ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ছারপোকা | মাহফুজুল আলম খান

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৭
ছারপোকা | মাহফুজুল আলম খান ছারপোকা | মাহফুজুল আলম খান

"একটি ছারপোকা কতোদিন বাঁচে?" এই প্রশ্নটি টোকনের মাথায় অনেকবার এসেছে। কারণ, একটা ছারপোকাকেও সে আয়ু ফুরিয়ে মরতে দেখেনি। ডিম, বাচ্চা, তাগড়া, পুরুষ্ট— অনেক প্রকার ছারপোকা তার বালিশের কোণে, বেডের ধারে বসতি গড়ে তুলেছে। দু'একদিন পরপর এদের বংশকে নির্বংশ করে সে। তবুও কোত্থেকে চলে এসে আবার বসতি গাড়ে তার আশেপাশে।

একটু একটু ঘুম চোখে এলে কুটুস করে কামড় বসায় ছারপোকা। টোকন দুই আঙুলে চেপে মেরে ফেলে তাদের।

সঙ্গে সঙ্গে তার গা শিউরে ওঠে ঘেন্নায়। গন্ধটাও কেমন যেনো লাগে। বুড়ো-বুড়িরা বলে, ছারপোকা মেরে নাকি শুঁকে দেখতে হয়। সেও শুঁকে দেখে। কেন জানে না। বুড়ো-বুড়িরা অনেক কথাই বলে কিন্তু কার্যকারণ বলে না।

মাঝে মাঝে টোকনের পরনের কাপড়ের ভেতরও দু'একটা ছারপোকা ঢুকে যায়। অফিসের বস, ম্যানেজার কিংবা ঊর্ধ্বতন কারও সঙ্গে আলাপ-সালাপের সময় কাপড়ের ভেতরে থাকা ছারপোকা কামড়সমেত তার অস্তিত্ব জানান দেয়।

টোকনের ইচ্ছে করে তখন ছুরি দিয়ে তার জানটা ফালা ফালা করে ফেলে। বসের সামনে কামড় সহ্য করে থাকে। পরে বাথরুমে গিয়ে কাপড় খুলে তাকে খুঁজে বের করে জন্মের সাজা দিয়ে দেয়।

দুবাইতে এই হত্যাযজ্ঞ আর বিরক্তিকর কাণ্ডটা নৈমিত্তিক। দু'শ বর্গফুটের একটা রুমে পনের-বিশজন মতো থাকে টোকনরা। প্রথম যেদিন এসেছিল সে, রুমে ঢুকেই বিছানাগুলো দেখে মনে মনে হেসেছিল সে। এ কেমন বিছানা! একটার উপর একটা। তিনতলা বিছানা। সবার নিচে একজন ফ্লোরে, আরেকজন তার আড়াই হাত উপরে, তার আড়াই হাত উপরে আরকজন। স্টিলের চৌকিগুলোতে ছোট একটা সিঁড়িও আছে। তাতে ওঠা-নামা চলে।

আয়ুব টোকনের রুমমেট। সে চলে যাওয়ার পর থেকে টোকনের ঝামেলাটা আরও বেড়ে যায়। ছেলেটা রান্না ভাল জানত। টোকনের রান্নার পালা এলে মাঝে মাঝে সে রেঁধে দিত। রুমের মধ্যে যে পনের-বিশজন থাকে তারা সবাই বাঙালি। একেকজন একেক জায়গায় চাকরি করে। মাসে তিনশো দিরহাম এক বিছানার ভাড়া হিসেবে দিতে হয় তাদের। পনের-বিশজন একদেশের মানুষ, এক জাতি। চাইলে তারা একসঙ্গে মেস সিস্টেমে বাবুর্চি রেখে দুইবেলা রান্নাবান্নার একটা গতি করা করতে পারে। কিন্তু বাঙালি জাতির যে স্বভাব, একসঙ্গে সপ্তাহখানেকের চেয়ে বেশি টিকতে পারে না। কোনো কিছুতেই বনিবনা হয় না। তুচ্ছ, অর্থহীন ব্যাপার নিয়ে প্রথমে চলবে বাড়াবাড়ি তারপর উত্তেজনা। নিমেষেই উত্তেজনা রূপ নেয় ক্রোধে। তারপর আক্রমণ। সামান্য 'জুতো'র বিষয় নিয়েও খুনোখুনি করে বাঙালিরা। পছন্দের 'চ্যানেল' দেখা নিয়েও খুন করতে দ্বিধা করে না। কী আশ্চর্য! এই অসভ্য, বর্বর আচরণের কারণে মধ্যেপ্রাচ্যে বাঙালিরা অন্যান্য জাতির কাছে মাথামোটা জাতি হিসেবে পরিচিত।

