ভাষা, আঙ্গিক ও বিষয় বৈচিত্র্যের কারণে ইতিমধ্যেই স্বকৃত নোমান অগ্রসর পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ লেখকের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজনটী, বেগানা, হীরকডানা ও কালকেউটের সুখ।
তরুণ এ ঔপন্যাসিকের ‘রাজনটী’ উপন্যাসটি এইচবিসি-কালি ও কলম পুরস্কারে ভূষিত হয়। এবার বইটির তৃতীয় মুদ্রণ মেলায় এসেছে। এছাড়া বিদ্যা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত তার ‘বেগানা’ ও ‘হীরকডানা’ উপন্যাস দুটিও নতুন বাঁধাইয়ে নতুন করে মেলায় এসেছে।
বাংলাদেশে উপন্যাস চর্চা, বইমেলা প্রসঙ্গসহ বিভিন্ন বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাংলানিউজের স্টলে এবং মেলায় হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় এ তরুণের সঙ্গে।
‘বাংলাদেশের উপন্যাসচর্চায় কোনো সংকট চলছে কি না’ এমন প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘এককথায় এর উত্তর দিতে চাই না... আমি মনে করি, উপন্যাস রচনার জন্য প্রয়োজন গভীর ধ্যান এবং পাঠ। এ দুটি না হলে আমাদের উপন্যাস চর্চার চলমান সংকট কিছুতেই কাটবে বলে মনে হয় না। তবে আমি আশাবাদী—অচিরেই বাংলাদেশে বড় মাপের ঔপন্যাসিক আসবেন। তিনি বাংলা উপন্যাসকে পৌঁছে দেবেন বিশ্বপাঠকের কাছে। আমরা আসলে একজন ঔপন্যাসিকের অপেক্ষা করছি। ’
তার মতে, ‘বাংলাদেশের উপন্যাস চর্চায় এখন একটা সংকট চলছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলীর পর সেই অর্থে বড় মাপের কোনো ঔপন্যাসিক আসেননি। এদের লেখা উপন্যাসের পর পড়ার মতো আমি তেমন কোনো উপন্যাস পাইনি। উপন্যাস তো অনেকেই লিখছেন, বইমেলায় গেলে দেখা যাবে কয়েক শ’ উপন্যাস। কিন্তু সিরিয়াস পাঠকের পড়ার মতো সিরিয়াস উপন্যাস কই?’
সিরিয়াস ধারার উপন্যাস রচনার প্রতি কি তরুণদের প্রবণতা কম?― জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তরুণদের প্রবণতা খুব একটা দেখতে পাই না। অজ্ঞাত কারণে সবাই কবিতার দিকে ঝোঁকেন, উপন্যাসের দিকে সহজে কেউ আসেন না। আমি এর একটা কারণ বের করেছি। উপন্যাস লেখার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়। এত দীর্ঘ সময় ব্যয় করার মতো ধৈর্য অনেকের থাকে না। ’
এবারের বইমেলায় অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে স্বকৃত নোমানের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘বালিহাঁসের ডাক। ’ ২০১৪ সালে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম গল্পের বই ‘নিশিরঙ্গিনী। ’ গত দুই বছরে লেখা মোট ১৪টি গল্প নিয়ে এই মেলায় প্রকাশিত হলো ‘বালিহাঁসের ডাক। ’ ফেব্রুয়ারির দুই তারিখেই বইটি মেলায় এসেছে।
বইটিতে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণ উপন্যাসের দিকেই বেশি মনোযোগ দেই। কিন্তু উপন্যাস তো আর একটানা লেখা যায় না। অন্তত আমি পারি না। একটা পর্ব লিখে আমাকে বেশ কিছুদিন বিরতি নিতে হয়। দ্বিতীয় পর্বটা কিভাবে শুরু করব তা নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। কখনো একটা প্যারা লিখে সপ্তাহ-দশদিন বিরতি নিই। ভাবি। এই বিরতির ফাঁকে আমি গল্প লিখি। বালিহাঁসের ডাকের গল্পগুলোতে আমি আসলে মানবজীবনের বহুমাত্রিক বোধের দিকে আলো ফেলতে চেয়েছি। ’
