল শরীফ মিয়ার।

শরীফ মিয়া বেশ কিছুদিন ধরে আলোকে বলে আসছে, তোমার কিন্তু আমার সঙ্গে স্টোররুমে যাওয়া উচিত। কোন ওষুধ কতো ডিগ্রি তাপমাত্রায় কতোদিন কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয় তা তুমি জানতে পারবা। এক নাগাড়ে শুধু কাজ করলেই তো প্রমোশন হয় না, কাজ মানেই নানা বিষয়ে জানা। যতো জানবা ততো অভিজ্ঞতা বাড়বো। আর যতো অভিজ্ঞতা ততো কদর।

আলোও কয়েকদিন ধরে ভাবছে যাবে সে শরীফ ভাইয়ের সঙ্গে। দেখে আসবে সবকিছু। আজ সকাল থেকে এখনও শরীফ ভাইকে এদিকে আসতে দেখেনি আলো, নানান কাজে ব্যস্ত থাকে লোকটা, হয়তো সময় পাচ্ছে না। আলো এসব কথা ভাবতে ভাবতেই শরীফ এসে পাশে দাঁড়ায় তার। আড়চোখে আলোকে দেখে নেয় শরীফ। বাহ! কী শারীরিক গড়ন, সবকিছু ঠিকঠাক। কোথাও কোনো কিছুর আধিক্য নেই। উপচে পড়ার ভনিতা নেই, না দেখতে পাবার শূন্যতাও নেই। আলো বুঝতে পারে শরীফ তাকে দেখছে। শরীফ এর আগে কথাবার্তায় অনেকবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে, আলোকে তার ভালো লাগে। কিন্তু কোনোদিন কোনো বাজে কথা বা ইঙ্গিত করেনি তাই আলো শরীফকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস দু’টোই করে।
-    আলো কেমন আছ?
-    ভালো শরীফ ভাই, আপনি ভালো তো?
-     হু, ভালো। শোনো আলো, তোমারে তো একটা কথা বলা হয় নাই, কাল থেকে আমি বেশ কিছুদিন ছুটিতে থাকবো তারপর এসে এই দায়িত্বে থাকবো কিনা জানি না। তুমি চাইলে আজ আমার সঙ্গে স্টোররুম দেখতে যাইতে পারো।
-    কই যাবেন?
-    এখনও জানি না। কয়েকদিন ধরেই কাজে মন বসতেছে না। তাই ভাবছি ঘুরে আসি।
আলো খানিকক্ষণ কী যেনো ভাবলো তারপর বললোÑ ঠিক আছে, ছুটির পর আপনি স্টোররুমের সামনে থাকবেন আমি আসবো। ছুটির পর আলো কারখানার পেছনে ভেতরের দিকে এগোতে থাকে। ধীরে ধীরে ঘন গাছগাছালির আড়ালে কারখানার কোলাহল ঢাকা পড়ে যায়। আলোর মনে হয়, সে তার গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছে। কারখানা থেকে স্টোররুম এতো দূর হবে সে ভাবতে পারেনি। কোথাও কাউকে চোখে পড়ছে না। আরে ওই তো শরীফ ভাইকে দেখা যাচ্ছে। স্টোররুমের সামনে।
-    কি আসতে ভয় লাগতেছে নাকি?
-    না, ভয় পাবো কেন?
শরীফের হাতে এক গোছা চাবি, সেখান থেকে বেছে একটি চাবি নিয়ে তালা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে রাশি রাশি অন্ধকার আর বরফশীতল ঠাণ্ডা গায়ে ধাক্কা দিলো আলোর। শরীফ ভেতরে ঢুকে সুইচ টিপে বাতি জ্বালালো। আলোকে বললো- ভেতরে আসো, ফ্রিজিং রুম সবসময় বন্ধ রাখতে হয়, তা না হলে দামি ওষুধপত্র সব নষ্ট হয়ে যায়।