টোকনদের এক রুমের মধ্যেই তিন-চারটা মেস। কেউ শুধু একজনই এক মেস। কেউ কেউ দু'তিন জন মিলে মেস আবার কেউ চার-পাঁচ জনের মেস। টোকন, আয়ুব, মতিন, আতাউর চারজনে ছিলো একটা মেস। আয়ুব একটি লন্ড্রিতে চাকরি করত। সহজ-সরল ছেলেটা টোকনের সঙ্গে পটত খুব। কাজের ফাঁকে যখনই অবসর মিলত টোকনের সঙ্গে গুনগুন করে নানান কথাই বলে যেত। মাঝে মাঝে টোকন বিরক্ত হয়ে ওঠত। তারপরও তাকে সঙ্গ দিত। বিরক্তির ব্যাপারটা তাকে বুঝতে দিত না টোকন।

আয়ুব তার মা'র কথা বলত। বোনের কথা বলত। ছোট ভাইয়ের কথাও বলত। প্রবাসে এই এক কাণ্ড। একসঙ্গে থাকা মানুষগুলো একজন আরেকজনকে নিজের ব্যক্তিগত অনেক কথাই শেয়ার করে। কার বউয়ের বাচ্চা হয় না, কার বউয়ে কেমন ঢং করে— সেগুলোও বাদ যায় না।

আয়ুবদের পরিবারে সে ছিলো সবার বড়। এরপরে দুই বোন শেষে এক ভাই। ছোট ভাইয়ের জন্মের বছর দু'য়েক পরে হঠাৎ আয়ুবের বাবা মারা যায়। ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে দু'চোখে আঁধার দেখে আয়ুবের মা। মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল আয়ুব। আর পড়া হয়নি। সংসারের হাল ধরে ফেলে সে। হাতের কাছে যে কাজ পেত তাই করত।
শেষে কাকে কাকে ধরে অনেক ধার দেনা করে তাকে বিদেশ পাঠায় তার মা।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে দুবাই আসে আয়ুব। মাকে আর কষ্ট করতে হবে না। বোন দু’টির ভালোমতো বিয়ে দিতে পারবে। ছোট ভাইটিও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে। যতো কষ্ট হোক ভাইকে সে পড়ালেখা থেকে নামাবে না।

টোকনকে একদিন বলেছিল সে, তার ভাই পড়ালেখায় অনেক ভালো, ভাইকে সে ডাক্তার বানাবে। সাধারণ মানুষদের এই একটাই শখ, প্রিয়জনকে ডাক্তার বানানো। এতোগুলো পেশা থাকতে ডাক্তার বানানোর প্রতি সবার ধ্যান! ডাক্তারের কাছে রোগীরা কেমন যেনো ছারপোকার মতো। যতোক্ষণ কাছে থাকে ডাক্তারবাবু বালাইটাকে খুব দ্রুততার সঙ্গে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলেই যেনো বাঁচে। মানুষের প্রতি ডাক্তারের এই দুর্লভ আর দুর্গম 'ভাব' থেকেই সাধারণ মানুষগুলোর ভেতরে তার প্রিয়জনদের ডাক্তার বানানোর ইচ্ছারা তড়পায়।

আয়ুব একদিন মলিন মুখে এসে টোকনকে বলে, 'টোকন ভাই, আমার বোনের জন্য একটা সম্মন্ধ এসেছে’।
টোকন খুশি হয়ে বলে, ‘ভালোতো। ছেলে কেমন? কি করে?’
-‘ব্যবসা করে। বাজারে মুদির দোকান আছে। দেখতে শুনতে ভালো। আমাদের এলাকার’।
-‘ভালো লাগলে খোঁজখবর নিয়ে সামনে এগুতে পারো’।
-‘মায়ের সঙ্গে এক প্রকার কথা হয়েছে’।
-‘কেমন?'
-‘বরের পক্ষে চাহিদা, পাঁচশোজনকে খাওয়ানো আর কিছু ফার্নিচার। '
-‘মন্দ হবে না। আজকাল বরপক্ষ কম করে চাইলেও তো এতোটুক চায়। '
-হ্যাঁ, টোকন ভাই। চাহিদা অবশ্য বেশি নয়। তবে আমাদের যে অবস্থা সেটা পূরণেও হিমশিম খেতে হবে দেখছি। ' (আয়ুবের চোখে-মুখে গভীর চিন্তার চাপ)

