সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কিন্তু ভদ্রলোককে মনে হয় খুবই চিনি। তার ষাট বছর পূর্তিতে প্রকাশিত গ্রন্থের সুবাদে আরও চেনা হলো।
পূর্ব বাংলার শেকড় নিয়ে তিনি সর্বভারতীয় তো বটেই, বৈশ্বিক বাঙালিতে পরিণত হয়েছেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি পেরিয়ে সাংবাদিকতায় ভারতের প্রায়-সকল সমকালীন নেতার সঙ্গে মিশেছেন। একাধিক বইও লিখেছেন তাদের নিয়ে। টিভি পর্দায় চাঁছাছোলা সাহসী মন্তব্য করে টলিয়ে দিচ্ছেন অনেককেই। এহেন মানুষ ষাট স্পর্শ করলেও তারুণ্য হারান না।
বইটিতে তাকে নিয়ে লিখেছেনও ষাট জন। প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু থেকে সহকর্মী হয়ে আরও অনেকে। লেখাগুলি পড়লে তার একটা অবয়ব উঠে আসবে অবশ্যই। কলকাতায় বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন কবি-বন্ধু জয় গোস্বামী। জয় নিজেও লিখেছেন এখানে। প্রকাশ করেছে দে'জ পাবলিশিং।
সুমনের বন্ধু-বান্ধবরা মনে করেন, ‘এত ঝড়-ঝাপটা, চড়াই-উৎরাই সামলে এই যে ষাটটি বছর চালিয়ে খেলে যেতে পারলে এটাই তো যথেষ্ট। ’ তিনি নিজেও সেটা বিলক্ষণ কবুল করেন, ‘আ-কৈশোর আমি যে রকম এলোমেলো, উচ্ছৃঙ্খল, ব্যাভিচারী জীবন যাপন করেছি, তাতে যে কোনও দিন ফুটে যেতেই পারতাম! বিবিধ বিপদসঙ্কুল জায়গায় রিপোর্টারি করতে গিয়েও প্রাণ হাতে করে ফিরে এসেছি। সরকার বাড়ির পাট চোকানোর পরে (আনন্দবাজার পত্রিকা) টানা কয়েকটি বছর আমি যে রকম ভয়ঙ্কর চাপ, অশান্তি, অপমান আর প্রতিহিংসাপরায়ণতার সঙ্গে সহবাস করেছি, তাতে বাকি জীবনটা হয় পাগলা গারদে নয়তোবা চরম ডিপ্রেশনের ক্রনিক রুগি হয়েও পড়তে পারতাম।
হইনি যে সেটা বোধহয় অনেকের ভালবাসা আর পরম কল্যাণময়ের আশীর্বাদ। সেজন্যই ষাটের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি আজ! আজও স্বপ্ন দেখতে পারি সেই বাইশ-তেইশের মতোই। দুনিয়াটাকে বদলে দেওয়ার জেদ এখনও দুর্নিবার। ’
এমন সাহসী উচ্চারণের জন্যই সুমনকে ভালো লাগে। পরিচয় না থাকলেও মনে হয় কতই না কাছের। ফেলে আসা কর্মবহুল জীবন সম্পর্কেও তার উপলব্ধি ভাবায় আমাদের, ‘মনে পড়ছে বাবার কথা। যা কিছু শিখেছি তাঁর জন্যই। মায়ের কথা, যিনি ষাটে পা দেওয়ার আগেই আমাকে প্রায়-অনাথ করে চলে গিয়েছিলেন, তাও আজ নয় নয় করে তেত্রিশ বছর হয়ে গেল। কাকা-পিসিদের কথা, আমার শৈশব, কৈশোর যে তাঁদের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। মনে পড়ছে বেনারসের দেবনাথপুরার সেই পূতিগন্ধময় দেহলিটাকে, যেখানে মাঝে মাঝে পুজোর ছুটিতে আমার কয়েকটি দিন কাটত। সেখানে ছিল আমার মামাবাড়ি!’ অধ্যাপক পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি এভাবেই।
বলেন সাংবাদিকতার পেশাজীবনের পথ-প্রদর্শকদের কথাও, ‘মনে পড়ছে আমার তিন গুরুর কথা- গৌরকিশোর ঘোষ, সন্তোষ কুমার ঘোষ, হামদি বে। চোখের সামনে ভাসছে কয়েকটি স্মৃতি-মেদুর পোস্টাল অ্যাড্রেস, যেখানে আমার সাংবাদিক জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে। ৯৬ নম্বর রামমোহন সরণি, ৬ প্রফুল্ল সরকার সরণি, ৭৪ বেলেঘাটা রোড, এ জে সি বোস রোডের বিজনেস টাওয়ার্স, হোয়াইট হাউস, দিল্লির রফি মার্গের আই এন এস বিল্ডিংস! আজকাল! আনন্দবাজার, একদিন, স্টার আনন্দ, কলকাতা টিভি! কত জায়গায় যে বসত করলাম কী বলব!’
সুমন সবচেয়ে বেশি আপ্লুত হন বিশেষ একজনের কথায়, ‘মনে পড়ছে, বুক নিংড়ে মনে পড়ছে, অভীক সরকারের কথা। তিনি ছিলেন বলেই আমি হয়েছি, তাঁর আশ্রয়, প্রশ্রয়, শিক্ষা, ভালবাসা, ভ্যর্তসনায় আমি একটু একটু করে পুষ্ট হয়েছি দিনের পর দিন। সাম্রাজ্যের সিংহাসন ছেড়ে এখন তিনি কোথায় আছেন কেমন আছেন জানি না। তবু আমার এই ষাটতম জন্মদিনটি আমি সবিনয়ে উৎসর্গ করতে চাই তাঁরই করকমলে!’
কি দারুণ স্বীকারোক্তি! আজকাল এতোটা খুলে কেউ তো কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা, ঋণের কথা জানায় না। সুমন জানিয়েছেন। এজন্যই তিনি আলাদা। বাংলাদেশের বহু দূরের. তবু অনেক কাছের।
সুমন নামটি নিয়ে এক সময় আমরা বিভ্রান্ত হলাম। ভাবতাম, কে? গায়ক সুমন নয় তো? তিনি যে আরেকজন, সেটা স্বকীয়তায় প্রমাণ করেছেন। ষাট পেরিয়ে আরও সৃষ্টিশীল হোন, ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা।
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি-কথাশিল্পী-লেখক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৭
এমপি/জেডএম