তবে যদি এরকম হয়, মৃত্যুর প্রভাবে জীবন তুচ্ছ হয় আর সেই মৃত্যুকে জীবন নিজেই নির্ধারণ করে তখন আত্মহত্যার আক্ষরিক। তবে যাদের জীবন শুনে, দেখে আমরা ভাবিত হই সেই শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিকরাই যদি সহজাত মৃত্যুকে মিথ করে মৃত্যুকে নিজের হাতে নিয়ে আসেন! ভাবতে অবাক লাগে! কেন, কী এর কারণ? আত্মার হত্যা বা আত্মহত্যা নাকি মুক্তির বার্তা
“তারা আমাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিল...আমি তাদেরকে প্রথমে পেলাম”হ্যাঁ, মৃত্যু সম্পর্কে এরকম ভেবে জীবনের শেষ একটি নোটে এমনটাই লিখেছিলেন ভ্যাচেল লিন্ডসে।
(Ernest Hemingway)
নোবেলবিজয়ী সেই উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’র লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। বন্দুকের নল নিজের মুখে ঢুকিয়ে নিজের হাতে ট্রিগারে চাপ দিলেন, শেষ হয়ে গেলেন কিংবদন্তী লেখক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যিনি নিজেই ছিলেন এক যোদ্ধা। শেষ জীবনের চূড়ান্ত অস্থিরতার কারণেও হয়তো তিনি এদিকে এগোলেন বা যার কারণ আমরা শুধুই ধারণা করব, বুঝতে পারব না। শোনা যায়, তার চার স্ত্রীর কেউই তার সঙ্গে সুখী ছিলেন না। মেয়েদের প্রতি এমনিও নাকি তার বিজাতীয় বিরাগ ছিলো। তার জীবনীকার জানিয়েছেন, পরিবারগত একটি বিষয় ছিলো কারণ, তাদের পরিবারের সবাই প্রায় একই পথের মানুষ; তার বাবা, বোন এবং ভাই সবাই আত্মহত্যার অনুগামী। হেমিংওয়ে তার মাকেও ঘৃণা করতেন। বোধকরি তার এই বোধ কোনো সম্পর্কেই তাকে থিতু হতে দেয়নি ফলে জীবন বিভীষিকার মতো অস্থির তার কাছে।
“I am rooted, but I flow”
(Virginia Woolf)
এরকম লাইন যার তার মৃত্যুও কাব্যিক। টু দ্য লাইটহাউসের লেখক জীবনের শেষ চিঠিতে লিখছেন, আমি অনুভব করছি যে আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই লেখক যিনি বলছেন, নারী তুমি যখন ফিকশন লিখবে তখন তার একটি কক্ষ আর অর্থ প্রয়োজন হবে অবশ্যই। এই কবি ওভারকোটের পকেটে নুড়ি ভরতে ভরতে নদীর কাছে নিজেকে এগিয়ে দিলেন, সমপর্ণ করলেন মৃত্যুর কাছে ৫৯ বছর বয়সে। যিনি লেখাকে বলেছিলেন, সেক্স। সেই দুর্দমনীয় লেখিকা জলে হারিয়ে গেলেন মৃত্যুকে হাতে নিয়ে।
ইউকিও মিশিমা জাপানের প্রখ্যাত লেখক, অভিনেতা, নাট্যকার আরও কতো কী! কিন্ত চূড়ান্ত জটিল জীবন ছিলো তার, তার পিতাই তার লেখা সহ্য করতে পারতেন না। লেখা দেখলেই তা নষ্ট করে দিতেন। পরবর্তীতে তিনি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে ঢুকে পড়েন কিন্তু তার মৃত্যু ছিলো সাহসিকতার। সমঝোতায় না যাওয়া বা নিজের সূত্রে অনড় থাকার জন্যই তিনি নিজের পেটে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে হত্যা করেন নিজেকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরলেন না কবি, তিনি ক্যারিন বোয়ি। জীবনবোধে জর্জরিত কবি সম্পর্কে অসুখী ছিলেন। প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
আরেক অপূর্ব ভাষ্যের কবি সিলভিয়া প্লাথ, নিজের জন্য ভয়াবহ মৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন, গ্যাস ওভেনে নিজের মাথা ঢুকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেন। ফ্রিডা ও নিকোলাস নামে দুই সন্তানের মা— একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন প্রেমিকা, একজন বোদ্ধা কবি; কোন আঙ্গিকের মানুষ সেদিন আত্মহত্যা করেছিলেন আমরা বুঝব না। তবু জানি, নিজেকে জেতাতে গিয়ে তারা হয়তো জীবন হারিয়ে ফেলেছেন। আসলে গেম থেকে কুইট করা একটা হার বা এটাও হতে পারে, গেমটাকেই তারা হারিয়ে দিয়েছেন! আসলে যার জীবন সেই জীবন প্রাপ্ত না হলে বাকি সবটাই তো আপেক্ষিক বা ধারণা।
মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে প্রেমে ব্যর্থ এক কবি আত্মহত্যা করলেন কথাসাহিত্যিক ফোস্টার ওয়ালেস, প্রেমে পড়েছিলেন কবি মেরি কারের। তার নাম নিজের গায়ে ট্যাটু এঁকেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের সর্বকালের সেরা ১০০ বইয়ের মধ্যে তার বই স্থান পায়। গ্যারেজের মধ্যে দড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
নোবেলবিজয়ী কবি অ্যানি সেক্সটন সমস্ত খ্যাতি পেয়েও অস্থির ও বিপর্যস্ত থাকতেন। বহুবার চেষ্টার পরে শেষ অবধি নিজের গাড়িতে কার্বন-মনো-অক্সাইড ছেড়ে আত্মহত্যা করেন।
মায়াকোভস্কি রুশ সাহিত্য ও বিপ্লবে যিনি রাজার মতো পথিকৃৎ, সেই উজ্জ্বল কবি সম্পর্কের টানাপোড়েনে ছিটকে গিয়ে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে আত্মহত্যা করেন।
বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন, তার পর মা আবার বিয়ে করেছিলেন। জন ব্যরিম্যান এরকম ভাঙন থেকে এসেছিলেন। বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েও কবি বুঝেছিলেন এখানে তেমন কিছু নেই তার মতো করে। ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটনের এভিনিউ ব্রিজ থেকে প্রায় ৯০ ফুট নিচে মিসিসিপি নদীতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন কবি।
ফ্রান্সের নাট্যকার নিকোলাস ক্যামফোর্ট নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে ব্যর্থ হন মৃত্যুর কাছে তারপর ছুরিকাঘাতে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেন। আসলে জেলে যাওয়া থেকে মুক্তি পেতেই তিনি এই পথ বেছে নেন। নিজের জীবনের কাছে নিজে সমর্পণ করা বোধ করি মানতে পারতেন কিন্তু সমাজের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা না করাতে পারলেই তারা হতাশাপ্রবণ হয়ে উঠেছেন হয়তো-বা।
জন্মেছিলেন সাউথ আফ্রিকায়, তার সিলেক্টেড পোয়েমস মানুষের ভালোবাসার। মাত্র ৩১ বছর বয়সে সমুদ্রের জলে নিজেকে বিলীন করে আত্মহত্যা করেন ইনগ্রিড জংকার।
উর্দু লেখক শ্যামস আঘা যদিও খুব পরিচিত লেখক নন তবুও তিনি যে অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন লেখক ছিলেন তা লেখকমহল জানে। বিচ্ছেদকামী বাবা-মায়ের থেকে তিনিও আলাদাই থাকতেন। ১৯৪৫ সাল নাগাদ তিনি হারিয়ে যান। দীর্ঘদিন তার লুপ্ত থাকার কারণে ধরে নেওয়া হয় তিনি মৃত, পরে তাকে পাওয়া গেলেও তিনি সেইসময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষার বিশিষ্ট কবি সারওয়াত হুসেইন প্রেমে ব্যর্থ ও একাকীত্বের কাঠামোকে ভেদ করে ট্রেনলাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। শোনা যায়, ট্রেন, ট্রেনলাইন— এই গতি ও তার পথ সম্পর্কে তার একটা আসক্তি ছিলো। প্রথম আত্মহত্যার মুহূর্তে তার পা হারিয়ে যায়। তিনি এখানেই বসে থাকেন না, পরে আবার ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু সুনিশ্চিত করেন।
কার্ট কোবেন বলেছিলেন, “ If you die you're completely happy and your soul somewhere lives on. I'm not afraid of dying. Total peace after death, becoming someone else is the best hope I've got”।
“Truth sits upon the lips of dying men “
(Matthew Arnold)
সক্রেটিস বলেছিলেন, মৃত্যু আসলে জীবনের বৈপরীত্য আর সেটা খুব জৈবিক আর দৃশ্যমান। ফলে এটা নিয়ে আমরা ভাবিত, ক্লিষ্ট। এর বাইরেও একটা অদৃশ্য অভূতপূর্ব খেলা আছে, যেটা প্রজ্ঞার খেলা।
এতো বিশিষ্ট মানুষেরা কেন মৃত্যুর কাছে এতো এগিয়ে গেছেন, শুধুই কী অস্বাভাবিকতা নাকি এর ভেতরে জীবন থেকে মৃত্যুর পথে যাওয়ার অন্য কোনো ইঙ্গিত তারা পেয়েছিলেন। আসলে জৈব আধানের মধ্যে নিবিষ্ট আমরা যতোটুকু দেখা যায় তা নিয়েই তো ভাবি। ছকের দাবার মেঝেতে সাদা আর কালো... এই চলন্ত প্রাণের ছক তো সেই জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ক্রমশ...
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৮
এসএনএস