ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

নতুনত্ব প্রয়োজন ভাষা আন্দোলন ও একুশের বইয়ে

ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮
নতুনত্ব প্রয়োজন ভাষা আন্দোলন ও একুশের বইয়ে পছন্দের বইয়ের রিভিউ দেখতে ব্যস্ত তরুণীরা/ছবি: শাকিল

অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে: বাঙালির জীবনজুড়ে এক অনন্য ভালবাসার প্রতীক হয়ে আছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন। কিন্তু মেলায় প্রকাশনার দিক থেকে প্রতিবছরই পিছিয়ে যাচ্ছে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশনা। সাহিত্যের সবগুলো শাখায় নতুন প্রজন্মের মধ্যে একুশের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এবার একুশের বই এসেছে মাত্র ১৭টি!

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও  পূর্বাপর নিয়ে যথাযথ পাণ্ডুলিপির অভাব ও  পূর্ণাঙ্গ গবেষণার  অভাবে বই প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। অভিযোগ করছেন, ভাষা আন্দোলনের বইয়ের কাটতি নেই ভালো।

তবে  সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ যথাযথভাবে না হওয়াটাকেই ‘প্রধান’ প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ভাবছেন বিশিষ্টজনেরা।

এ প্রসঙ্গে ভাষা সংগ্রামী, গবেষক ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক বলেন, যে চেতনায় বাংলা ভাষার দাবি সেদিন পূরণ হয়েছিল, সেই চেতনা বাঙালি পুরোপুরি ধারণ করছে না। সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বায়নের প্রভাবে হোক বা সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে না।  রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও জোরালোভাবে এগিয়ে আসছে না। ফলে নতুন ও তরুণ প্রজন্ম ইংরেজি ভাষার দিকে বেশি ঝুঁকছে। যে কারণে একুশের চেতনা আজও অবহেলিত।

তিনি বলেন, এ মেলা অসাম্প্রদায়িক। এখানে বই বিক্রি মূল বিষয় নয়। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে বাঙালির বেদনা ও গৌরবগাঁথা। রয়েছে আবেগ ও ভাষা চেতনা। কিন্তু সেই চেতনা এ মাসে মানুষের মধ্যে যেভাবে কাজ করে, বাকি এগারো মাস তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। ইউরোপ, এশিয়ার অনেক দেশ তাদের মাতৃভাষাকে, রাষ্ট্রভাষাকে জীবিকার প্রধান মাধ্যমে পরিণত করেছে। এই ভাষা জানলে অন্য ভাষা না জেনেও তারা উচ্চশিক্ষা নিতে পারে। আমরা সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারিনি। বিদেশি ভাষার নির্ভরতা কমাতে পারিনি।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান মনে করেন, ভাষা আন্দোলন বিষয়ে সাহিত্য রচনা বা গবেষণায় নতুন পরিকল্পনা প্রয়োজন। তার মতে, একুশ নিয়ে বাঙালির আগ্রহ, আবেগ, উচ্ছ্বাস বেশি থাকলেও তার গভীরতা অল্প। একুশ নিয়ে সত্যি নতুন কিছু করার পরিকল্পনা কম। এ নিয়ে আরো কাজ করার রয়েছে।

এদিকে তরুণ প্রজন্মের সামনে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আরো বিশদ, বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বাংলানিউজকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের সামনে আরো বিষদ আকারে উপস্থাপন করতে হবে। ইতিহাস পাঠে তাদের আরো উৎসাহী করে তুলতে আমাদের।

