চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী ‘কুনমিং’কে বলা হয় ‘চির বসন্তের শহর’। সারা বছরই বসন্ত কালের মতো আবহাওয়া।
অনেকদিন থেকে কুনমিং বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। অবশেষে সুযোগের সঙ্গে সময়ের সংযোগ ঘটল। যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে চায়না ইস্টার্নের একটি ফ্লাইটে কুনমিং’র উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়লাম। প্রায় দুই ঘণ্টা উড্ডয়নের পর প্লেনটি কুনমিং এয়ারপোর্টে অবতরণ করলো। সুন্দর ঝকঝকে বিশাল এয়ারপোর্টটি ২০১২ সালে চালু হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০টি এয়ারপোর্টের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে এটি।
ইমিগ্রেশন সেরে বেরিয়ে দেখি একটি ছিমছাম যানজটমুক্ত আধুনিক শহর। আগে থেকেই হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল। একটি ট্যাক্সি নিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম।
ইন্টারনেটের বদৌলতে আগে থেকেই দশর্নীয় স্থানগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে রেখেছিলাম। আর কোনদিন কোনটা দেখব তাও ঠিক করে রেখেছিলাম আগে থেকেই।
সফরের প্রথম দিন শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শহরটি সম্পর্কে একটি ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত প্রায় ২৪০০ বছরের একটি পুরানো শহর বর্তমানে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের এক অনুপম নিদর্শন। আকাশ ছোঁয়া সব দৃষ্টি নন্দন অট্টালিকা এবং প্রশস্ত রাস্তা।
এখানকার মানুষজনও খুবই ভদ্র ও সহনশীল। চারদিকে ফুলের সমারোহ। সারা বছরই নানা রঙ্রে ফুলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় পুরো শহরটিই যেন একটি বৃহৎ ফুলের বাগান।
বিশাল একটি ফুলের মার্কেট আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফুল রপ্তানি হয় এখান থেকে।
এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থাও খুবই ভাল। বাস, ট্রেন, মেট্রো সবই আছে। বাস খুবই সহজলভ্য এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা। ১ অথবা ২ আরএমবি দিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া যায় (১ আরএমবি সমান ১৩ টাকা)।
দ্বিতীয় দিন আমারা ঘুরে বেড়িযেছি পৃথিবীর প্রথম বিস্ময় হিসেবে খ্যাত ‘স্টোন ফরেস্ট’। কুনমিং শহর থেকে ১২০ কি. মি. দক্ষিণে এই দশর্নীয় স্থানটি অবস্থিত। বাস, ট্রেন, ট্যাক্সিতে খুব সহজেই যাওয়া যায় এখানে। আমরা সকালে কুনমিং রেলস্টেশন থেকে একটি ট্রেনে মাত্র দেড় ঘণ্টায় স্টোন ফরেস্টে পৌঁছি। স্টোন ফরেস্ট প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল। চারদিকে পাথরের অভূতপূর্ব সব কারুকার্য। প্রায় ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছোট বড় উঁচু নীচু বিভিন্ন আকৃতির পাথর বৃক্ষের মত দাঁড়িয়ে আছে।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, প্রায় ২৭ কোটি বছর পূর্বে এখানে সমুদ্র ছিল। সেই সমুদ্রের তলদেশে ছিল চুনা পাথরের স্তর। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে এই স্তর ক্রমাগত উঁচু হতে হতে শিলা স্তরের অভিঘাতে এক সময় ছোট ছোট টিলার আকৃতি নেয়।
ভূমি ক্ষয় ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে ধীরে ধীরে পাথরগুলো বিভিন্ন আকৃতিতে রপান্তরিত হয়ে স্থানটিকে পাথুরে ভাস্কর্যের আর্ট গ্যালারিতে পরিণত করে।
দূর থেকে দেখেলে মাঝে মাঝে বিশাল গাছ, জীবজন্তু বা মানুষের আকৃতি বলে একে ভুল হতেই পারে।
