ঢাকা: ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ নামে প্রকাশিত একটি বইয়ের ইস্যু পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। এরই মধ্যে একুশে বইমেলা থেকে বইগুলো জব্দ করে নিয়ে গেছে পুলিশ।
বইটি বইমেলা থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ দেখিয়েছেন নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সেখানে বিশিষ্টজনদের নামে পাঠানো একটি প্রতিবাদলিপি বাংলানিউজের কাছে পৌঁছেছে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক কলামিস্ট হাসান ফেরদৌস ও লেখক ইকবাল হাসানের পাঠানো প্রতিবাদলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন ৩৬ জন বিশিষ্ট প্রবাসী বাংলাদেশি।
প্রতিবাদে বলা হয়েছে বিশ্বজিত সাহা রচিত ও ঢাকার বাংলা প্রকাশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ বাংলা একাডেমি বইমেলার প্রাঙ্গণ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের বিধবা স্ত্রী মেহের আফরজ শাওনের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ এই ব্যবস্থা নিয়েছে। কোনো বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ কর্তৃক বইটি জব্দ করার ঘটনায় আমরা তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাচ্ছি।
এতে আরও বলা হয়, এর আগে বিবাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বইটি বাজেয়াপ্ত করার একটি মামলা আদালত খারিজ করেছে। তারপরেও বইটির ব্যাপারে কোনো আইনগত সিদ্ধান্ত ছাড়া, এভাবে জব্দ করার ঘটনা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, লেখকের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ।
প্রতিবাদকারীরা জব্দকৃত সব বই প্রকাশক ও বিক্রেতাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেন। প্রতিবাদে স্বাক্ষরকারীরা হচ্ছেন- জামালউদ্দীন হোসেন (শিল্পী, নিউইয়র্ক), ড. নুরন নবী (লেখক, আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিবিদ), রোকেয়া হায়দার (সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকা), হাসান ফেরদৌস (লেখক ও সাংবাদিক, নিউইয়র্ক), ইকবাল হাসান (থান্ডারবিল, কানাডা), ফেরদৌস সাজেদীন (লেখক ও সাহিত্যিক, নিউইয়র্ক), সাজেদ কামাল (কবি ও সাহিত্যিক, বস্টন), মঞ্জুর আহমেদ (লেখক, সম্পাদক- আজকাল, নিউইয়র্ক), মুহাম্মদ ফজলুর রহমান (প্রধান সম্পাদক- ঠিকানা, নিউইয়র্ক), কৌশিক আহমেদ (সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাঙালি), আবু তাহের, (সম্পাদক- বাংলাপত্রিকা, নিউইয়র্ক), লাবলু আনসার (সম্পাদক- ঠিকানা), গোলাম মোর্তজা (লেখক ও সাংবাদিক, ঢাকা), নিনি ওয়াহেদ (সাংবাদিক, নিউইয়র্ক), রেখা আহমেদ (শিল্পী, নিউইয়র্ক), সেজান মাহমুদ (লেখক, ফ্লোরিডা), শিতাংশু গুহ (লেখক ও সাংবাদিক, নিউইয়র্ক), মাহমুদুজ্জামান বাবু (লেখক ও শিল্পী, ঢাকা), আহমেদ মুসা (লেখক ও সাংবাদিক, নিউইয়র্ক), তমিজউদ্দীন লোদী (নিউইয়র্ক), শামস আল মোমীন (নিউইয়র্ক), ফকির ইলিয়াস (কবি, নিউইয়র্ক), আদনান সৈয়দ (লেখক, নিউইয়র্ক), ইউসুফ রেজা (টেক্সাস), এনায়েত করিম (চলচ্চিত্র নির্মাতা, টরন্টো), কাজী জহিরুল ইসলাম (কবি, নিউইয়র্ক), দর্পন কবীর (লেখক ও সাংবাদিক, নিউইয়র্ক), পপি চৌধুরী (লেখক ও প্রকাশক), তপন দেবনাথ (লেখক, লস এঞ্জেলেস), ফকির সেলিম (সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকা), রতন তালুকদার (সম্পাদক- জন্মভূমি, নিউইয়র্ক), খুরশীদ আলম সেলিম (শিল্পী, লংআইল্যান্ড), হুমায়ূন কবীর (লেখক, টেনেসি), শিখা আহমাদ (শিল্পী, কানাডা), রুমী কবির (সাংবাদিক ও লেখক, আটলান্টা), ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদ (আহ্বায়ক, আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা-২০১৪, ফিলাডেলফিয়া)।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লেখা এই বইটি নিয়ে জটিলতা চলছে ২০১৩ সাল থেকেই। বইয়ে অসত্য তথ্য রয়েছে-এই অভিযোগে দুই প্রকাশককে লিগ্যাল নোটিশ দেন হুমায়ূনের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের আইনজীবী। নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে বাজার থেকে ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ শিরোনামে প্রকাশিত বইটি প্রত্যাহার, ধ্বংস এবং অসত্য বক্তব্য প্রকাশের কারণে শাওনের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। অন্যথায় দুই প্রকাশকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এবং আমেরিকায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। ওই বছর মে মাসের শেষ দিকে শাওনের পক্ষে লিগ্যাল নোটিশটি পাঠান সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়, ‘বইটির ৭১ ও ৮৮ নম্বর পৃষ্ঠাসহ বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১২ সালের ১২ জুন অপারেশনের পর প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে পড়ে যান হুমায়ূন আহমেদ। এরপর তার শরীর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়। এ ঘটনার পর তাকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখন চিকিত্সকের কাছে এ পড়ে যাওয়ার কথা গোপন করা হয়েছে। তার অবস্থা দিন দিন খারাপ হওয়ার এক পর্যায়ে ২১ জুন তিনি আর কথা বলতে পারেননি। ‘বইয়ে লেখা ওই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণের জন্য হুমায়ূন আহমেদের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা একটি ছবি ছাপানো হয়েছে। ’
নোটিশে বলা হয়, ‘বইয়ে প্রকাশিত এ বক্তব্য আদৌ সত্য নয়। এটা লেখার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শাওনের দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। শাওনকে হেয় করার জন্য এ ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে। ২১ জুন হুমায়ূন আহমেদ কথা বলতে পারেননি, অভিযোগ সত্য নয়। ২১ জুনের পর জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আব্দুল মোমেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে যাননি। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা ছবিটি ২০০৮ সালে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা এলাকায় স্যুটিংয়ের (জোত্স্না ও জননীর গল্প নাটকের স্যুটিং) সময়ে চেয়ারে বসে থাকার ছবি। ’
নোটিশে আরো বলা হয়, ‘বইয়ে বলা হয়েছে, গত বছরের ২১ জুন সকাল ৯টা ১২ মিনিটে জ্যামাইকার একটি হাসপাতালের (মেমোরিয়াল স্লোন-ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার) হুমায়ূন আহমেদকে ভর্তি করা হয়। সেখানে বিকেল ৫টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত সময়ে হুমায়ূন আহমেদকে তিনবার চেকআপ করানো হয়েছে। কিন্তু সার্বক্ষণিকভাবে শাওন হুমায়ূন আহমেদের পাশে ছিলেন না। শাওনকে বার বার ফোন করে করে আনা হয়েছে। বইয়ে প্রকাশিত এ বক্তব্যও সঠিক নয়। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শাওন হুমায়ূন আহমেদের পাশে ছিলেন। ’
নোটিশে বলা হয়, ‘বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, জ্যামাইকা হাসপাতালে ভর্তির পর হুমায়ূন আহমেদের পরিস্থিতি অবনতির পর শাওনের ধারণা হয়, হুমায়ূন আহমেদ আর ভালো হবেন না। এ ধারণার পর হাসপাতালে জমা দেওয়া টাকা থেকে ২০ হাজার ৪৫২ দশমিক ৬৯ মার্কিন ডলার তুলে নেয় শাওন। এ অভিযোগও সত্য নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টাকা ফেরত দিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তির সময় এক লাখ ১৬ হাজার ৪১৫ মার্কিন ডলার জমা দেওয়া হয়েছিলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিল বাবদ ৯৫ হাজার ৯৬২ দশমিক ৩১ ডলার রেখে বাকি ২০ হাজার ৪৫২ দশমিক ৬৯ মার্কিন ডলার ফেরত দেয়। এ টাকা ফেরত দিয়েছে চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলের দিকে। ’
নোটিশে আরো বলা হয়, ‘হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর ২০ জুলাই জ্যামাইকার মুসলিম সেন্টারে জানাজা হয়। এ বিষয়ে বইয়ে বলা হয়, ওখানে হুমায়ূন আহমেদের ভাই অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী (ইয়াসমিন হক) উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু জানাজায় শাওন ও তার মা তহুরা আলী উপস্থিত থাকলেও বইয়ে তাদের কথা বলা হয়নি। এর মাধ্যমে বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শাওনের অবহেলার চিত্র ফুটিয়ে তোলার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
বইটির ৯৫ , ৯৬ ও ২৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে শাওন এবং মাজহারুল ইসলাম বিমানের প্রথম শ্রেণীর টিকেট ছাড়া দেশে আসবে না বলে জানান। এ কারণে হুমায়ূন আহমদের মরদেহ বাংলাদেশে আনতে দেরি হয়েছে। বইয়ে লেখা এ তথ্যও সত্য নয়।
বইয়ে আরো বলা হয়েছে, হুমায়ূন আহমেদ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তখন শাওন রাতে তার পাশে থাকতো না। এ অভিযোগও সত্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, যখন হুমায়ূন আহমেদ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন, তখন তার কাছে যেতে হলে মাক্স পরে যেতে হতো। এ পরিস্থিতিতে তার দু’টি সন্তানের কাছে থাকার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করেছিলেন। এ কারণে কিছু সময়ের জন্য হুমায়ূন আহমেদের কাছে থাকতে পারেননি শাওন।
বইয়ের ২৬০ নম্বর পৃষ্ঠায় আছে, প্রথম অপারেশনের পরে হুমায়ূন আহমেদকে পানীয় ও ভারী খাবার খেতে দেওয়া হতো বলে যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাও ভিত্তীহীন। ’
আমেরিকার জ্যাকসন হাইটসের মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী বিশ্বজিত সাহা এবং ঢাকার বাংলা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী ইঞ্জিনিয়ার মো. মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে এই লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময় ১০২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
আরএম/এমএমকে