ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বিসমিল্লাহ্‌ ভাতঘর | হানিফ মোল্লা

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৭
বিসমিল্লাহ্‌ ভাতঘর | হানিফ মোল্লা বিসমিল্লাহ্‌ ভাতঘর | হানিফ মোল্লা

১.
অফিস পাড়ার গলির শেষ মাথায় আলমের ভাতের হোটেল। বহুজাতিক এক কোম্পানির কোমল পানীয়ের বিশাল বিজ্ঞাপনের ফাঁকে দোকানের নামটি ছোট করে ছাপানো, “বিসমিল্লাহ্‌ ভাতঘর”।

 

​লম্বা একটা ঘরের শেষ মাথায় হোটেলের রান্নাঘর, তার পেছনেই ঘন অন্ধকারে ঢাকা একটা থাকার ঘর। সেখানে হোটেলের কর্মচারীদের থাকার যায়গা।

একটা ভাঙা চৌকি আর তেলচিটচিটে দেয়ালের সঙ্গে তাদের সঙ্গী-সাথী ইঁদুর, তেলাপোকা আর বড় বড় কালো মশা। থাকার ঘরটির অধিকাংশ জায়গা পাম তেলের টিন, পেঁয়াজ-রসুন, চাল আর আটা ময়দার বস্তাতেই ঠাসা।

হোটেলের মুখের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো নান রুটি বানাবার একটা সিমেন্টের বড় চুলা। গোল মুখ হা করে আছে। তার পেটের ভিতরে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে, আর সেই চিত্রটিই যেনো মানুষের পেটের ক্ষুধার একটা নীরব বিজ্ঞাপন হয়ে সকাল-বিকেল জ্বলতেই থাকে। চুলার বিপরীত পাশেই আলমের ক্যাশ টেবিল। কলেজের অধ্যাপকদের ডায়াসের মতো খানিক উঁচু করে বসানো। মাথার উপরে একটা অক্লান্ত ওয়ালফ্যান ফজর নামাজ থেকে রাত এগারো-বারোটা অব্দি ঘুরতেই থাকে। হোটেলের কর্মচারী আঙুল গোনা পাঁচজন। তাদের সবার দৈহিক ও চারিত্রিক গড়নও আঙুলের সাইজের মতো বিচিত্র। এই শহরে কাক ডাকার আগেই যাদের ঘুম ভাঙে আর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তবেই তাদের ঘুমানোর সময় হয়।
 
অফিস পাড়াটি খুব একটা বড় নয়। আশেপাশে প্রায় বাকি সবটাই আবাসিক এলাকা। এই আবাসিক এলাকার অনেকেই আবার আলমের বিসমিল্লাহ্‌ ভাতঘরের নিয়মিত কাস্টমার। যেদিন বাচ্চাদের স্কুলের দেরি হয়ে যায় বা অফিসের তাড়ায় দ্রুত বের হতে হয় সেদিন অনেক ঘরের সকালের নাস্তা হোটেলের নান রুটি আর তেলে ভাজা পরোটার উপর নির্ভর করতে হয়। অবশ্য স্থানীয় কিছু লোকের নাস্তার কালচার হোটেলকেন্দ্রিক, দুপুর আর রাতের খাবার ছাড়া তাদের নাস্তার ব্যবস্তা হোটেলনির্ভর। এমনকি আচমকা কোনো মেহমান ঘরে এলে বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলের সিঙাড়া, সমুচা, পেঁয়াজু অথবা ডিম পরোটা গৃহিণীকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে এলাকার উঠতি বয়সের নানা ছেলেপেলের দল আড্ডা দিতে অথবা ক্লান্ত রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশার ড্রাইভাররা চায়ে ভিজিয়ে পরোটা বা নান রুটি খেতে আসে।
 