টোকন তাকে আশ্বস্ত করে বলে, 'চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে’।
পৃথিবীতে মনে হয় "চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে"এই কথাটিই বহুল প্রচলিত ও অর্থহীন বাক্য। কারণ, যে বলে সেও জানে এই কথাতে কোনো সমাধান নেই, আবার যাকে বলা হয় সেও জানে এটা কোনো সমাধান নয়। তবুও আশ্বাসে-প্রশ্বাসে এই অর্থহীন বাক্যটিই সান্ত্বনাদাতার মুখ দিয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।

আয়ুবকে দেখা গেলো আরেকদিন বিষণ্নমুখে টোকনের কাছে এসে বলে, টোকন ভাই আমার বোনের বিয়ে ভেঙে গেছে।
-‘কেন!কেন! (টোকন ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে)
-‘ওদের চাহিদা পূরণ করতে পারছি না বলে। '
-‘তাই নাকি! তোমরা টাকা জোগাড় করতে পারনি?'
-‘না। টাকা জোগাড় করার মানুষতো আমি একজনই। আমার সামান্য বেতন দিয়ে কোনোরকমে ভাই-বোনদের চালাই। তার উপর ভিসার ধার-দেনাও এখনও পুরোপুরি শোধ হয়নি। '

কথা শেষ করে আয়ুবের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। টোকনেরও কিছু বলার ছিলো না। বড় একটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে সে শুধু বলে, হ...।

অনেকদিন পর হঠাৎ আয়ুবের মধ্যে কেমন যেনো একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করে টোকন। কেমন যেনো গম্ভীর হয়ে গেছে। ছেলেটি এমনিতেই হড়বড় করে অনেক কথাই বলে। যা বলা যায় তাও বলে, যা বলা যায় না তাও বলে। সশব্দে হাসি দিয়ে ঘরটাকে হাসির ফোয়ারার মতো করে রাখে। তার সরলতা টোকন বুঝতে পারে বলে তাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়ে যায়।

আয়ুবের একটা বোকামির স্মৃতিও আছে। সেটা আয়ুব নিজের মুখে বলেছে। 'নাইন-টেনে পড়ার সময় নাকি এক মেয়ে আয়ুবকে একটা ভালোবাসার চিরকুট দিয়েছিল। সেই চিরকুটের জবাব দিতে গিয়ে সে চিরকুটসহ ধরা পড়ে যায় মেয়ের বাবার হাতে। আর অমনি সে চোখের পলকেই চিরকুটটি মুখে নিয়ে চিবিয়ে গিলে ফেলে। '

ব্যাপারটা নিয়ে রুমের সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। বেচারা আয়ুব সরল বলে টোকনদের কাছে কিছু লুকোয়নি। এই সরলতা জিনিসটা জায়গামতো না হলে কিন্তু খবর আছে।

এর মূল্য, মর্যাদা সব জায়গায় পাওয়া যায় না। কিছু মানুষ অন্যের সরলতা, দুর্বলতা ঠিক কোন জায়গায় সেটাই খুঁজে বেড়ায়। একবার নাগাল পেলে পাছায় দাবড়ানি দিয়ে সরলতার গোষ্ঠীসুদ্ধ বের করে দেয়।

আয়ুবের হঠাৎ পরিবর্তনের বিষয়টি খেয়াল করে টোকন। আয়ুব কথাবার্তায় কেমন যেনো হিসেবি হয়ে গেছে। গম্ভীর মুখে কী যেনো ভাবতে থাকে সারাক্ষণ।

একদিন টোকন জিজ্ঞেস করল, 'আয়ুব তোমার অসুখ-বিসুখ করেনি তো? আজকাল তোমার হাসির শব্দ শোনা যায় না?'
-‘না, না টোকন ভাই। আমি ঠিক আছি'। বলেই সে একটু হাসার চেষ্টা করে।

টোকন বুঝল, এই হাসিটা কৃত্রিম। এর পেছনে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। অনেক মানুষ ভেতরে বিরাট একটি অস্বস্তি রেখে উপরে কৃত্রিম হাসিমুখে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে যায়, তাকে দেখে সেটাই মনে হলো।

টোকনের সন্দেহটাই ঠিক হলো। কয়েকদিন পর সে টোকনের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘টোকন ভাই, আপনাকে বলছি কাউকে বলবেন না, আমি আগামী সপ্তাহে গ্রিস চলে যাবো’।
টোকন সাপ দেখার মতো চমকে ওঠে। গ্রিস চলে যাবে? গ্রিসটা এমনভাবে বলল যেনো এটা তার নানার বাড়ির উঠোন!

বিস্ময় নিয়ে টোকন তাকে বলল, কী বলছ?
-‘হ্যাঁ, টোকন ভাই। আমার সবকিছুই রেডি হয়ে গেছে। আগামী শুক্রবারে বের হয়ে যাবো। কাউকে বলবেন না প্লিজ।

আয়ুব বুঝল, ছেলেটি কোনো দালালের পাল্লায় পড়েছে নিশ্চয়। সরল টাইপের ছেলে দেখে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে।

টোকন স্বাভাবিক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আয়ুব তুমি কি জানো দুবাই থেকে গ্রিস কোন দিকে?'
সে একটু থতমত খেলো। আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি মূর্খ মানুষ। আমি কী জানি গ্রিস কোনদিকে’!
টোকন এক গাল হেসে বলল, গ্রিস কোনদিকে জানো না। কয়টা দেশের বর্ডার পার হয়ে সেখানে যেতে হয় জানো না, তুমি যেতে চাচ্ছ গ্রিসে?'

-'আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি যাবই। সেখানে আমার এক চাচাতো ভাই আছে। সে এখান থেকে দালাল ধরে গিয়েছিল। সে এখন লাখ লাখ টাকার মালিক। তার সঙ্গে কথা বলেছি, সেও বলল চলে আয়। '
'লাখ লাখ টাকা' কথাটা শুনে মন খারাপের ভেতরেও হাসি পায় টোকনের। মনে হলো গ্রিসে টাকা বাতাসে ওড়ে।

জানটা হাতে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কোনোরকমে একবার সেখানে পৌঁছুতে পারলেই হয়। লাখ লাখ টাকার মালিক। লাখ থেকে কোটি টাকা। তারপর আয়ুবদের আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। দুই বোনকে খুব ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারবে। ভাইকে ডাক্তার বানাবে। একটা পাকাবাড়িও হয়ে যাবে তাদের। মাকে হজে নিয়ে যাবে। ফুটফুটে একটা বউ হবে আয়ুবের। পয়সাওয়ালা হলে সুন্দর বউ পাওয়া যায়।

টোকন আয়ুবের দিকে তাকিয়ে দেখল। তার চোখে-মুখে যেনো ঠিক এই জাতীয় স্বপ্নগুলোর খেলা চলছে।
টোকন খবর নিয়ে দেখল, দুবাইতে বেশকিছু দালাল চক্র রয়েছে। এরা সহজ-সরল হতাশাগ্রস্তদের টার্গেট করে ফুসলিয়ে ইউরোপের দেশ গ্রিস, তুরস্কে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কিছু টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। টোকন পেপার-পত্রিকায়ও পড়েছে অনেক অভাগা বাঙালির এই ধরনের ভয়ংকর বিলাসী আকাঙ্ক্ষার কথা। দালালের খপ্পরে পড়ে দুবাই থেকে গ্রিস পাড়ি দেওয়া এক ছেলের অভিজ্ঞতা পড়েছিল টোকন একটি ম্যাগাজিনে।

"রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার আশায় দুবাই থেকে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে সেই ছেলেটি। দালাল তার মতো আরও ১৫-২০ জনকে একত্রে গ্রিস নিয়ে যাওয়ার জন্য আমিরাত এর আল আইন শহরের একটি রুমে এনে বন্দির মতো করে রাখে। দু'দিন পর এক রাতে ওখান থেকে গাড়ি করে ওমান বর্ডারের কাছাকাছি এনে তাদেরকে নামিয়ে দেয়। তারপর শুরু হয় হাঁটা। আগেই তাদেরকে দালালদের পক্ষ থেকে ট্রেনিংয়ের মতো সবকিছু বলে দেওয়া হয়। তাদেরকে যেতে হয় দুর্গম পথ দিয়ে। যেখানে সে দেশের বর্ডার গার্ড সিকিউরিটিরা তেমন থাকে না সে জায়গা দিয়ে। সেটা গহীন অরণ্য, মরুভূমি কিংবা জলাভূমিও হতে পারে। প্রথমে পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে ওমানে ঢুকতে হবে। সেখান থেকে উপসাগর পার হয়ে ইরান সীমান্তে পৌঁছুতে হবে। ইরান থেকে ইরাক। ইরাক থেকে তুরস্ক। শেষে যারা যারা বেঁচে থাকবে তারা প্রাণটা হাতে নিয়ে তুরস্ক থেকে সীমান্ত পার হয়ে গ্রিসে ঢুকে যেতে পারলেই কাহিনী খতম। বাঙালিকে কোটিপতি হতে আর ঠেকায় কে?

