ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

২০ বছর পর শিল্পকলায় আলী যাকের-নূরের ‘গ্যালিলিও’

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৮
২০ বছর পর শিল্পকলায় আলী যাকের-নূরের ‘গ্যালিলিও’ মঞ্চ নাটক ‘গ্যালিলিও’

ঢাকা: অনেকেই বলেন আমাদের মঞ্চ নাটকে ভালো নাটকের অভাব। তবে যখনই ভালো নাটক হয়েছে দর্শক তখনই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মঞ্চে। সে কথারই যেন প্রমাণ দিলো মঞ্চ নাটক ‘গ্যালিলিও’।

মঙ্গলবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় দীর্ঘ ২০ বছর পর শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলের মঞ্চে মঞ্চায়িত হলো নাটক ‘গ্যালিলিও’। এদিন বাংলা মঞ্চ নাটকের অন্যতম দিকপাল নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের জন্মদিন উপলক্ষে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় হাজির হয় তাদের এ প্রযোজনা নিয়ে।

প্রায় ত্রিশ বছর আগে বাংলার মঞ্চ নাটকে প্রথমবার দেখা গিয়েছিলো গ্যালিলিওকে। তখন নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা আতাউর রহমান। সেসময় টানা দশ বছর নাটকটির মঞ্চায়ন চললেও গত বিশ বছর ধরে মঞ্চায়ন বন্ধ থাকে ‘গ্যালিলিও’র।  

তবে এবার নতুন রূপে বাংলার দর্শকের সামনে মঞ্চে গ্যালিলিওর জীবনী নাট্য নির্দেশনায় উপস্থাপন করলেন পান্থ শাহরিয়ার। আর এ নাটকটিতে গ্যালিলিওর নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া ফেলেছেন আলী যাকের। এছাড়া অধ্যক্ষ, বারবেরিনি ও পোপ চরিত্রে অভিনয় করছেন আসাদুজ্জামান নূর।

গ্যালিলিও নাটকের কাহিনীর সময়কাল ১৬০৯ সাল। ইতালির বিখ্যাত পদার্থ ও অঙ্কশাস্ত্রবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি ঘোষণা দিলেন সূর্য স্থির আর পৃথিবী ঘূর্ণায়মান। আরও বললেন সৌরজগতে স্ফটিক স্তর বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

এর আগে মানুষ জানতো পৃথিবী স্থির এবং সূর্য তার চারপাশে ঘুরে আলোকিত করছে পৃথিবীকে। মানুষের দীর্ঘকালের বিশ্বাসে আঘাত হানে গ্যালিলিওয়ের এ মতবাদ। ফলে খেপে উঠেন চার্চের অধিকর্তা। বছর দশেক আগে এমন কথা বলায় পুড়িয়েও মেরে ফেলা হয়েছিল একজনকে।

নিজের যুক্তিকে আশ্রয় করে গ্যালিলিও ছুটে যান মানুষের কাছে। প্লেগের মতো মহামারিও তাকে আটকে রাখতে পারেনি। চার্চের ক্ষমতা আর রাষ্ট্র যন্ত্রের সামনেও মাথা নত করেনি। তবে শারীরিক যন্ত্রণার কাছে নতি স্বীকার করে ১৬৩৩ সালের ২২ জুন। তিনি স্বীকার করেন তার মতবাদ ভুল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় ইতালির সমস্ত গবেষণা, নতুন চিন্তা আর আবিষ্কারের পথ।

এসময় তার অনুসারীরা গ্যালিলিওকে কলঙ্কের নাম উল্লেখ করে ঘোষণা দেন। গ্যালিলিও চলে যান ধর্ম আদালতের কড়া নজরদারিতে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন আর্চ বিশপের মতামত দেওয়া আর হোরেসের মধ্যে। কিন্তু নিজের মধ্যে গর্ববোধ আগলে রেখেছিলেন সযত্নে। মৃত্যুর আগে লিখে রেখেছিলেন তার মতবাদ। পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে গিয়েছিলেন বিজ্ঞান সাধারণের জন্য, সবার জন্য।

