বইমেলা থেকে: ফের এগারো মাসের অপেক্ষা নিয়ে সাঙ্গ হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬। ইতি ঘটলো টানা এক মাস বইয়ের সঙ্গে মিতালির।
সোমবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টা বাজতেই একে একে নিভে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের সব বাতি।
মঙ্গলবার থেকে ফের আগের চেহারায় ফিরবে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ। ১১ মাস আর কানে ভেসে আসবে না নতুন বই আর মোড়ক উন্মোচনের খবর; থাকবে না লেখক আর পাঠকের আড্ডা। স্টলে স্টলে পাঠক খুঁজবে না নতুন বই।
বাংলা ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা শহীদেরা। সেই একুশের চেতনায় শানিত বইমেলা। মেলার শুরু থেকেই স্টল বিন্যাসসহ নানা বিষয়ে প্রকাশকদের অসন্তোষ থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রকাশকদের মুখে ছিলো হাসি।
টানা এক মাসের মেলা শেষ করে সোমবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ঘরে ফিরে গেলেন লেখক-প্রকাশকরা। তবে শেষ মুহূর্তের ভালোলাগা আর আনন্দের নির্যাস নিতে ভোলেননি কেউই।
আর দর্শনার্থীরা অন্য দিনের মতোই শেষ দিনেও আড্ডা আর ঘোরাঘুরি করে কাটিয়েছেন সময়। সব মিলিয়েই লেখক, পাঠক, প্রকাশক আর দর্শনার্থীর সরব উপস্থিতিতে মুখরিত ছিলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। তাই বেদনার সুর ছাপিয়ে পরের বছরের মেলার জন্য ভালোবাসার বীজ বুনে কাটিয়েছেন মেলার শেষ দিন।
শেষদিন মেলার দুয়ার দুপুর একটায় খোলার কথা থাকলেও এর আধাঘণ্টা পর দুয়ার খোলে। বেলা যত গড়াতে থাকে পাঠকে পাঠকে ছেয়ে যায় মেলার দুই প্রান্তর। আর সে কারণেই প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থাতেই ছিলো বই পড়ুয়াদের ভিড়।
এদিন বিক্রয় কর্মীরা সর্বদাই তৎপর ছিলেন পাঠকের হাতে তার পছন্দের বইটি তুলে দিতে। ফলে শেষ দিনে জ্ঞান ও প্রাণের এই সার্বজনীন মেলা হয়ে ওঠে মুখরিত। আর সন্ধ্যার পর বই কেনা মানুষের জনস্রোত প্রবল রূপ ধারণ করে। এদিন দর্শনার্থীর চেয়ে বইপ্রেমীর সংখ্যাই ছিলো চোখে পড়ার মতো।
সব মিলিয়ে বলা যায় মেলার শেষ দিনে দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা রাত বই নিয়ে কেটেছে পাঠকের দিন।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় বিক্রি বেড়েছে
গতবারের মেলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল-অবরোধের মধ্যে পুরো একটি মাস বই কেনা-বেচা হয়েছে। মেলায় বইপ্রেমীদের অবাধ বিচরণ থাকলেও ঢাকার বাইরের পাঠক-ক্রেতাদের মেলা পেয়েছিল কম। তবে এবার ভিন্ন চিত্র। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় মেলার প্রথম দিন থেকেই ছিলো উপচেপড়া ভিড়। গতবার যারা বইমেলায় আসতে পারেননি, তারও এবার এসেছেন, কিনেছেন বই।
নিরাপত্তার চাদরে ছিলো মেলা
এবারের বইমেলা শুরুর আগেই জনমনে আশঙ্কা ছিলো নিরাপত্তা নিয়ে। গতবছর বইমেলা থেকে ফেরার পথে নির্মমভাবে খুন হন বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়। গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।
এরপর বছরজুড়েই ছিলো উগ্রবাদীদের হুঙ্কার। এবার তাই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো বইমেলায়। বসানো হয় প্রচুর সংখ্যক সিসিটিভি ক্যামেরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিও ছিলো চোখে পড়ার মতো। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া মেলা শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।
ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ
এবার মেলার ১৫তম দিনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ করা হয়, তাদের প্রকাশিত ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইটিতে মহানবীকে ‘অশ্লীলভাবে’ কটাক্ষ করা হয়েছে।
এক সপ্তাহ পরেই ২২ ফেব্রুয়ারি প্ল্যাটফর্ম নামে একটি স্টলে দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। তবে আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
মেলার ২৪তম দিনে সকালে বৈরী হয়ে ওঠে প্রকৃতি। হঠাৎ শিলাঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয় প্রাণের বইমেলা। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের বই ভিজে যায়। বিশেষ করে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। পরে সংবাদ সম্মেলন করে মেলার সময় বাড়ানো ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানায় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।