স্টোন ফরেস্টের কয়েকটি পাথরের আকৃতি খুবই আকর্ষণীয়। এর মধ্যে অন্যতম ‘আশিমা’ নামক পাথর স্তম্ভটি। একটি নির্দিষ্ট কোণ থেকে দেখলে মনে হয় যে একটি তরুণী মাথায় রুমাল বেঁধে পিঠে বাশের ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয় উপজাতিরা মনে করে যে, ‘আশিমা’ হচ্ছে ‘ই’ জাতিগোষ্ঠীর ‘সানি’ গোত্রের একটি মেয়ে। আশিমাকে নিয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তী ও লোককাহিনী প্রচলিত আছে। এছাড়াও লায়ন, ক্যামেল, অ্যালিফেন্ট নামক পাথর খণ্ডগুলো পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।
স্টোন ফরেস্টের প্রবেশমূল্য ১৭৫ আরএমবি। দশনার্থীদের জন্য সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
তৃতীয় দিন আমাদের পূর্বনিধারিত গন্তব্য স্থান ‘ডায়ানচি লেক’। কুনমিং শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে ওয়েস্টান হিলের পদদেশে এই বিখ্যাত লেকটি অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬১৮৭ ফুট উপরে এবং ৩০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত লেকটি চীনের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম মিঠা পানির লেক। অর্ধচন্দ্রাকৃতির এই লেকটির দৈর্ঘ্য ৩৯ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৩ কিলোমিটার এবং গড় গভীরতা ১৪ ফুট। চারদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত লেকটি ২০টি অধিক নদীর মিলনস্থল।
চমৎকার এই লেকটি বিভিন্ন দশর্নীয় স্থান দ্বারা পরিবেষ্টিত যেমন- ওয়েস্টান হিল, ডাগুয়ান পার্ক, আদিবাসী গ্রাম, ইউনান জাতীয় জাদুঘর, গ্রান্ড ভিউপার্ক, হুয়াটিং টেম্পল, ড্রাগন গেট ইতাদি। ক্যাবল কার বা বোটে চড়ে পর্যটকরা পাহাড় ও লেকের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারে।
বিকালে শহরের কেন্দ্রস্থল জিংজিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত ‘বাডর্স অ্যান্ড ফ্লাওয়ার মার্কেট’ এ গিয়েছিলাম। খুবই জনপ্রিয় ও বিশাল বাজার। কুনমিং এর বিখ্যাত ক্যামেলিয়া, অর্কিড, লিলি, গোলাপ, টিউলিপসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল এখানে পাওয়া যায়। মার্বেল ও পাথরের বিভিন্ন শোপিসও এখানে পাওয়া যায়।
এছাড়াও কুনমিংয়ের অন্যান্য দশর্নীয় স্থানসমূহ যেমন-গোল্ডেন টেম্পল, ওয়াল্ড হর্টিকালচার এক্সপো, ব্ল্যাক ড্রাগনপুল, বামবু টেম্পল ভ্রমন করতে পারেন। কেনাকাটার জন্য শহর জুড়ে অনেক শপিং মলও চোখে পড়বে। দোকানে প্রচুর দরকষাকষি চলে।
ভাষা এখানে একটি বড় সমস্যা। চীনা ভাষা ছাড়া এরা কিছুই বোঝেনা। ইংরেজি জানা চীনার সংখ্যা খুবই কম। খাবার কারো কারো জন্য সমস্যা হতে পারে। তবে বাংলাদেশি গেস্টহাউসগুলোতে বাংলাদেশি খাবার পাওয়া যায় এবং দামও হাতের নাগালে।
কিভাবে যাবেন
চায়না ইর্স্টানের ঢাকা-কুনমিং সরাসরি দৈনিক ফ্লাইট আছে। এছাড়াও প্রতি মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার অতিরিক্ত একটি ফ্লাইট পরিচালনা করে। রাউন্ড ট্রিপ ভাড়া ৩৫,০০০ - ৪২,০০০ টাকা।
কখন যাবেন
মনোরম আবহাওয়ার জন্য কুনমিং সারা বছরই ভ্রমনের জন্য উপযুক্ত। তবে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সেরা সময়। এসময় উপজাতি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উৎসব থাকে। এছাড়াও ফুল ও ফলের প্রাচুর্য্য এ সময়ে বেশি দেখা যায়।
কোথায় থাকবেন
বাংলাদেশিদের থাকা ও খাওয়া জন্য এখানে অনেকগুলো বাংলাদেশি গেস্ট হাউস বা রেস্টহাউস আছে। এদের সার্ভিসও ভাল। এসব গেস্ট হাউসের প্রতিনিধিদের সাক্ষাত পাওয়া যাবে বিমান বন্দরে নামলেই।
এছাড়াও শহরের কেন্দ্রস্থলে হোটেলও থাকা যাবে। প্রচুর হোটেল আছে, ভাড়াও খুব বেশি নয়। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাই হোটেলগুলোতে পাওয়া যাবে।
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- bntravellers.notebook@gmail.com এই ঠিকানায়
লেখক: আবদুল মোনেম
monem_bappi@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর