বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে: ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন শুক্রবার। শেষ দিন অমর একুশে গ্রন্থমেলারও।
৫২’র ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী শুরু হয় এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এবারই প্রথম মেলা বাংলা একাডেমির সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও।
শুক্রবার বেলা ১১টায় সর্বসাধারণের জন্য মেলার দরজা উন্মুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তার আগ থেকেই মেলায় প্রবেশের জন্য বাংলা একাডেমির সামনে ভিড় করতে থাকেন বইপ্রেমীরা। দুপুর গড়াতেই সে ভিড় জনারোণ্যে পরিণত হয়।
একদিকে টিএসসি অপরদিকে দোয়েল চত্বর, এই দু’দিক থেকেই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মেলায় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নানা বয়সী বইপ্রেমীরা। যেহেতু মেলা থেকে প্রিয় লেখকের বই কেনার আজই শেষ সুযোগ, তাই কেউ এ সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন।
মেলায় আজ কেউ এসেছেন পরিবারের কারও সাথে আবার কেউ এসেছেন প্রিয় মানুষটির হাত ধরে। প্রিয় লেখকের বই কেনার জন্য লাইন শেষে স্টলের সামনে গিয়েও আবার লাইনে দাঁড়িয়ে বই কিনছেন তারা।
রাত নয়টা বাজতেই ভেঙে যায় প্রাণের মেলা। লেখক-পাঠক-দর্শনার্থীদের চোখে একদিকে যেমন ছিল মিলনের তৃপ্তি অন্যদিকে ছিল অপূর্ণতার আক্ষেপ।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার শেষ দিন ৩০টি গল্প, ২৪টি উপন্যাস, ১২টি প্রবন্ধ, ৩৭টি কবিতা, তিনটি গবেষণা, ১৩টি ছড়া, তিনটি শিশুতোষ, সাতটি জীবনী, একটি রচনাবলী, চারটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, তিনটি নাটক, তিনটি বিজ্ঞান, চারটি ভ্রমণ, তিনটি ইতিহাস, একটি চিকিৎসা, একটি কম্পিউটার, দু’টি রম্য/ধাঁধা, দু’টি ধর্মীয়, একটি অভিধান এবং ২০টি অন্যান্যসহ মোট ১৭৪টি নতুন বই এসেছে মেলায়।
এর মধ্যে নজরুল মঞ্চে ১৪টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
সকালের আয়োজন শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় অমর একুশে উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কণ, সংগীত ও সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশু-কিশোরদের পুরস্কার দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দীন আহমদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে গান বাংলা টেলিভিশনের পরিচালক শিল্পী মাহমুদ সেলিম উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোহিত কামাল।
মূলমঞ্চের আয়োজন বিকেল চারটায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের বিস্ময়কর আর্থ-সামাজিক সাফল্যের উৎস এবং এর সাম্প্রতিক সমস্যা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে পাঠ করা প্রবন্ধে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, একাত্তর সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সারা বিশ্বের বিস্ময় ও আকাশসম বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে দেশে বিদেশে ক্রিয়াশীল বৈরী শক্তির মোকাবেলা করে বাংলাদেশের টিকে থাকা এবং বিপুল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাঝে দৃষ্টিনন্দন আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি অর্জন যে একটি বিস্ময়কর চমক তার সাফল্যগাঁথা রয়েছে বেশুমার। জাতির জনকের অকুতোভয়, গতিময়, উদ্ভাবনী ও প্রত্যয়ী নেতৃত্ব যেমন দেশের স্বাধীনতা এনেছে তেমনি তার অর্থনৈতিক মুক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিষাণ-কিষাণী ও শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী শিল্প উদ্যোক্তাদের সৃষ্টিকুশলতা মিলেই আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতির মজবুত অবস্থান ও দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার চলার পথ।
আলোচকরা বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকলেই বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক সাফল্য অব্যাহত থাকবে। কাজী খলীকুজ্জামানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অংশ নেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, মেসবাহ কামাল ও জিয়া রহমান।
গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান
সন্ধ্যা ছয়টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৪-র সমাপনী অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামন নূর বলেন, সবার একান্ত সহযোগিতায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৪ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্রন্থমেলা স্থানান্তর আমাদের জন্য ছিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে আরো সুপরিসরে মেলা আয়োজনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক সহায়তা প্রয়োজন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, স্থায়িত্ব ও বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে ঐতিহাসিক বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা সুন্দরভাবে শেষ হতে চলেছে যা আমাদের উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ভবিষ্যতেরই বার্তা বহন করে।
সভাপতির বক্তব্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, একুশে গ্রন্থমেলা আজ এক জাতীয় উৎসবের নাম। বইয়ের প্রতি যে ভালোবাসা এই মেলা উপলক্ষে প্রকাশ হতে দেখি তা তুলনাহীন তবে মেলা সম্প্রসারণের পাশাপাশি এর আঙ্গিক নিয়েও নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থমেলা ২০১৪’র প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মেলার সদস্য-সচিব ও একাডেমির পরিচালক শাহিদা খাতুন।
গ্রন্থমেলায় শহীদ মুনীর চৌধুরী ও চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার প্রদান সমাপনী অনুষ্ঠানে সর্বাধিক সংখ্যক মানসম্মত গ্রন্থ প্রকাশের জন্য মাওলা ব্রাদার্স, প্রথমা প্রকাশন ও অন্বেষা প্রকাশনকে ‘শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ ও বেঙ্গল পাবলিকেশন্স-এর অন্তর্দাহ এবং পাঠক সমাবেশের কাফকা সমগ্র গ্রন্থটিকে সেরা গ্রন্থের জন্য ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ হিসেবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের হাতে পুষ্পস্তবক, ক্রেস্ট ও সনদ তুলে দেওয়া হয়।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন শাহীন সামাদ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ইফফাত আরা দেওয়ান, বুলবুল মহলানবীশ, ইফফাত আরা নার্গিস, শ্রেয়সী রায়, সানজিদা মনজুরুল হ্যাপী এবং নবিন কিশোর।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন বিশ্বজিত সরকার (তবলা), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), আবু কামাল (বেহালা), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কী-বোর্ড) এবং নাজমুল আলম খান (মন্দিরা)।
শনিবার সকাল ১০টায় প্রকাশকরা স্টলগুলো থেকে তাদের বই নিয়ে যেতে পারবেন।
** শেষ বিকেলে জনারণ্য বইমেলা
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৪