ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রক্তের খেলা | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৭
রক্তের খেলা | তানিয়া চক্রবর্তী রক্তের খেলা | তানিয়া চক্রবর্তী

মানুষের সচেতন শ্লাঘায় দেদার মিলন ঘটে পৃথিবীর আলো মাখে মানবশিশু, রক্ত-মাংসের উচ্চকিত শিল্প! সেই চামড়া আর চামড়ার প্রেম এই বিশ্বের ভিত্তি হয়ে বেঁচে আছে! এই সেই চামড়া যা দেখে নারী-পুরুষ রোমাঞ্চকর সব শিল্প বানিয়েছে, এই সেই চামড়া যার গায়ে গা লেগে শিশু পুলকিত হয়ে বাড়ে— এই সেই চামড়া যার প্রসাধনে আমরা নিজেদের পাগল করে দিতে পারি! আর সেই চামড়া যখন অযাচিতভাবে খুলে দেয় রক্তের বন্যা তখন শুরু হয় জীবনের অভিশাপ— হ্যাঁ খুন, খুন সেই অভিশাপ।

এমনিই এই নশ্বর দেহ অনন্তের অধিকারী নয়, তারপরও তাকে নিয়ে হানাহানির খেলা। যে রঙ ভালোবাসার আদি সংকেত, যে গোলাপের লাল পৃথিবীর প্রেম বাড়িয়ে তোলে— সেই লাল রঙ রক্তের নিশানা হয়ে জীবনের মানেই বদলে দেয়! হিব্রু বাইবেল ও কোরান মতে, পৃথিবীর প্রথম খুন হয় আদম ও ইভের সন্তানের মধ্যে।

মিথ অনু্যায়ী, তারা দুই ভাই— কেন আর অ্যাবেল। কেন অ্যাবেলকে হত্যা করে, এটাই প্রথম খুন হিসেবে ধরা হয়। সাধারণত যারা অপরাধপ্রবণতা থেকে খুন করতে ভালোবাসে তাদের মনের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তারা শিশুবেলায় বিভিন্ন অত্যাচারের শিকার! দেখা যায়, বাবা-মায়ের কাছ থেকে সঠিক ও পর্যাপ্ত স্নেহ না পাওয়া, অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলীর সম্মুখস্থ হওয়া, কিংবা পরিবারের কাছ থেকে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া ইত্যাদি শিশুর অজান্তেই অনেকসময় তার মধ্যে খারাপ ভাব নিয়ে আসে! সাইকোলজির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখে মনোবিদরা বলেছেন, যে সময়টা স্বপ্ন আর সুরক্ষার বন্ধনে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেইসময় প্রথমত যদি তাকে অকারণ লজ্জা দেওয়া হয়, নগণ্য বোধ করানো হয়, পারিবারিক অশান্তি দেখানো হয় তবে তার ভাবাবেগের জায়গা নষ্ট হতে শুরু করে। তার অনুভূতি পরিপূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

মনোভাব তৈরির কতোগুলো উপাদান আছে: ১. জ্ঞানমূলক উপাদান, ২. অনুভূতিমূলক উপাদান ও ৩. সক্রিয়তামূলক উপাদান— এইগুলির যথাযথ প্রভাব না থাকলে সমস্যা দানা বাঁধতে পারে! অপসংগতির কারণে খুনি জন্মাতে পারে: ১. ভেতরের দ্বন্দ্ব, ২. নিরাপত্তাহীনতা, ৩. আক্রমণাত্মক ভাব ও ৪. অপরাধবোধ। .মনোবিদ স্ট্র্যাং বলেন, শিশুর জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর চূড়ান্ত যত্ন প্রয়োজন, এটা মানসিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময়। তবে অবশ্য এর সিদ্ধান্ত এটা নয় যে, জীবনকে জটিল পেলেই ক্রিমিনাল হয়ে যাবে মানুষ! তবে ক্রিমিনালদের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্যের মিল দেখা গেছে!