মাঝবয়সী আলম পোড় খাওয়া লোক। নিজের বাবা-মায়ের কথা তার কিচ্ছু মনে নেই। অনেক চেষ্টা করেও সে মনে করতে পারে না। অনেক অনেক বছর আগে এই হোটেলের সামনে একটা ডাস্টবিনের খাবারের খোঁজে এলে নিঃসন্তান সালাম সওদাগরের চোখে পড়ে। সালাম সওদাগরেরে সেই ঝুপড়ি হোটেলে গ্লাস বয় থেকে আলম কিশোর বয়সে আমেনা বেগমের মাতৃস্নেহের তাড়নায় সন্তানের মর্যাদা পেয়ে যায়। আলম নামটি সালাম সদাগরেরে নিঃসন্তান স্ত্রীর দেওয়া। একাত্তরে যুদ্ধের বছর এক রাতে পাক আর্মির হামলায় সালাম সওদাগর আর তার স্ত্রী প্রাণ হারায়। সেই থেকে এই হোটেলের মালিক আলম। রহিমা বানুকে বিয়ে করে এক ছেলে রুবেল আর পাড়ার তরুণদের মাথা নষ্ট করে দেওয়ার মতো সুন্দরী রুবা নামে এক মেয়ের জনক।
 
২.
সারা রাত পাহারা দিয়ে সকালে শহুরে কুকুরগুলো যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখনই আলম সাদা একটা লুঙির উপর পাঞ্জারি পরে গায়ে আতর আর মাথায় টুপি চড়িয়ে ক্যাশ টেবিলে বসে। এসেই ধমক লাগায়, কিরে তোরা এতো বেলায় এখনও কিছুই করস নাই? খানকির পুতেরা তাড়াতাড়ি খামাল লাগা, কাস্টমার খাড়াই থাকলে পোন্দে লাত্থি দিমু। অই পিচ্ছি আমারে একটা চা দে...
 
অথছ তার অনেক আগেই কর্মচারীরা কাজ শুরু করে। পরোটা আর নান রুটি বানায় সেলিম। তবে প্রধান বাবুর্চি কবির। দুপুর আর রাতের খাবার রান্নার দায়িত্ব তার। পনের-ষোল বছর বয়সী দুইজন হাকিম আর রতনের কাজ ঝাড়ু দেওয়া, বাসন পত্র ধোয়া আর মেসিয়ারি করা। তরকারি কাটা আর মসলা বাটার কাজ করে সুজনী নামে আটাশ-ত্রিশ বছরের এক নারী।
 
আলম গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই কর্মচারীদের এটা সেটা বলে তাড়া দেয়। তাতে খুব একটা যে লাভ হয় তা না। তবু নিয়ম রক্ষার এই গলাবাজি করতেই হয়। ময়দার খামালের গামলার পাশে একটা লম্বা টেবিলে সেলিম গোল গোল করে অনেকগুলা গোলা সাজায়। পাশেই কালো বড় কড়াইয়ে তেল গরম দেওয়া হয় পরোটা ভাজার জন্য। তার পরেই নান রুটি বানানোর চুলাটাতে আগুন দেওয়া হয়। ফজর নামাজ শেষে বহুমূত্র রোগীরা একটু প্রাতঃভ্রমণ আর শরীর সচেতন লোকেরা দু-চার কিমি দৌড়ে যে ক্যালরি খরচ করে, তার চেয়ে দ্বিগুণ ক্যালরি সঞ্চয় করে বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলের ডালভাজি, কড়া চিনি-স্যাকারিনের চা-রুটি-পরোটা খেয়ে।
 
আজ সকালে জমির সাহেব নামাজ শেষ করে বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলে এসেছেন। তিনি মাসে চার-পাঁচবার আসেন। সকালে এসেই খবরের কাগজে কিছুক্ষণ মুখ ডুবিয়ে চা খান। সাথে একটা গরম নান রুটি। খাওয়া শেষ করেই বয়কে গ্লাস ধুয়ে একগ্লাস পানির ফরমায়েশ করার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় দেশ নিয়ে তার নানান রকম উদ্বেগের ভাষণ। আজকের ইস্যু হলো, রোহিঙ্গা সমস্যা।
 
হোটেলের বাইরে কিছু কাস্টমার ছেঁড়া খবরের কাগজের টুকরা হাতে নান রুটি আর পরোটার জন্য লাইন দেয়। দু-একজন বিল পরিশোধের জন্য আলমের ক্যাশ টেবিলের কাছে। আলম নিজে লেখা পড়া জানে না দেখেই সে জমির সাহেবের উপর বিরক্ত হয় না। দোকানের পেপারে দেশ দুনিয়ার যে দু-চারটা খবর তার মগজে আসে তা তো এই আলোচনার মাধ্যমেই।
 