রাতের অন্ধকারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, পায়ে হেঁটে, দৌড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে তাদের বর্ডার পার হতে হয়। দিনের বেলায় দুর্গম অঞ্চলে তাদের লুকিয়ে থাকতে হয়। রাতের আঁধারে তাদের অভিযান। দুর্বল হলে চলবে না। তাদের দলে একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় দালাল তাকে ছুরি মেরে হত্যা করে বালিতে পুঁতে রেখে বাকিদের নিয়ে অভিযান চালু রাখে। ওমানেও তাদের দালাল আছে। দালাল তাদেরকে উপসাগরের একটি বোটে তুলে দেয়। উপসাগর পার হয়ে ইরানে পৌঁছুতে হবে। ইরান থেকে একইভাবে জল, স্থল, পাহাড় ডিঙিয়ে বর্ডার গার্ড সিকিউরিটিকে ফাঁকি দিয়ে ইরাকে, তারপর তুরস্ক এরপর গ্রিস সীমান্তে ঢুকতে হবে। সীমান্তে বর্ডার গার্ডের গুলিতে প্রাণও যেতে পারে। আবার ধরা খেলে সাজা শাস্তির পর বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার ঝুঁকিও আছে। অনেক সীমান্ত বর্ডার গার্ডের অলক্ষ্যে জলাভূমি সাঁতরেও পার হতে হয়। ”

টোকন আয়ুবকে ডেকে একদিন বোঝানোর চেষ্টা করল। ম্যাগাজিনের সমস্ত ঘটনা তাকে জানানোর পর বলল, 'আয়ুব তুমি যে কাজে নেমেছ সেখানে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অথচ তোমাকে তোমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে থাকাটা জরুরি’।
আয়ুব মাথা নেড়ে বলল, ‘যেভাবে হোক আমার ভাগ্যটা আমি একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই। মরলে মরব তবুও পিছে হটব না'।
আয়ুবের কথা শুনে টোকনের মনে হলো, এতোক্ষনের প্যানপ্যানানি সে কিছুই কানে নেয়নি। 'মরলে মরব' এটা শুনে মনে হলো মৃত্যু জিনিসটা তার কাছে পানিভাতের মতো সোজা। রাস্তাঘাটে হঠাৎ কেউ আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে আবার যেমন দাঁড়িয়ে যায়, মৃত্যুটা মনে হলো তার কাছে আছাড় খাওয়ার মতোই। ইচ্ছে করলেই আবার গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে আরেকবার তার চোখের সামনে পথের সমূহ মৃত্যুঝুঁকি তুলে ধরার চেষ্টা করল টোকন। কিন্তু আয়ুব তার সিদ্ধান্তে নাছোড়বান্দা।

শেষে টোকন তাকে রাগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একটি কথা বলেই ফেলে, ‘আয়ুব, তুমি আমার কথাতো শুনলে না তবে একটা কথা মনে রাখো, গ্রিস যাওয়ার পথে কোনো দেশের বর্ডারে যখন তুমি গুলি খেয়ে ধীরে ধীরে মারা যাবে ঠিক সেসময় আমার কথাগুলো স্মরণে আনার চেষ্টা করিও’। আয়ুবের সঙ্গে এটাই শেষ কথা ছিলো টোকনের।

সত্যিই একদিন আয়ুব চলে যায়। খবরটা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় টোকনের। ছেলেটি সারাক্ষণ হাসি হাসি মুখ করে থাকতো। ঘরটাকে মাতিয়ে রাখতো। যাবার বেলায় কী একটা অলুক্ষণে কথা বলেছে টোকন। নিশ্চয় সে মনে কষ্ট পেয়েছে। সবকিছুতে তার এতো সিরিয়াসলি ভাবাটা ঠিক না। কতো মানুষেই তো এভাবে যাচ্ছে। পৌঁছে যাচ্ছে।
টোকন কামনা করে, আয়ুবও পৌঁছে যাক তার স্বপ্নের দেশে। তার স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে যাক। হাতে ছুঁয়ে দেখুক সব স্বপ্নকে। স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার মতো আনন্দ পৃথিবীতে মনে হয় আর কিছুতেই নেই।