একুশের গ্রন্থমেলায় একুশ ও ভাষার বইয়ের প্রকাশনার স্বল্পতা মেনে নিতে পারেননি পাঠকরাও। এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) উত্তরা থেকে বইমেলায় আসা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, বছরের একদিন শহীদ মিনারের প্রভাতফেরি আর শরীরে বর্ণমালার উল্কি অঙ্কনের মধ্যেই এখন একুশ আমাদের কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছু স্টল ঘুরে ভাষাভিত্তিক বই খুঁজেছি, তবে পাইনি। যেগুলো আছে, সব পুরনো। বরাবরের মতো এবারের গ্রন্থমেলায়ও একুশ তথা ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশনা একেবারেই কম।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন, আন্দোলনের নেতা, পূর্বাপর ইতিহাস নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। আবার গবেষণা ধর্মী এ ধরনের বইয়ের পাঠক হাতেগোনা। তবে নতুন কোনো গবেষণা, নতুন আঙ্গিকের রচনা পেলে প্রকাশকরা তা ছাপতে আগ্রহী।

তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা কখনো থেমে যাবে না। এটি চলমান প্রক্রিয়া। আন্দোলনের পূর্বাপর নিয়ে অনেক অজানা ইতিহাস অনুসন্ধানে তরুণ প্রজন্মের গবেষকদেরও কাজ করার অবকাশ রয়েছে। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে ভাষা আন্দোলনের বই প্রকাশ করা যেতে পারে।

পাণ্ডুলিপি সংকটের কথা উল্লেখ করে তাম্রলিপির স্বত্বাধিকারী তারিকুল ইসলাম রনি বলেন, ভাষা আন্দোলন ও একুশ নিয়ে আমরা অনেক বেশি বই প্রকাশ করতে চাই, কিন্তু পান্ডুলিপি পাচ্ছি না। পান্ডুলিপির সংকটেই একুশের গ্রন্থমেলায় একুশের প্রকাশনা যৎসামান্য।

গ্রন্থমেলার ২০তম দিন পর্যন্ত বইমেলার তথ্য কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মেলায় ভাষা আন্দোলন ও একুশ নিয়ে বই এসেছে ১৭টি। এরমধ্যে কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে আহমদ রফিকের প্রবন্ধ সংকলন ‘ভাষা আন্দোলন: সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে’, অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে গোলাম কুদ্দুছের শিশু-কিশোরভিত্তিক বই ‘ভাষা আন্দোলন: সহজপাঠ’, ঘরোয়া থেকে এসেছে গোলাম কুদ্দুছের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ’, নালন্দা থেকে এসেছে ‘ভাষা আন্দোলন বায়ান্ন পূর্ব’ বই দু’টি, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে খোরশেদ শফিউল হাসানের ইতিহাসভিত্তিক বই ‘ভাষা সংগ্রামী নাঈমউদ্দীন আহমদ’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারির ষাট বছর’।

সাহিত্যপ্রকাশ থেকে এসেছে রাফিউর রাব্বীর গবেষণা গ্রন্থ ‘নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলন’, বিভাস থেকে এসেছে গোলাম সারোয়ার মালেকের ‘আমাদের ভাষা শহীদ’, প্রথমা থেকে এসেছে আহমদ রফিকের ‘একুশের মুহূর্তগুলো’, সাহিত্যমালা প্রকাশনী থেকে এসেছে এস এম শাওয়ান মনিরের ‘অনেক ঝড়ে অমর একুশ’, বাঁধন থেকে এসেছে খান শাহিনের উপন্যাস ‘শিশির ভেজা একুশ’, সিসটেক পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে আবদুল্লাহ সিদ্দিকের কবিতার বই ‘একুশের স্মৃতি’, নন্দিতা প্রকাশ থেকে এসেছে মো. আসকর আলী ফকিরের কবিতার বই ‘রক্তে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি’, নবরাগ প্রকাশনী থেকে এসেছে জহিরুল হক বাপ্পীর কিশোর উপন্যাস ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তি সংগ্রাম’, রাবেয়া বুক হাউজ থেকে এসেছে সাইফ আবেদীনের শিশুতোষ বই ‘ভাষা আন্দোলনের গল্প’, ভাষা প্রকাশ এনেছে মিজান রহমানের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮
এইচএমএস/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।