জমির সাহেব রিটায়ার্ড মানুষ। সে আলমকে আলম ভাই বলে ডাকে। এই ব্যাপারটা আলমের খুব পছন্দের। ক্যাশে টাকা নেওয়া আর ভাংতি ফেরত দেওয়ার মাঝেও সে মন দিয়ে কথা শোনার চেস্টা করে। আর ফাঁকে ফাঁকে হাঁক দিয়ে ওঠে, অই তোরা ঠিক মতো হাত চালা। ভদ্রলোকের সামনে পারতপক্ষে আলম মুখ খারাপ করে না।
 
জমির সাহেব কথা শুরু করেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে তো পুরা আরাকান এই দেশে চলে আসবে।
কি হইছে মিয়া ভাই? -আলমের জিজ্ঞাসা।
কি হইছে মানে? আপনি দেখি কিচ্ছু জানেন না। দলে দলে কাতারে কাতারে বার্মা থেকে রোহিঙ্গা আসছে। এখন পর্যন্ত দশ লাখের মতো চলে আসছে। আরও অনেকেই আসার জন্য সীমান্তে অপেক্ষা করছে।
কি সমস্যা হইছে ভাই? -আলমের উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা
বার্মার সরকার তাদেরকে জাতিগতভাবে উৎখাত করতে চায়। এইখানে একটা বড় খেলা আছে আলম ভাই। চীন-ভারত সবার বাণিজ্য স্বার্থ আছে। তাই অত্যাচারের বিচার হবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু আমাদের সমস্যা অন্যরকম।
কি রকম মিয়া ভাই?
এই যে এতো লোক দেশে ঢুকতেছে, এরা চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। বুড়া-বুড়িগুলা ভিক্ষা করবে। আর মেয়েগুলান যেগুলা সোমত্ত, ওদের অনেকই দেখবেন পথে-ঘাটে পতিতা হবে, দেহ ব্যবসা করবে। আর পুরুষগুলা নানান চুরি-ছিনতাই এইগুলার সাথে জড়াই যাবে। এছাড়া আর উপায় কি বলেন? দেশের শিক্ষিত লোকেরাই চাকরি পায় না যেখানে। আরও শুনতে পাচ্ছি এদের অনেকেই এইডস রোগে আক্রান্ত।
আলম চোখ কপালে তুলে বলে, বলেন কি মিয়া ভাই। তাইলে তো দেশের অবস্থা খুব খারাপ!
খারাপের কথা আর বলবেন না, দেশে এতো বড় একটা বন্যা হয়ে গেলো অথচ মিডিয়াগুলা সেইটা নিয়ে খুব একটা খবর-টবরও দিলো না। কোনো একটা অদ্ভুত কারণে কেউ দেশের সমস্যার কথা বলতেই চায় না।
 
৩.
এদিকে দোকানের কাস্টমার বেড়ে যায়। আলম কথা শোনার ফাঁক পায় না আর জমির সাহেবও বাসার পথ ধরেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। রুটি পরোটার বিকিকিনি শেষে সিঙাড়া-সমুচা বানানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কারিগর সেলিম। ওইদিকে রান্নাঘরে কাটাকুটি আর মসলা বাটার জন্য সুজনী চলে আসে। তার সাথে একই ঘরে কাজ করতে হয় বাবুর্চি কবিরকে। কবির দেখতে বেশ ভালো। সুজনী তাকে পছন্দ করে। অনেকবার ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছেও সে মনের কথা, কিন্তু কবির সচেতনভাবেই সুজনীকে এড়িয়ে যায়। হোটেল মালিক আলম সওদাগরের চোখে পড়লে তার চাকরি যাবে। এই নির্মম শহরে যেমনই হোক একটা থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত তো আছে। কবির জানে আলম সদাগরের সাথে সুজনীর গোপন প্রেমের খবর।
হোটেলের পিছনে সুজনীর বস্তি ঝুপড়ি ঘর। সেখানে মাসে কয়েকবার নিয়ম করে আলম সওদাগর আসেন। সেটাও খুব গোপনে। আলমের বউ এই মাঝ বয়সে স্বামীর শরীরের চাহিদা পুরণ করতে পারে না।
 
