মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া কমপ্লেক্সের বাংলানিউজ কার্যালয়ে জমে ওঠে এ আড্ডা।
আড্ডায় ছিলেন- বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক কবি জুয়েল মাজহার, কবি পৃথ্বীরাজ চৌধুরী, বাংলানিউজের হেড অব নিউজ কবি আহমেদ জুয়েল, কালের কণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক কবি মাসুদ হাসান, বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট কবি উপল বড়ুয়া, নিউজরুম এডিটর কবি ফারাহ্ মাহমুদ ও কবি হিজল জোবায়ের।
আড্ডাপর্বের বিভিন্ন মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেন বাংলানিউজের ফটো করেসপন্ডেন্ট রাজীন চৌধুরী। চিত্রধারণে ছিলেন ভিডিও প্রডিউসার সাইফুল ইসলাম আদনান।
সন্ধ্যার সীমান্তপথে তখন সবে রাত নামতে শুরু করেছে। গোল হয়ে বসেছেন কবিরা। আলাপ বাড়তে থাকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, দেশভাগ, অভিবাসন, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে।
অপরিচয়ের দূরত্ব কাটাতে আড্ডার কবিরা একে একে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে থাকেন পৃথ্বীরাজ চৌধুরীর দিকে। বাংলাদেশে তিনি কী নিয়ে গবেষণা করছেন, এ দেশ নিয়ে তার আগ্রহের কারণ, বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে তার জানাশোনাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে।
পৃথ্বীরাজ জানান, তিনি মূলত অর্থনীতির শিক্ষক। অভিবাসন, পেশা, পুঁজি এসব নিয়েই তার কাজ। বাংলাদেশে এসেছেন ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল’ নিয়ে গবেষণা করতে।
আলাপে আলাপে জানা যায়, পৃথ্বীরাজের বাবা-মা মূলত সিলেট অঞ্চলের মানুষ। দেশভাগ তাদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তারা এখনও সিলেটি ভাষায় কথা বলতে বলতে মাতৃভূমির জন্য আহাজারি করতে থাকেন। বাংলাদেশের প্রতি তাদের সেই মমতা যথারীতি বাহিত হয়েছে পৃথ্বীরাজের ভেতরেও। বোস্টনেও তার বন্ধুদের অনেকেই বাংলাদেশী। ফলে এ দেশের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।
এবারে আলাপ গড়ায় ভিন্ন খাতে। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে জানতে চাওয়া হয় পৃথ্বীরাজের কাছে। সেই ২০০৫ সালের পর থেকে দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ থেকে দূর মার্কিন মুল্লুকে বসবাস করায় বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে সবিস্তারে জানা হয়ে ওঠেনি, স্বীকার করেন এ কবি। জানান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আছেন তার প্রিয় লেখকদের তালিকায়। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতও খুব মন দিয়ে শুনেছেন বলে জানান তিনি।
পৃথ্বীরাজের কথার প্রসঙ্গে এবারে আলাপ বাড়ান কবি জুয়েল মাজহার। বলেন, বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা সব অঞ্চলের বাংলা সাহিত্যের ব্যাপারেই সবিস্তার খোঁজখবর রাখে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যসমাজ বাংলাদেশের সাহিত্যের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। তারা যেন এক ধরনের হায়ারার্কি তৈরির ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা জয় গোস্বামীরা বহুকাল আগে যাদের নাম উচ্চারণ করে গেছেন আজ অব্দি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যমহল তাদের নামই জানে। এর পরবর্তীতে এখনকার সময় পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি, সাহিত্যিক বাংলাদেশে জন্মেছেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পুষ্ট করেছেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তাদের নাম জানে না। এটি এক ধরনের উন্নাসিকতা। কিন্তু এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না, বরং তারাই বঞ্চিত হচ্ছে।
পৃথ্বীরাজ নিজে এ দলে পড়েন না জানিয়ে বলেন, আজকের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সহজেই আমরা যে কোনো অপরিচয়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলতে পারি। ফেসবুক, স্কাইপেসহ সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যম, প্রযুক্তি আমাদের সহায় হতে পারে। আমরা চাই এ ব্যবধান ঘুচে যাক।