আলো ভেতরে ঢুকলো, শরীফ দরজা ভেতর থেকে আটকে জুতা খুললো। তার দেখাদেখি আলোও খুললো। ঘরের কোণে আলমারি জাতীয় কিছু একটার উপর তালা টাকে রাখলো শরীফ। আলো দেখলো লম্বা করিডর, তার সামনে আরও একটা দরজা আটকানো কিন্তু তাতে তালা নেই। সে দেখলো, শরীফ মাথার উপরে ডান হাতে কিছু একটা ঘোরাতেই দরজা খুলে গেলো। তারা হেঁটে যতো সামনে এগোচ্ছে, ঠাণ্ডা ততো বাড়ছে। সামনে আরও একটি দরজা। শরীফ হাতের বামে কোথাও চাপ দিতেই দরজাটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। ওরা ভেতরে ঢুকতেই আবার আপনা আপনি আটকে গেলো দরজাটা। আলো খানিকটা হকচকিয়ে গেলো, বুঝলো এতো ঠাণ্ডার মধ্যেও প্রবল এক ঠাণ্ডা তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে, সে কি ভয় পাচ্ছে? না, ভয় পাবে কেন? শরীফের সর্ম্পকে এতোদিনে কোনো খারাপ রেকর্ড শোনেনি আলো। তাছাড়া শরীফ তাকে পছন্দ করে, আলোর কোনো ক্ষতি নিশ্চয়ই সে করবে না।

এতো ভাবনার পর হঠাৎ আলোর মনে হলো, সে এখানে এসেছে কেউ তা জানে না। কাউকে বলে আসতেও মনে ছিলো না। দু’জনের কেউ কোনো কথা বলছে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আলো চারিদিক লক্ষ্য করছে। শরীফ কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে, আলো এখনও দেখার মতো কিছুই পায়নি, যা দেখতে তার এখানে আসা। সামনে আরও একটি বিশাল দরজা, আলো আশা করছে নিশ্চয় এর ভিতরে সে দেখবে রাশি রাশি ঔষধ। শরীফ দরজার সামনে এগিয়ে গিয়ে চাবির গোছা থেকে একটি চাবি নিয়ে মোচড় দিতেই বিশাল দরজার মাঝ বরাবর খানিকটা খুললো, আলো বুঝতে পারলো এই দরজা পুরোটা খোলার ব্যবস্থাও আছে। শরীফ ভেতরে ঢুকে হাতের বায়ে কোনো একটা তাকে চাবির গোছা রেখে একটার পর একটা সুইচ টিপতে লাগলে ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘর আলোকিত হতে লাগলো আর আলোর সামনে কল্পিত কোনো নগর ভেসে উঠলো। এতো বড় ঘর আলো কোনোদিন দেখেনি। ঘরের মাঝখানে বিশাল এক টেবিল তার উপর রাখা হাজার হাজার যন্ত্রপাত্রি, সারি সারি কাচের বোতলে রাখা পাউডার, ট্যাবলেট, রঙিন পানি জাতীয় কিছু। ঘরের ডানে বায়ে চলে গেছে আরও ছোট ছোট গলি। ঘরের একটা দেয়াল জুড়ে বিশাল বিশাল ড্রয়ার। আলোর মনে পড়ে সে এইসব টিভিতে দেখেছে, এর মধ্যে মরদেহ সংরক্ষণ করা হয়। তবে কী এর মধ্যে মরদেহ? না, না এসব কী কথা ভাবছে সে। তা কেন হবে?

শরীফ বলে উঠলো- আলো তোমার খুব ঠাণ্ডা লাগতেছে? তুমি দেখতে থাকো, আমি ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে আসছি, তবে বেশি দূরে যেয়ো না।

শরীফ কোনো এক গলির মধ্যে হারিয়ে গেলো। আলোর ইচ্ছে করছে ড্রয়ারগুলো খুলে দেখে কী আছে এতে। সে খুলবে কী খুলবে না এই দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে দু’হাতের সব জোর দিয়ে একটা ড্রয়ার টান দিলো। অতি সাবধানে দৃষ্টি মেলে দেখলো- কিছুই নেই, খালি। বেশ খানিকটা সাহস খুঁজে পেলো আলো। এটা বন্ধ করে আরেকটা খুললো- হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো কোনো মেয়ের জামা, পায়জামা, ওড়না। এসব কেন এখানে? সঙ্গে সঙ্গে তার মনের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠলো- সাবধান আলো, সাবধান!