আলম সওদাগর সুজনীকে কাজ দিয়েছে যখন তার স্বামী একদিন কোনো কথা ছাড়াই লাপাত্তা হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম আলম লোকটার খোঁজখবর নিতে ঘরে আসতো। একদিন ঈদের আগের দিন একটা নতুন শাড়ি নিয়ে দেখা করতে গেছে সুজনীর সাথে। সেদিন আলমের গলায় অচেনা এক মায়ার সুর ছিলো। সুজন জানতো তার এই কাঁচা বয়সের সুযোগ যে কেউ নিতে পারে। সুজন নিজের ঘরেই ছিলো। বেড়ার দরজা একটু ফাঁক করেই আলম সওদাগর বলে, কইরে সুজন? ঘরে আছস?
কেডা? ও সওদাগর মামা, আসেন...আপনারে যে কই বসেতে দেই......
ইতিউতি তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় সুজন। আলম ‘মামা’ ডাক শুনে বলে উঠে...
কী যে কও না সুজন... আমার আর এমন কী বয়স হইছে, আমি কেন তোমার মামা হইতে যাবো।
আমি তোমার ভাইয়ের মতো। এই নাও... শাড়িটা বাড়িয়ে দেয় সে। ভাবলাম সামনে ঈদ, তোমারও তো ঈদ-চাঁদ আছে, নাকি?
সুজন শাড়িটা নিয়ে ভাবতে থাকে। সে জানে আলম সওদাগর কী চায়। তার মাথা কাজ করে না।
আলম বলে, ভাবছি তোমারে বোনাস-টোনাসও দিমু, কিন্তু তার লাইগা তো আমারে একটু খুশিটুশী করা লাগে, কি কও? আর নাইলে ভাবতেছি ঈদের পর থাইকা একজন নতুন মাইয়া মানুষ ঠিক করবো মসলা বাটার কামে। তুমি তো ঠিক মতো কাজ করতে পারো না, মনে লয়। আর, হোটেলের জোয়ান পোলাপাইন আছে, বুঝই তো। এইসব ঝামেলা বাড়াইতে চাই না... এখন বাকিটা তুমি বুঝ। বলেই সে সুজনের হাত ধরে টেনে চৌকির উপর ফেলে দেয়। তখনও সুজনের এক হাতে নতুন কাপড়টি ধরা। সুজন আর প্রতিবাদ করে না। সেই থেকে শুরু। যাওয়ার সময় আলম হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলে, এই নাও তোমার বোনাস! মাঝে মধ্যে আসব। কিছু লাগলে আমারে বলবা। শরম করবা না। এখন ব্যাপারটা একটা নিয়ম হয়ে গেছে।

৪.
দুপুরবেলা আলম সওদাগর গোসল আর খাওয়ার জন্য ঘরে যায়। সেই সময় রোজ নিয়ম করে তার ছেলে রুবেল ক্যাশে বসে। দুইবার উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে পাশ করতে পারেনি। বাবার হোটেলই একমাত্র আশা-ভরসা। নিয়ম করে কিছু কিছু টাকা নয়-ছয় করে তার পকেট খরচ চলে এই ক্যাশ থেকেই। হাল আমলের নেশা ইয়াবায় আসক্ত রুবেল। রোজ হোটেলের পিছনে যে ঘরে কর্মচারীরা থাকে সেখানে গিয়ে একটা দুইটা করে ইয়াবা খায় সে এই সময়টায়। রুবেল হয়েছে একেবারে বাপকা বেটা। ইয়াবার বড়ি টানার জন্য ভিতর দিকে যাওয়ার সময় সুজনীকে দেখেছে কয়েকবার। শ্যামলা গড়নের মেয়েটার শরীর বাঁধানো-পরিপাটি। তাছাড়া ইয়াবা নেওয়ার পর তার মাথা কাজ করে না ঠিক মতো। একদিন সে উপুড় হয়ে মসলা বাটার সময় সুজনের সুগঠিত স্তন দেখে ফেলে। মসলা বাটার ছন্দে তার বুক গ্যাস বেলুনের মতো নিটোল দুলতে থাকে। সেই থেকে ইয়াবা খাওয়ার পর হোটেলের পিছনের অন্ধকার ঘরে সুজনীকে কল্পনা করে আর কাম উত্তেজনায় মৈথুন করে। কিন্তু যতোই লোকে বলুক, “থাকিতে হস্ত, কেন হব নারীর দারস্থ”, ঘটনা হলো দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? রুবেল যতোবারই সুজনীকে দেখে মনে মনে ফন্দি আটতে থাকে কী করে তাকে আপন করে কাছে পাওয়া যায়।
 