আয়ুব চলে যাওয়ার প্রায়ই দুইমাস হয়ে গেলো। টোকনদের মেসটাও ভেঙে-চুরে সদস্য সংখ্যা একজন একজন হয়ে গেলো। যতোজন মানুষ ততোটি মেস। আতাউরের সঙ্গে মতিনের তুমুল ঝগড়ার পর মেসের এই অবস্থা। আতাউর ছেলেটা দর্জির দোকানে কাজ করে। কিন্তু তার ভাবসাব যেনো এমন, সে বারাক ওবামার পিএস। রুমে এলে সারাক্ষণ ভ্যান ভ্যান করে। ওয়াশিংটন থেকে ঢাকা পর্যন্ত এমন কোনো বিষয় নেই যে সে জানে না। সর্ববিদ্যা বিশারদ। কেউ কিছু বললেই মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে পাণ্ডিত্য জাহির করে। পণ্ডিতি করতে গিয়ে প্রায় সময়ই রুমের একজনের সঙ্গে আরেকজন লেগে যায়। কয়েকবার মতিনের সঙ্গে ধরাধরিও হয়ে যায় তার। জুতাপেটাও চলে। লজ্জা-শরমের বালাই নেই ছেলেটির।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন কে যেনো টোকনকে এসে বলল, ‘আয়ুব নামের যে ছেলেটি আপনাদের রুমে থাকত সে মারা গেছে’।
কাছের কেউ মারা গেলে 'মারা গেছে' শব্দটা এভাবে হঠাৎ করে বলা ঠিক না। একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে বললে ভালো। আয়ুব টোকনদের রক্তের কেউ না। তবুও একসঙ্গে থাকত বলে 'কাছের কেউ' হয়ে গেছে।

খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তেই টোকনের সারা শরীরে যেনো বরফের স্রোত বয়ে গেলো। মনে হলো, মাটিতে দেবে গেলো হাতখানেক। লম্বা একটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে অজান্তেই তার মুখ দিয়ে একটি আফসোস সূচক শব্দ বের হয়ে গেলো। টোকন খবর নিয়ে জানতে পারল ঘটনা ঠিক। গ্রিসে থাকা আয়ুবের চাচাতো ভাইই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। আয়ুবদের দলের বিশ-পঁচিশ জন থেকে কেবল তিন-চার জন গ্রিসে পৌঁছুতে পেরেছিল। বাকিরা সবাই কোনো না কোনো দেশের বর্ডারে গুলি খেয়ে মরে গেছে। খবরটা শুনে সারাটা দিন কেমন জানি ঘোরের মধ্যে কেটেছে টোকনের। ছেলেটার কথা খুব মনে পড়েছে তার।

মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ছারপোকার কামড়ে ঘুম ভেঙে যায় টোকনের। ঘুম জড়ানো চোখ না খুলেই ছারপোকাকে হাতড়ে ধরে ফেলে। দুই আঙুলে চেপে মেরে কামড়ের মজা বুঝিয়ে দেয় তাকে।

ছারপোকার জাত। বর্ডার চেনে না। টোকনের বর্ডারে এসেই শুধু জ্বালাতন করে। 'বর্ডার' শব্দটা মনে পড়তেই আয়ুবের কথাও মনে পড়ে গেলো তার। কোনো এক দেশের বর্ডারেই সে মারা পড়েছিল। গুলিটা ঠিক কোথায় লেগেছিল তার? মাথায়? বুকে? তবুও সে প্রাণপণে পালাতে চেয়েছিল নিশ্চয়? বেচারা পালাতে পারেনি। ধীরে ধীরে শরীরের সব রক্ত বের হয়ে শরীরটা অসাড় হয়ে পড়েছিল কোথাও।

তার সম্পর্কে অনেক কিছুই ভাবে টোকন। আচ্ছা, সে কি শহীদের মৃত্যু পাবে? যারা দেশের জন্য, ধর্মের জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দেয় তারাই নাকি শহীদের মৃত্যু পায়। আয়ুবেরা চোর। অসভ্য ছারপোকার মতো। বর্ডার চেনে না। এরা শহীদের মৃত্যু পাবে না। চোখের তারার ভেতর স্বপ্ন নিয়ে, চুরি করে বর্ডার পার হয়ে স্বপ্নগুলোকে ছুঁতে চেয়েছিল তারা। ছারপোকাদের আবার স্বপ্ন কিসের!

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৭
এসএনএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।