এবার আসি রহস্যময়, বিপজ্জনক কিছু খুনের কথায়! এর কথা গল্প-সিনেমায় আমরা সবাই শুনেছি, নাম “জ্যাক দ্য রিপার”। এর চেয়ে বড় বড় বীভৎস খুনিরা থাকলেও একসময় তার ভয় একটা আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল, ফলে তিনি এখনও যেনো ত্রাসের ইতিহাস! উনিশ শতকে তার মতো আতঙ্ক আর কেউ ছড়াতে পারেননি! ১৮৮৮ সাল থেকে ১৮৯১ এই সময়ের মধ্যে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় ১১টি খুন করেছিলেন! কিন্তু তাকে দেখার সেই সৌভাগ্য তথা দুর্ভাগ্য জীবন্ত কারোর হয়নি! খুনের পর তার দায় স্বীকার করে উক্ত নামের স্বাক্ষরে তিনি চিঠি পাঠাতেন নিউজ এজেন্সির কাছে। তিনজন ব্যক্তিকে অবশ্য সেসময় সন্দেহ করা হয়, কিন্তু ওই পর্যন্তই! তিনি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেহব্যবসায়ী নারীদের খুন করতেন কারণ, তাদের পাওয়া বা ভোলানো দু’টোই সহজ। তবে তার খুনের বিচার থেকে জানা যায়, তিনি শরীর সংস্রবের পর গলা টিপে হত্যা করতেন! তার প্রকৃত খুনের সংখ্যা এখনও জানা যায় না! গোটা বিষয়টা তীব্র রহস্যে ঘেরা!

এবার কথা বলা যাক সেই রহস্যময়ী নারীর কথা যাকে ইতিহাস রক্তপিপাসু ডাকিনী বলে ডাকে। তিনি হলেন, চূড়ান্ত সম্ভ্রান্ত হাঙ্গেরিয়ান পরিবারের মেয়ে। বিখ্যাত নোবেল লরিয়েট স্টিফেন বিটোরির ভাইয়ের মেয়ে এলিজাবেথ বিটোরি। তিনি হাঙ্গেরির সেনাপতির বিবাহিত স্ত্রী। এবার শুরু হলো গল্প— দেখা যেত উচ্চবেতনভোগী এলিজাবেথের গৃহকর্মীরা কাজে এলেই আর ফেরে না! লোকমুখে আলোচনা শুরু হতে থাকে। এলিজাবেথ কুমারী মেয়েদের রক্ত দিয়ে স্নান করতেন। তার ধারণা ছিলো, এতে তার ত্বক ভাল থাকবে। খুন হতে থাকা মেয়েদের ত্রাসযুক্ত শব্দ তাকে বিনোদন দিত, এই কারণে একের পর এক খুন করেছেন তিনি। দীর্ঘ ২৫ বছরের বেশী সময় এই ঘটনা চাপা পড়তে পড়তে একদিন প্রকাশ্যে আসে। তার দূর্গ থেকে মরদেহ পাওয়া যায়, বাকি জীবন্ত মেয়েরা সত্য কথা বলে দেয়। এলিজাবেথ গৃহবন্দি হন আর তারপর মৃত্যু হয়। সাড়ে ছয়শো কাছাকাছি খুন করেছেন তিনি। .
এবার আসা যাক “জিল দ্য রাই” (GILLES DE RAIS) এর কথায়। নীল চোখের অধিকারী ফ্রান্সের এই কুখ্যাত খুনি ১৪০৪ সালে জন্মান। নিজে হাতে তিনি একশোর বেশী খুন করেছিলেন। তাদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিলো বালক, যারা নীল চোখের অধিকারী। ৪০টি অত্যাচারিত শিশুর নগ্ন দেহ পাওয়া যায়! এইসব শিশুদের ওপর তিনি ঘৃণ্য ও পাশবিক অত্যাচার করতেন। মৃত্যুর পর পুড়িয়ে ফেলতেন তাদের। জিল নিজে একজন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। জিল তার কাজের লোকের সহায়তায় শিশু সংগ্রহ করতেন। তিনি এইসব রক্ত দিয়ে স্নান করতেন। ১৪৪০ সালে জিলের ফাঁসি হয়।