যেভাবে আছে ওভাবে রেখেই সে খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলো। এখানে পর্দা দিয়ে কোনোকিছু ঢাকা। আলো সাহস করে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দু’হাতে পর্দা সরালো। সারি সারি কাঁচের পাত্রে মানুষের হাত, পা, মগজ, হৃৎপিণ্ড সংরক্ষণ করা। আলোর গা গুলিয়ে আসতে লাগলো তবুও আস্তে আস্তে সে এগোতে লাগলো। ছোট গলিতে বাঁক নিতেই চিৎকার করে উঠলো। সামনে কাচের বক্সে দাঁড়িয়ে আছে বিবস্ত্র এক মেয়ে। তার সারা গায়ে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই শুধু চোখ দু’টো বলছে Ñ কোনোকিছু দেখে সে সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়েছিলো। আলো চিৎকার করে কিছু একটা আঁকড়ে ধরলো। নিচু ও আদুরে স্বরে কেউ তাকে ডাকলো, আলো। আলো বুঝলো সে শরীফকে আঁকড়ে ধরে আছে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিলো।

-    তুমি এখানে কেন আসছো? আহা! ভয় পেয়েছ? আসো আমার সঙ্গে আসো। শরীফ তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বিশাল ল্যাবরেটরির একটি চেয়ারে বসালো। ইস, তুমি তো গরমে ঘেমে গেছো, শরীফ আলোর গা থেকে ওড়নাটা খুলে মেঝেতে ফেলে দিলো। গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডটাও খুলে ফেললো। আলো বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। তার মনে পড়লো। জামার ভেতরে তার প্রথম বেতনের কেনা ছোট মোবাইলটা রয়েছে। সেকি কাউকে ফোন করবে? আলোর ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলোÑ শরীফ রেগে যায় এমন কিছু কোরো না। তোমার দুর্বলতা- তুমি মেয়ে, তোমার হাতিয়ার- তুমি মেয়ে।

আলো শুধু মুখে বললো- শরীফ ভাই এসব কী করছেন? শরীফ একটি আঙ্গুল দিয়ে আলোর ঠোঁট চেপে ধরলো। কোনো কথা বলো না আলো। তোমারে আজ মন ভরে দেখতে দাও।
শরীফ আলোর গালে হাত রাখলো। আবেগে আলোকে জাপটে ধরলো। আলো তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তেই শরীফের মাথায় আগুন ধরে গেলো। চিৎকার করে বলে উঠলোÑ আলো আমি চাইলে তোর সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। তোরে কুটি কুটি করে কেটে সাজিয়ে রাখতে পারি।

আলো ভয়ে আরও খানিকটা দূরে সরে গেলো। শরীফ আলোর কাছে গিয়ে শরীরে হাত বুলিয়ে বললো- না আলো, তুমি ভয় পেও না। আমি তা করবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আলো, এখানে এতো দামি দামি ঔষধের ফর্মুলা, এর শুধু একটা বাজারে ছেড়ে দিলে আমি কোটিপতি হয়ে যাবো। তারপর, তুমি আমি বিদেশ চলে যাবো। আমাদের সুখের সংসার হবে। তোমার কোলে বাচ্চা আসবে, ফুটফুটে একটা বাচ্চা, একটা মেয়ে। না না মেয়ে না, দুষ্টু একটা ছেলে হবে।

আলোর মাথায় কিছুই আসছে না। শরীফ এক ঝটকায় আলোকে কোলে তুলে নিলো। মাঝারি আকারের খালি এক টেবিলে আলোকে শুইয়ে দিলো শরীফ। আলোর মাথার বামপাশে মাঝারি আকারের কাচের বোতল, তার ভিতর সিরিঞ্জে ভরা কোনো ওষুধ। শরীফ গায়ের জামা খুলে আলোর পাশে শুয়ে পড়লো। আলো হাতে একটা বোতল নিয়ে শরীফের মাথায় বাড়ি দিলো। ক’টা বাড়ি দিলো জানে না। শরীফ চিৎকার করে গাল দিলো- মাগী তোর এতো বড় সাহস। শরীফ মাথায় হাত দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। বোতল ভেঙে সিরিঞ্জ মেঝেতে পড়ে আছে। আলো দৌড়ে মেঝের একপাশে পড়ে থাকা ওড়না আর আইডি কার্ড নিতে নিচু হলো, শরীফ পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে মেঝেতে শুইয়ে দিলো, দপাদপ চড় মারলো আলোর গালে।