২০০৮ সালে ‘নাভি’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যে স্বকৃত নোমানের যাত্রা। বেশ ক’বছর তিনি উপন্যাস রচনায় নিবিষ্ট ছিলেন। গত তিন বছর ধরে উপন্যাসের পাশাপাশি গল্পও লিখছেন। সমালোচকদের অভিমত, গল্পকার হিসেবে তিনি সচেতন ও পরিশ্রমী। যা লেখেন বুঝেই লেখেন। প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের পেছনে তার শ্রম সহজেই চোখে পড়ে। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙেন, আবার গড়েন। গল্পের মধ্য শিল্পকুশলতায় সংযোজন করেন ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সংস্কার-কুসংস্কার-দর্শন এবং বিশ্বপ্রকৃতির নানা অনুসঙ্গ। তার গল্পের চরিত্ররা বাস্তবের মানুষ। গল্পের বাস্তবভূমি থেকে কল্পনার এমন এক স্তরে তিনি পৌঁছান, যে কল্পনা বাস্তবেরই সহোদর। বিষয়, ভাষা এবং আঙ্গিকের স্বাতন্ত্র্যের কারণে তার গল্প চিনে নেওয়া যায় আলাদাভাবে।
এবারের বইমেলার সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বকৃত নোমান বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবারের বইমেলার আয়োজন অনেক ভালো। পরিসর বাড়ানো হয়েছে। তবে একটা সমস্যা রয়েই গেছে। লিটলম্যাগাজিনের স্টলগুলো এখনও একাডেমি চত্বরেই রেখে দেওয়া হয়েছে। লিটলম্যাগ চত্বর লেখকদের প্রাণকেন্দ্র। সবাই ওখানে আড্ডা জমায়। এটা কি উদ্যানে আনা যেত না? তার মানে মেলা দুই ভাগে রয়েই গেল। একাডেমি কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে আশা করি দুই ভাগে রাখবে না। সব মিলিয়ে এবারের মেলা আগের চেয়ে আরও বেশি প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে আমার কাছে। ’
প্রতি বছর বইমেলায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বই প্রকাশিত হয়। সব বই কি মানসম্পন্ন? জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘মানের ব্যাপারটা আসলে আপেক্ষিক। আমার কাছে যে বইটি মানসম্পন্ন, অন্য একজন পাঠকের কাছে তা মানহীন হতে পারে। অনেক লেখক আছেন যাদের বই আমাকে ফ্রি দেওয়া হলেও আমি পড়ব না। কিন্তু আরেকজন টাকা দিয়ে সেটি কিনে পড়ছেন। ’
এবারের বইমেলা উপলক্ষে স্বকৃত নোমানের আরও দুটি বই বেরিয়েছে―অনুপ্রাণন প্রকাশনী থেকে ‘কথাসাহিত্যের অলিগলি’নামে মুক্তগদ্যের একটি বই। এছাড়া উৎস প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে কিংবদন্তী রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী।
বই দুটি সম্পর্কে স্বকৃত নোমান বলেন, গত দু-বছর কথাসাহিত্য বিষয়ে ফেসবুকে ও পত্রপত্রিকায় যেসব গদ্য লিখেছি সেগুলোর সংকলন হচ্ছে ‘কথাসাহিত্যের অলিগলি। ’ আর সব পাঠকের বোধগম্য করে লিখেছি তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী। তবে আমার মৌলিক বই কিন্তু একটাই―‘বালিহাঁসের ডাক। ’ এটিকে ঠেকা দেওয়ার জন্যই বাকি দুটি লিখেছি―এমনটা বলা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
এডিএ/এমজেএফ
বইমেলা
আমরা একজন ঔপন্যাসিকের অপেক্ষা করছি: স্বকৃত নোমান
আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।