নাটকটিতে আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর ছাড়াও আরও অভিনয় করেছেন পান্থ শাহরিয়ার। তিনি খালেদ খানের আন্দ্রিয়া সার্তি চরিত্রে রূপ দিয়েছেন। এছাড়া সিনোরা সার্তি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারহানা মিঠু, লুদোভিকা মার্সিলি চরিত্রে মোস্তাফিজ শাহীন, সাগরেদো ও বেলারমিন চরিত্রে কাওসার চৌধুরী, ফেদারজোনি চরিত্রে ফারুক আহমেদ, ধর্মযাজক চরিত্রে ফখরুজ্জামান চৌধুরীসহ নাগরিকের নতুন ও পুরোনো অভিনেতারা অভিনয় করেছেন প্রযোজনাটিতে।

গ্যালিলিও’র মঞ্চায়নে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো, যাদের অধিকাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।  

নাটক সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ কথা হয় বিভিন্ন দর্শকদের সঙ্গে। তারা বলেন, দর্শকদের মুগ্ধ করার মতো নাটক ছিল ‘গ্যালিলিও’। দুই কিংবদন্তি অভিনেতা আলী যাকের আর আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয় ছিল অনবদ্য। আর মঞ্চ নাটকে তরুণ দর্শকদের উপস্থিতি এ অঙ্গনের জন্য অবশ্যয় একটি পজিটিভ বিষয়।

নাটক নিয়ে নির্দেশক পান্থ শাহরিয়ার বাংলানিউজকে জানান, আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি আগে আড়াই ঘণ্টার ছিল সেটাকে আমি দেড় ঘণ্টায় নামিয়ে এনেছি। এখনকার দর্শকদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে। আড়াই ঘণ্টার নাটক এখন তারা দেখতে চায় না। তাই একটু নতুনভাবে মঞ্চায়নে নাটকটির পরিকল্পনা করেছি। আতা ভাই আশির দশকে যে ‘গ্যালিলিও’ করেছিলেন সেটা বাংলা মঞ্চ নাটকের মাইলস্টোন হয়ে আছে। এটাকে নতুন করে তৈরি করা আমার জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

তিনি আরও বলেন, আজকের সময়ে মিথ্যা যে চারদিক ঢেকে দিচ্ছে, অথচ গ্যালিলিও তার সময়ে বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে সত্যের জন্য যে ফাইট করেছিলেন এটা তরুণদের অনুধাবন করাতে চাই। এই নাটকটি দেখে ইয়াং জেনারেশন যদি বিন্দুমাত্র অনুধান করতে পারেন যে, সত্যের জন্য ফাইট করা দরকার আছে তাহলেই আমি মনে করি আমি ও আমার দল পুরোপুরি সাকসেস। গ্যালিলিওর সময়ে ধর্মান্ধতা কিংবা শাসক শ্রেণির যে চেপে বসা, এটা তখন যেমন ছিল এখনও তেমনি প্রাসঙ্গিক। এরকম একটি নাটক তরুণ প্রজন্ম যেন দেখতে পায়, সেজন্যই আমরা তাদের টার্গেট দর্শক ভেবেছি এবং আমরা মনে করি আমাদের টার্গেট পূরণ হচ্ছে।

বার্টল্ট ব্রেখটের ‘দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি’ অবলম্বনে গ্যালিলিও নাটকটির অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। শিল্পকলা একাডেমিতে নতুনভাবে মঞ্চে আসা প্রযোজনাটির তৃতীয় প্রদর্শনী হয় মঙ্গলবার। আগামী ১০ নভেম্বর শনিবার দর্শকের আগ্রহের কথা মাথায় রেখে আবারও প্রদর্শিত হবে ‘গ্যালিলিও’।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৮
এইচএমএস/এপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।