‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই চরণ তুলে ধরতে এমন দৃশ্যের ব্যবহার।
কবি নজরুলকে সাদাকালো ছবিতে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা ফ্রেম কেটে এনে বসানো হয়েছে টবে লাগানো জবাগাছের পাশে।
রবি ঠাকুর যে পথে হেঁটে আসছেন তারই সামনে ফুলের বাগানের ভেতর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম বসে। হাতে তার এমন একটা খেলনা বাদ্যযন্ত্র, যার সঙ্গে একতারা বা দোতারা কোনওটারই মিল নেই।
অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে এমন নানা রঙ-সঙে সাজিয়ে, অরুচিকর আইডিয়া দিয়ে ভরে তোলা হয়েছে। দর্শনার্থীরা এসব দেখে সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন। বলছেন, এর চেয়ে সস্তা আর হাস্যকর ভাবনা কি হতে পারে।
এবারের বইমেলার সাজসজ্জার কাজটি করছে, এক সময়ের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নিরাপদ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট।
একজন বেশ ঠাট্টা করেই বললেন, ‘বড়ই উর্ব্বর মস্তিষ্ক থেকে বের হয়েছে এসব আইডিয়া’।
সিনেমার এই নায়ককে জড়িয়ে কথা বলতেও ছাড়ছেন না তারা। একজন বললেন, রুপালি পর্দার নায়ক ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চণ। তাই সবকিছুকেই হয়তো আলো ঝলমলে রঙীন দেখতে পছন্দ করেন। সে কারণেই বুঝি সাদা-কালো ছবির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রঙীন গ্রামের দৃশ্যের ওপর ফটোশপ করিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন!
ফুলের যে টবগুলো বসানো হয়েছে তাতে পানি না দেয়ায় নতুন কেনা গাছগুলোর ফুলও মরে গেছে। জবার কলিগুলো কলি থেকেই ঝরে পড়তে শুরু করেছে।
মেলার বেশ কিছুস্থানে বসার জন্যে স্টিল ও প্লাস্টিকের বেঞ্চ ও চেয়ার বসানো হয়েছে। বুধবার বিকেলে দেখা যায় কয়েকজন কর্মী হাঁটার পথের মাঝখানে ইট সরিয়ে বেঞ্চ বসানোর ব্যবস্থা করছেন।
পথের মাঝখানে কেনো বেঞ্চ বসবে? তার কোনও উত্তর এই কর্মীদের জানা নেই।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার মাঝামাঝি একটি স্থানে দেখা গেলো একটি বেঞ্চির ওপর বসানো ছাতাটির ভঙ্গুরদশা। কয়েকজন তরুন সেটিকে ধরে ঠিক করে দিলেন।
তাদেরই একজন ঠাট্টাচ্ছলে বললেন, সামান্য বাতাসেই এই ছাতা উড়ে উদ্যান ছাড়া হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বুধবার বিকেলে ইলিয়াস কাঞ্চনের পূর্ব-প্রতিশ্রুত ফোয়ারায় পানি এসেছে। এসময় দেখা যায় কয়েকজন কর্মী ফোয়ারার চারদিকে সবুজ রং মাখাচ্ছেন। কটকটে রঙয়ের বিপরীতে ফোয়ারা কেমন মানাবে সে নিয়ে বুঝি সামান্য ভাবনাটুকুও করেননি এর উদ্যোক্তারা। সেখানে ফোয়ারা পানির চেয়ে রঙেরেই প্রাধান্য দেখে একজন দর্শনার্থী মন্তব্য করলেন, এমন রুচিহীন ফোয়ারা আর দেখিনি।
এর ওপর রয়েছে কাচা রঙের বিড়ম্বনা। যারা কাজ করছেন তারা দর্শনার্থীদের দূরে থাকতে বলছিলেন বার বার, কারণ কাপড়ে রঙ লেগে যেতে পারে।
মেলার যেসব স্থানে ইটের পাইলিং বসানো হয়েছে সেগুলোর অবস্থাও ভাল নয়। পাশের ইটগুলো সরে যাচ্ছে পায়ের ধাক্কায় ধাক্কায়। এখানে সেখানে ইট থাকায় দর্শণার্থীরা তাতে হোঁচট খেয়ে পড়ছেন, এমন অভিযোগ করলেন কয়েকজন।
কয়েকজন অভিযোগ করলেন, মেলার টয়লেটগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেলো ওই এলাকায় দূর্গন্ধে টেকা দায়। রাসেল ইকবাল নামে একজন দর্শনার্থী বললেন, এতো বড় একটি মেলায় তিনটি মোটে কমোড বসানো হয়েছে। এটা কি ধরনের ঠাট্টা!
এরই মধ্যে মেলার এসব অব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলা একাডেমিকে অভিযোগ জানিয়েছে সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।
এ নিয়ে বাংলানিউজের কথা হয় সমিতির সভাপতি মাযহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বোঝা যাচ্ছে য় যে প্রতিষ্ঠানটিকে এই দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের রুচির অভাব রয়েছে। এটা নিশ্চিত বইমেলার মতো সৃজনশীল অায়োজনে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই এবং তারা এই বিষয়ে দক্ষও নয়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মাযহারুল বলেন, বইমেলার মূল ফটকেই রয়েছে রুচিহীনতার প্রকাশ। এবারের বই মেলার সৌন্দর্যহানি করেছে এই ফটক।
এই ধরনের প্রতিষ্ঠানকে যেন আর কখনোই বই মেলার মতো আয়োজনে সম্পৃক্ত করা না হয় সে দাবি জানান প্রকাশক সমিতির এই নেতা।
আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক আব্দুল গণি বাংলানিউজকে বলেন, মেলায় এই ধরনের অব্যবস্থাপনা প্রমাণ করে যে বাংলা একাডেমির পক্ষে আর বইমেলা আয়োজনের সামর্থ্য নেই।
এই বিষয়ে জানতে নিরাপদ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে ফোন দেয়া হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি। অবশ্য মেলা পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে প্রতিশ্রুতির ডালি সাজিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, এটা করা হবে ওটা করা হবে।
লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকরা প্রশ্ন তুলছেন, ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতিষ্ঠানটি মেলা আয়োজনের দ্বায়িত্ব পেলেনই কি করে?
এমন রুচিহীন আয়োজনের চেয়ে কোনও কিছু না থাকাও ভালো, বলে মত দিলেন অনেকে। কেউ কেউ বললেন, বই মেলায় সবাই বই দেখতে আসেন। এসব ফালতু সাজসজ্জা দেখতে নয়। বইমেলার সুষ্ঠু আয়োজন বলতে তারা সুন্দর করে সাজানো গোছানো স্টল, দর্শনার্থীদের হাঁটাচলার জন্য ধুলামুক্ত পথ আর নির্বিঘ্ন পরিবেশই বোঝেন।
বাংলাদেশ সময় ১১৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৭
এমএন/এমএমকে