অফিস পাড়ার লোকেরা বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলে খেতে আসে কেউ, কেউবা পিয়ন পাঠিয়ে দিয়ে পার্সেল নিয়ে যায়। পার্সেল নিতে এলে ক্যাশ থেকে রুবেল হাঁক দিয়ে ওঠে, “এই ভাই আইছে...ভাই...জলদি কর, জলদি কর”। কর্মচারীরা ব্যস্ত হয়ে যায়। গ্লাস বয়রা টেবিল পরিষ্কার করে, টেবিলে খাবার লাগায়, টুং টাং ঝনঝন শব্দের ভিতরে দুপুর তার সমস্ত নির্জনতা হারায়। কাস্টমার এসে জিজ্ঞেস করে, কি আছে? হোটেল বয় মুখস্ত মেনু বলতে থাকে- স্যার কি খাইবেন? আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, টমাটু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, পোয়া মাছ, চাপিলা মাছ, চান্দা মাছ, রুই মাছ, দেশি মুরড়ি, ফারম, গরুর মাংস, খাসির মাথা চনার ডাইল। রোজ একই ছন্দে বিসমিল্লাহ্‌ হোটেল চলতে থাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে ভাতের আয়োজন শেষ হয়। শুরু হয় নতুন কর্মযজ্ঞ। সেলিম আর কবির মিলে বিকেল-সন্ধ্যার নাস্তা আর রাতের খাবারের ব্যবস্থায় কাজে নেমে পড়ে।
 
বিকেল বেলা রুবেল ক্যাশ তার বাবার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। মধুর লোভে মৌমাছির মতো সে সুজনের ঘরের আশেপাশে ঘোরে মাঝে মধ্যে। কিন্তু কিছুই কুল কিনারা করতে পারে না। তার মনের ভয় তাকে দূরে দূরে রাখে।
 
সন্ধ্যায় আগরবাতি জ্বালিয়ে আলম ক্যাশের পাশে থাকা কোনো এক আউলিয়ার মাজারের দান বাক্সে নিয়ম করে দুই টাকা করে ফেলে। সেই পীরের দরবারে সে এর বিনিময়ে তার ব্যবসার উন্নতি আর নিজের সুখের জন্য দোয়া কামনা করে।
 
এলাকার বখাটে ছেলেরা আসে বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলে আড্ডা দিতে। চায়ের সাথে বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে ওঠা হোটেলে তাদের আলাপের বিষয় খেলাধুলা, রাজনীতি ও কোন বাড়ির কোন মেয়ে দেখতে মাল হয়ে উঠেছে, তাকে কীভাবে মাল থেকে মা বানানো যায় সেই নিয়ে নির্লজ্জ গলাবাজি। সেই আলোচনা জমতে জমতে একেক দিন হিন্দি ছবির নায়িকার ফিগারেরে কামুক বর্ণনা আর নীল ছবির ভিডিও আদান প্রদান চলে মোবাইল থেকে মোবাইলে।
 
দু-একটা পাতি নেতা আসে কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। এরা এসে খালি অর্ডার করে। কে কী খাচ্ছে আর কী পরিমাণ বিল দিচ্ছে তা নিয়ে উচ্চবাচ্চ করাটাও নিষেধ। একটা অলিখিত ভয়ে আলম এদের ঘাঁটায় না। ঘাঁটাতে গেলে পরিনাম যে ভাংচুর আর লুটপাট তা অবধারিত। কোথাও গিয়ে এর বিচার চাওয়া যাবে না। তার থেকে ভালো কিছু টাকা তো অন্তত পাওয়া যাচ্ছে। তার এই বয়সে সে দেখেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে দেশটাকে তারা নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করে। যেমন আলম সুজনীকে নিজের করে নিয়েছে অনেকটা সেই রকমের।
 