তবে সব মিলিয়ে এবারের বইমেলা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রকাশকরা। তাম্রলিপি প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী এ কে এম তরিকুল ইসলাম রনি বলেন, খুবই ভালো মেলা হয়েছে এবার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে মেলার প্রথম দিন থেকেই পাঠক-ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিলো এবং সেটা শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত থেকেছে।
‘তবে আগামী বছর কিছু বিষয়ে সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। অনেক জায়গায় এবার আলোকস্বল্পতা ছিলো, এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। মেলা সমতল করা প্রয়োজন, যাতে বৃষ্টির পানি না জমতে পারে এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাখাও জরুরি। স্টলের বিন্যাসের ক্ষেত্রেও আরেকটু নজর দেওয়ার দরকার রয়েছে,’ বলেন রনি।
নতুন প্রকাশিত বই কমেছে
গতবছরের তুলনায় এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নতুন বই প্রকাশের সংখ্যা কম। বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, গতবারের বইমেলায় যেখানে ৩ হাজার ৭০০টি নতুন বই এসেছিল, সেখানে এবার প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৪৪। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার ২৫৬টি বই কম এসেছে।
মেলার চারদিক
এবারের গ্রন্থমেলায় ৬৫১টি ইউনিটে ৪০১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন অংশ নেয়। এর মধ্যে প্যাভিলিয়ন ছিলো বাংলা একাডেমিসহ ১৫টি। চার ইউনিটের স্টল ১৯টি, তিন ইউনিটের ৩৭টি, দুই ইউনিটের স্টল ১৩৪টি ও এক ইউনিটের স্টল ১৯৬টি। লিটল ম্যাগ চত্বরে ৯৭টি প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রকাশনা প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ছোট ছোট প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব লেখক বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। লেখকদের জন্য ছিলো মনোরম সাজে লেখক আড্ডা শিরোনামে ‘লেখককুঞ্জ’। আইএফআইসি ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় মেলার অবকাঠামো নির্মাণ ও সাজসজ্জার সব কাজ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ‘ইভেন্ট টাচ’ সম্পন্ন করে।
সোমবার মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে ছিলো ‘নওয়াজেশ আহমেদ ও নাইবুদ্দিন আহমদকে স্মরণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক বুলবন ওসমান, শামসুল আলম ও নাসিম আহমেদ নাদভী। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এছাড়া সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শেষ দিনের নতুন বই
বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, বইমেলার শেষদিন প্রকাশিত হয়েছে ১৪০টি নতুন বই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে পাতা প্রকাশনী এনেছে মো. সামছুল হকের ‘কবিতায় সুচিত্রা সেন’, কথা প্রকাশ এনেছে শামসুজ্জামান খানের ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও একটি গোলটেবিল আলোচনা’, অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে মোহিত কামালের ‘বাবার শত্রু কম্পিউটার গেমস, ছেলের শত্রু সিগারেট’, আগামী এনেছে অধ্যাপক ডা. অরূপ রতনের ‘মাদকাশক্তি একটি রোগ প্রতিকার প্রতিরোধ’, মুক্ত প্রকাশ এনেছে জাহাঙ্গীর খান বাঙ্গালির ‘গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা’, জনতা এনেছে রফিকুজ্জামান হুমায়ুনের ‘বাংলার শত মনীষী, পুথি নিলয় এনেছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘দশটি কিশোর উপন্যাস’, দেশ পাবলিকেশন্স এনেছে ফাহমিদুল হান্নান রুপকের ‘জলফড়িং’, চন্দ্রাবতী একাডেমি এনেছে শামসুজ্জামান খানের ‘বাঙালির বহুত্ববাদী লোক মনীষা’, সেলিনা হোসেনের ‘ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির কথা’, গতিধারা এনেছে মো. আমজাদ হোসেন সরকারের ‘সুখাশ্রম’।
সমাপনী আয়োজন
সন্ধ্যা ৬টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর সমাপনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থমেলা ২০১৬-এর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
অনুষ্ঠানে প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় অবদানের জন্য ফরাসি গবেষক ও অনুবাদক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ও প্রবাসী বাঙালি কথাশিল্পী মন্জু ইসলামকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার-২০১৫ আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয়। এছাড়া পূর্ব ঘোষিত বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থাকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
এডিএ/এএ