জুয়েল মাজহার তাতে কিছুটা একমত হয়ে বলেন, সব দেশে সব যুগেই কোয়ালিটি লেখা বা লেখক থাকে হাতে গোনা। কিন্তু ভার্চুয়াল জগত অতিরিক্ত অবারিত হওয়ায় এখানে বীজধানের চেয়ে চিটাধানের অনুপ্রবেশ অনেক বেশি। সেই ভিড়ে ওই গুটিকয় ভালো লেখা বা লেখক প্রায়শই হারিয়ে যায়। ফলে দেখা যায়, বিলো মিডিওকার লোকজন শিল্প-সাহিত্যের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। এতে এক ধরনের হেজিমনি তৈরি হয়। তাই, ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্যবহারে আমাদের আরও সাবধানী হতে হবে। যোগাযোগ বাড়াতে হবে ভার্চুয়াল জগতের বাইরেও।
আড্ডার এ পর্যায়ে উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ও ইংরেজির আগ্রাসনে বাংলা ভাষার কোণঠাসা হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ। পৃথ্বীরাজ বলেন, কলকাতায় এখনকার অনেক বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েরাও বাংলা ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি তাদের কাছে হয়ে উঠছে দূরের বিষয়। মূলত বাঙালিরা সেখানকার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলাতেই এমনটা ঘটছে বলে তার অভিমত।
এ প্রসঙ্গেই জুয়েল মাজহার বলেন, যতদূর জানি খোদ কলকাতায় বাঙালি এখন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য, ইন্ডাস্ট্রি মূলত অন্যদের নিয়ন্ত্রণে। সব মিলিয়ে সেখানে বাঙালিদের অবস্থা আসলেই অ্যালার্মিং। হিন্দির দাপটে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখুন, বাংলাদেশেও হিন্দি গান বা ছবি প্রচুর পরিমাণে দেখা হয়, কিন্তু আমরা সেগুলো বিনোদন হিসেবেই নেই। আমাদের এখানে দেখবেন না, কেউ হিন্দিতে কথা বলছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেটা ঘটছে, সেখানকার বাঙালিরা হিন্দিতে কথা বলছে। এ ব্যাপারে তাদের আরও বেশি প্রতিরোধের মানসিকতা অর্জন করা দরকার। পূর্ববঙ্গে সেটা আছে। আমরা বাংলা ভাষাটাকে অনেক জীবন্ত রেখেছি। পূর্ববঙ্গের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। একাত্তরে আমরা প্রাণ দিয়েছি। আমরা মরতে জানি। মৃত্যু বরণ করার মতো ক্ষেপামি আমাদের আছে।
আরও যোগ করে জুয়েল মাজহার বলেন, আরেকটা ব্যাপার দেখুন, কলকাতায় এখনও সেই প্রমিত বাংলা ভাষাটাই ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাষার শরীরে নতুন রক্ত সংবহন করা হচ্ছে না। বাঁকবদল নেই। এরকম ক্ষেত্রে নদীর মতো ভাষাটাও মরে যেতে থাকে। কিন্তু আমরা ভাষার অনেক ধরনের রকমফের আত্মসাৎ করি। আঞ্চলিক ভাষাকে প্রমিতের শরীরে প্রবেশ করাই। আমাদের সাহিত্যে সেই জসীম উদ্দীন, আল মাহমুদেও আপনি এগুলো পাবেন। এখনও সে সব কাজ হচ্ছে। ক্রমাগত নতুন রক্ত সংবহন করা হচ্ছে ভাষার শরীরে। ফলে আমাদের বাংলা ভাষাটা অনেক বেশি জীবন্ত।
দীর্ঘ সে বৈঠকীতে আলাপ আরো নানা দিকে ডালপালা ছড়াতে থাকে। নানা বিষয়ে তর্কে-বিতর্কে মেতে ওঠেন কবিরা। ওদিকে শীতের রাত আরো ঘন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাইরে বিস্তীর্ণ কুয়াশার চাদর। ফলে এক পর্যায়ে সব ফেলে রেখে কবিরা কবিতার ওমের কাছে ফিরে যায়। আরো ঘন হয়ে বসে। শুরু হয় কবিতাপাঠ। একে একে স্বকণ্ঠে কবিতা পড়ে শোনান জুয়েল মাজহার, পৃথ্বীরাজ চৌধুরী, আহমেদ জুয়েল, মাসুদ হাসান, উপল বড়ুয়া, ফারাহ্ মাহমুদ ও হিজল জোবায়ের।
জুয়েল মাজহার শোনান ভাটি বাংলার নিখাদ কবিতা। তাতে ফুটে ওঠে পূর্ববঙ্গের নদী-জংলা, স্মৃতিকাতরতা আর মাতৃপ্রেমের ছবি। পৃথ্বীরাজ চৌধুরী শোনান দেশভাগের বেদনায় গাঁথা দীর্ঘ কবিতা। আর তাতে উঠে আসে সিলেটের কান্নাধোয়া নদী আর পাহাড়ের গল্প। দেশভাগের শহীদ ঋত্বিককুমার ঘটকও কাঁটাতার পেরিয়ে একবার উঁকি মেরে যান। কবিতা পড়ে শোনান অন্যরাও। শীত কুয়াশায় কবিদের সেসব কবিতা যেন হয়ে ওঠে উষ্ণতা ছড়ানো নাড়ার আগুন, বহুদূরের ছেড়ে আসা মাতৃকোল।
এবারে শীত রাতের পাখিরা শিস দিতে শুরু করে। তাতে মিশে আছে ঘরে ফেরার সুর। অগত্যা মনের বিরুদ্ধে পাততাড়ি গুটিয়ে সেদিনের মতো উঠে পড়ে কবিরা যার যার গন্তব্যের দিকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৯
এইচজে