৫.
বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলে রাতের খাবার শেষ হয়ে যায়। অফিস পাড়া বলেই লোকের আনাগোনা রাত নেমে যাওয়ার পর একটু কমে। পরের দিনের জন্য ঝাড়পোছ করে হাকিম আর রতন। হোটেলের কর্মচারীরা সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে সেই অন্ধকার ঘরে ঘুমাতে যায়। কিন্তু হাকিম আর রতনের তখনও আরও একটা কাজ বাকী।
সেলিমের সাথে চৌকিতে একদিন গ্লাস বয় হাকিম আরেকদিন রতন ঘুমায়। একইভাবে চৌকির নিচে বাবুর্চি কবিরের সাথেও পালা করে ঘুমায় তারা। সেলিম আর কবির নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছে এই নিয়ম। আর নিয়ম না মানলে আলম সওদাগরের কাছে কিছু একটা মিথ্যা অভিযোগ করলেই চাকরি যাবার ভয় তো হাকিম আর রতনের আছেই। আগের দুই ছেলেকে এইভাবেই তো তারা তাড়িয়েছে। এছাড়া হোটেলের রান্নার থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু কিছু ভালো খাবার রোজ তাদের কপালে জোটে সেলিম আর কবিরের কারণে। রাতে কুকুরেরা যখন বাইরের অপরিচিত লোক বা রিকশা দেখলে ঘেউ ঘেউ করে, হোটেলের সেই অন্ধকার ঘরে সেলিম আর কবির তখন মেতে উঠে অন্য খেলায়। হাকিম আর রতনের চাপা আর্তস্বর এই অন্ধকার বন্ধ ঘরের দেয়াল থেকে বাইরের পৃথিবীর কারও কানে পৌঁছায় না। একসময় ক্লান্ত হয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। আবার খুব ভোরে মুয়াজ্জিনের আজানের ডাকে তারা আবার রোজকার কাজে নেমে পড়ে।
 
৬.
একবার আলম সওদাগর খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই ডাক্তার সেই ডাক্তার করে কিন্তু কিছুতেই তার অসুখ ভালো হয় না। বিসমিল্লাহ্‌ হোটেলের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে রুবেলের কাছে। সেই এতে খুশীই হয়। তার যে গুপ্ত বাসনা আছে সুজনীকে নিয়ে, তা পুরণের একটা সুযোগ সে এইবার পেয়ে যাবে, এই ভাবনাতেই সে বিভোর। আলম সওদাগরের অনুপস্থিতে রুবেল এখন তার নিজের মতো করে একটা নিয়ম বানিয়ে নিয়েছে। যেহেতু ক্যাশ তার নিজের হাতে এখন তার ইচ্ছে মতো খরচ করতেও আর বাধা নেই। তার ইয়াবা সেবনের মাত্রা বেড়ে যায়। মৈথুনে সে এখন আর তৃপ্ত হতে পারে না। তার শরীর লাগবে। সুজনীর মাংসল বুক তাকে অস্থির করে।
 
একদিন হোটেলে কাস্টমার কম থাকায় রান্নার ঘরে ঢু মেরে রুবেল বাবুর্চি কবিরকে বেরিয়ে যেতে বলে। কবির ঘটনা আঁচ করতে পারে। মালিকের হুকুম বলে কথা, সে রা না করেই বেরিয়ে যায়। গলির মোড়ে গিয়ে সিগারেট টানতে থাকে আর মনে মনে হাসে।
 