ধস্তাধস্তিতে গড়াগড়ি খেলো দু’জনে। এপাশ ওপাশ, হঠাৎ আলো ডান হাতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব টের পেলো। বুঝতে পারলো ওষুধ ভরা সিরিঞ্জ। কোনোকিছু না ভেবে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বসিয়ে দিলো শরীফের কাঁধে। শরীফ চিৎকার করে আলোকে ছেড়ে কাঁধে হাত দিলো। আলো দ্রুত সরে গিয়ে ওড়না আর আইডি কার্ড ছোঁ মেরে তুলে দৌড়। বিশাল ঘরের ছোট দরজার ফাঁক দিয়ে বের হওয়ার সময় তার মনে পড়লো চাবির কথা। সে এক পা থেমে তাকের উপর থেকে চাবির গোছা নিয়ে দৌড় দিলো। সে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, শরীফ তার পিছনে আসছে আর বলছেÑ কী করলে আলো, আমার সব শেষ করে দিলে। আলো দৌড়াতে দৌড়াতে চাবি আর আইডি কার্ড বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো, ওড়না বাঁধলো কোমরে। সামনে বন্ধ প্রাচীর, বাইরে থেকে সে এটা খুলতে দেখেছে কিন্তু ভেতর দিয়ে কী করে খোলে তাতো জানে না। সে লাফ দিয়ে প্রাচীর ধরার চেষ্টা করলো, পারলো না। অনেকবার করার পর শেষ বার এক চিৎকারে নিজেকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে প্রাচীর ধরে ফেললো আর নিচ থেকে টান লাগলো তার পায়ে, শরীফ আলোর এক পা ধরে রইলো। ওষুধের তীব্রতায় শরীফ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, দুর্বল হাতে কেবল আলোর এক পা ধরে আছে। আলো কাঁধ ঘুরিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে এক লাথিতে শরীফকে নিচে ফেলে দিলো। শরীফের ভেতর থেকে ঘোৎ করে একটা শব্দ বেরিয়ে আসলো। আলো এক লাফে নিচে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলো প্রথম দরজার কাছে। এখানে শরীফ তালাটা রেখেছে এবং ওরা জুতা খুলে ঢুকেছিলো। আলো এদিক ওদিক তাকাতেই তালাটা পেয়ে গেলো এবং নিজের জুতা পায়ে গলিয়ে ভারী পাতের আংটা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজা বাইরে থেকে আটকে হাতের তালাটা টিপে দিলো। আলো দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দু’মিনিট দাঁড়িয়ে রইলো। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে, শরীর বেয়ে টপাটপ ঘাম পড়ছে।

অজানা আতঙ্কে একটানে চোখ খুলে ফেললো, এতোক্ষণে সে দেখলো চারপাশে অন্ধকার। ক’টা বাজে তার কোনো আন্দাজ করতে পারলো না। কেউ কি আমাকে দেখেছে? হয়তো না। কেউ দেখার আগেই এই সীমানা ছেড়ে বেরোতে হবে। আলো জামায় মুখের ঘাম মুছলো। আইডি কার্ড বের করে গলায় ঝোলালো। ওড়নাটা খুলে মাথায় ছোট করে একটা ঘোমটা দিলো। অন্ধকার পেরিয়ে ধীরে ধীরে সে কারখানার কাছাকাছি আলোর দিকে এগিয়ে আসলো। এখনও অনেক কর্মী ঢুকছে বের হচ্ছে। সর্তকতার সঙ্গে তাদের মাঝে নিজেকে মিশিয়ে দিলো আলো। কারখানার গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। আলো হাঁটতে লাগলো, কতোটা পথ হেঁটেছে, কেন হাঁটছে সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। না তার ফোন নয়, পাশ দিয়ে চলা কোনো পথচারীর। আলোর মনে পড়লো, নিজের মোবাইলটার কথা। জামার ভেতর থেকে চাবির গোছা আর মোবাইলটা বের করে আনলো। ধস্তাধস্তিতে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেছে। সে চাবির গোছাটার দিকে তাকিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। তেজগাঁও এলাকায় অসংখ্য ম্যানহোল ঢাকনা ছাড়া হাঁ হয়ে আছে একটু অসাবধানতায় পথচারীকে গিলে খাবার জন্য। তারই একটির পাশ দিয়ে হাঁটার সময় খুব ধীরে হাত থেকে ফেলে দিলো চাবির গোছা। সোডিয়াম বাতির আধো আলো আধো অন্ধকারে সে হাঁটছে তো হাঁটছে। সে জানে না কী হয়েছে, আজ আর কী হবে বা কাল। সে শুধু জানে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে এসেছে, আরও অনেক পথ তাকে হাঁটতে হবে। অন্ধকার পেরিয়ে আলোতে তাকে পৌঁছাতেই হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৬
এসএমএন/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।