এরপর আসা যাক “রিচার্ড ট্রেন্টন”র কথায়। তার অনেক খুনের মধ্যে অন্যতম প্রতিবেশীর পরিবারের নৃশংস হত্যা। আমেরিকায় তার জন্ম হয়। তাদের খুন করার পর তিনি রক্ত পান করতেন এবং প্রতিবেশী গর্ভবতী নারীকে তিনি ধর্ষণ করে খুন করেন! এরপর মরদেহগুলো চার্চে ফেলে আসতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। বিচারে তার গ্যাস চেম্বারে মৃত্যু ধার্য করা হয়। খুনের জন্য তাকে “THE VAMPIRE OF SACRAMENTO” কিম্বা ড্র্যাকুলা কিলার বলা হতো। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ ৬টি ভয়াবহ খুন করেন তিনি। অবশ্য তিনি নিজেই অত্যধিক মাদক খেয়ে আত্মহত্যা করে।

“জন ওয়ানে গেসি” দ্য কিলার ক্লাউন নামে কুখ্যাত। শুধুমাত্র হাড়গোড় সাজানোর শখের জন্য তিনি খুন করতেন। এইভাবে প্রায় ৪শ জনের কাছাকাছি খুনের পর তার মৃত্যুদণ্ড হয়। .এরপর আসা যাক “টেড বান্ডি”র কথায়। এরকম সুদর্শন যুবা পুরুষকে খুনি ভাবা যায় না! সহজেই মেয়েদের ফাঁদে ফেলে তিনি খুন করতেন। তিনি প্রায় ৩০ জনের বেশী মেয়েকে হত্যা করে, হত্যার পরে সে ধর্ষণ করেন। মেয়েদের মরদেহের অংশ তিনি সাজিয়ে রাখতেন। তাকে ইলেকক্ট্রিক চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

ডেনিস র‍্যাডার দুঃসাহসী এক খুনি। যিনি “blind, torture, kill” killer  নামে পরিচিত। খুনের পর খুনের পদ্ধতি জানিয়ে পুলিশকে চিঠি পাঠাতেন তিনি।

সবচেয়ে বিকৃত মস্তিষ্কের এক খুনি যিনি খুন করে কেবল শরীরী সুখ পেতেন বলে খুন করতেন বলে দাবি করেছেন। তার নাম “ANDREI CHIKATILO”, প্রায় ৫৩ জনকে খুন করেছিলেন তিনি। মিরা হিন্ডলে যাকে ব্রিটেনের ত্রাস মানা হতো তিনি মেয়েদের মধ্যে অন্যতম সিরিয়াল কিলার।

সজ্ঞীত তারকা জিম মরিসনের কথা আমরা কে না জানি! তার একটি বক্তব্যের কথায় আসি, “The most loving parents and relatives commit murder with smiles on their faces. They force us to destroy the person we really are: a subtle kind of murder”। এর মতো ব্যঙ্গের সত্যি আর কী-ই বা হতে পারে!

ওডিসি-তে তাই বোধহয় হোমার বলেছেন, “There will be killing till the score is paid”।

তবে এইসব খুনের জন্য যারা বিশেষভাবে খ্যাত তারা নামে উদাহরণ হয়েও কিন্তু খলনায়কই। আমি যাদের কথা এখানে বললাম তারা ছাড়াও অজস্র ভয়ঙ্কর খুনিরা আছেন। এদের ঘটনা এইযুগে যেকোনো বৈদ্যুতিন মাধ্যমে গেলেই জানা যেতে পারে।

এরা এমনই ত্রাস... তাই বলে সমস্ত খুনই ইচ্ছাকৃত অমূলক নয়। এর বিভিন্ন দিক আছে। অনেকে বিপদে পড়ে আত্মরক্ষার্থেও অনিচ্ছায় আঘাত করেছেন, খুন হয়ে গেছে। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশেই এর স্বীকৃতি নেই কিন্তু আইন অনুযায়ী তার শাস্তির পরিমাণ ছোট-বড় করা যায়। আসলে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ বাস্তব তো পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। এমনিতেই এটা ভাঙনের জীবন, তার ওপরে অযাচিত মৃত্যু যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তা স্বাভাবিকভাবেই অনভিপ্রেত!

বাংলাদেশ সময়: ১৫২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।