গোটা কয়েক ইয়াবা সেবনের পরে রুবেলের শরীরে এখন অসুরের শক্তি, মনে সুজনীর খোলা বুকের ছবি তার কামনাকে আরও উস্কে দেয়। নিজের লাজ লজ্জা ভুলে সে মসলা বাটা অবস্থায় সুজনীকে ডেকে নিয়ে যায় ভিতরের সেই অন্ধকার ঘরে।
সুজন আপা?
জে ভাইজান?
কাজ-কাম তো ঠিক মতো চলে না মনে হয়।
কী কন ভাইজান, এই দেখেন কতো কতো মসলা বাটলাম, আদা, পেঁয়াজ, রসুন...
সুজনীকে থামিয়ে দিয়ে রুবেল বলে, হইছে থাক থাক। এখন হাত ধুইয়া আসো। পাশের ঘরে তোমার লগে কথা আছে।
কী কথা ভাইজান? এইহানে বলেন...
রুবেল বিরক্তি নিয়ে বলে, না এইখানে বলা যাবে না... সুজনী বাধা দিতে চায়।
কী করেন ভাইজান? আপনে আমার ছোড ভাইয়ের লাহান। তাছাড়া আপনার বাপজান......
সুজনীকে রুবেল কথা বলতে দেয় না। মুখ চেপে ধরে। নেশাগ্রস্ত হয়ে সে এখন বেসামাল। আটা আর ময়দার বস্তার উপরে সুজনীর শরীরটাকে এক ধাক্কায় ফেলে দেয়। সুজনী চাপা কান্নার সুরে বলে, ভাইজান আমারে ছাড়ন দেন, আপ্নের বাপের লগে আমি......। রুবেলের কানে এইসব কথা ঢোকে না, কামতাড়িত বধির সে। হাতের টানে সুজনীর পাতলা হয়ে যাওয়া পুরনো ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলে। সুজনী রুবেলের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। রুবেলের মুখ সুজনীর বুকে ঘঁসে ঘঁসে সে গোঙাতে থাকে কিন্তু কিছুতেই মসলা বাটা শক্ত হাতের এই নারীকে সে কাবু করতে পারে না।
এমন সময় বাবুর্চি কবির হঠাৎ দৌড়ে আসে। দরজার বাইরে থেকে বলে, রুবেল ভাই, রুবেল ভাই, সওদাগর সাব দোকানে আসতেছে।
কিন্তু নেশাগ্রস্ত কাম উন্মত্ত কুকুরকে কে থামাতে পারে? তার কানে কিছুই ঢোকে না।
আলম সওদাগর হোটেলের পিছনের ঘরের দিকে এসে যা বোঝার বুঝে ফেলে। দুইবার জোর গলায় রুবেল, রুবেল বলে ডাকে। এরপর আর তার ধৈর্য কুলায় না। দরজায় লাথি মেরে ভিতরে ঢুকে পড়ে। এরপর অন্ধকারের মধ্যেই সে সুজনীর গায়ে চড়ে বসা রুবেলের শরীরে এলোপাথাড়ি লাথি মারতে থাকে আর চিৎকার করে বলে উঠে, “কুত্তার বাচ্ছা কুত্তা! বেজন্মা কোহানের”।
অনবরত লাথি আর বাপের গলা শুনে হুশ ফিরে পেতেই রুবেল দৌড়ে পালিয়ে যায়। সুজনী পেছনের দরজা দিয়ে কোনোরকম শাড়ি দিয়ে নিজের বুক ঢেকে সরে পড়ে।
আলম সওদাগরেরে চড়া গলা শুনে হোটেলের কর্মচারীরা এক যায়গায় জড়ো হয়। আলম গলা ভাঙা আওয়াজে সবার দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ওই তোরা কেউ কিছু দেখছস? কিছু শুনছস?
সবাই তাকিয়ে থাকে। কারও চোখে মুখে কোন বিকার ননেই। আলম সওদাগর এবার আবার হুঙ্কার দিয়ে একই কথা বলে, সবাই এই সাথে না বলে সম্মতি দিয়ে দেয়।
চা খেতে আসা এক কাস্টমার কিছুক্ষণ ধরে উৎসুক হয়ে এইসব দেখছে। এমনকি সে রুবেলকে আধা নগ্ন অবস্থায় দৌড়ে বেরিয়ে যেতেও দেখেছে। আলম সওদাগরের রাগ পড়ে আসে, সে ক্যাশে বসে মাথার উপরের ফ্যানটা চালিয়ে দিলো।
কাস্টমার তাকে প্রশ্ন করলো, ভাই ভিতরে কোনো সমস্যা হইছে?
আলম সওদাগর নিজেকে সামলে উত্তর দিলো, আমার বিসমিল্লাহ্‌ ভাতঘরে চাইলের বস্তায় একটা বড় ইঁদুর ঢুকছে। রান্ধন ছাড়া ভাত খাইতে চাইছিলো। খেদাইয়া দিছি...
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।