ঢাকা: নব্বই দশকের পর বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে এমন মন্দা অর্থনীতি আর দেখা যায়নি। অর্থমন্ত্রীও বারবার স্বীকার করেছেন, বেসরকারি খাতে আস্থা এখনও ফিরে আসেনি।
নতুন সরকার চাচ্ছে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের চাপ রয়েছে। যদিও নিম্নপর্যায়ের স্থিমিত অর্থনীতির মধ্যেও একধরনের ভারসাম্য বজায় রয়েছে। তবে তা চাহিদা ও সম্ভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তারপরও বাড়াতে হচ্ছে ব্যয়। আর উচ্চব্যয় সামাল দিতে বাড়াতে হবে আয়ের খাত। এমন কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই নতুন সরকারের প্রথম বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন তিনি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা সরকারের প্রথম বাজেট এটি। নতুন সরকার, তাই চাপ আছে অর্থমন্ত্রীর ওপর। ফলে বিশাল আকারের বাজেট দিতে হলো তাকে। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিশাল আকারের এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করেন মুহিত।
আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী। যা জিডিপির ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি বাজেট থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকা বা ১৭ শতাংশ বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের আকার ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরেন ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার নাম দিয়েছেন, ‘অগ্রগতির ধারাবাহিকতা, সম্ভাবনাময় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, বিগত দিনের সফলতায় চলবে আগামীর দিনগুলো। মুহিত অবশ্য ঘোষণা দিয়েই বলেছেন, আগামীর প্রত্যাশা মোটা দাগে পূরণে ব্যয় বাড়ানোর কথা।
মোট ১৬৩ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা রয়েছে মুহিতের কাছে। পৃষ্ঠার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার আকার ছিল ১৯৭ পৃষ্ঠা।
মুহিত তার বক্তৃতায় সরকারের প্রথম মেয়াদের গুণকীর্তন করতে ভুলেননি। বাজেট বক্তৃতার প্রথম চেপ্টারে সরকারের প্রথম মেয়াদের নানা সফলতার কথা তুলে ধরেন তিনি। কিন্তু ব্যর্থতার তেমন কিছু জানাননি। তবে মুহিত বলেছেন, অর্থায়ন উচ্চাভিলাষী। তবে কালো মেঘের আড়ালে সোনালি রেখা দেখছেন কর্মব্যস্ত আশি বছর পার করা এই মানুষটি।
বাজেটে মোট ব্যয় ধরেছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। অনুন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ২৮ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। তবে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। আর অন্যান্য খাতে ৩৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। আর এডিপি হচ্ছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। আয় যেখান থেকেই হোক, ব্যয় তাকে বাড়াতে হবে। তাই ব্যয় বাড়ানোর জন্য বড় বাজেট দিতে হয়েছে মুহিতকে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি:
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আসছে অর্থবছর ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। তিনি আরো বলেন, অনুমান ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এজন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল চেয়েছেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি:
মূল্যস্ফীতির কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করতে চাননি অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।
আয় ব্যয়ের খতিয়ান:
আগামীবারের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা, আর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ধরে আবার অর্জন করতে চান তিনি।
এদিকে, অনুদান বাদে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে জিডিপির ৫ শতাংশ। গত বছর ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ৬৭ হাজার ৫৫২ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতির ১ দশমিক ৬ শতাংশ বৈদেশিক উৎস থেকে। বাকি সাড়ে তিন শতাংশ আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে।
মুহিত আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। চলতি বছরে ছিল এক লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
আগামীবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে পাঁচ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা এবং করব্যতীত পাওয়া বাবদ ২৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে আগামী অর্থবছরে সরকারকে ৪৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নিতে হবে। এর মধ্যে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেবে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকার ৩৩ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।
মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে খানিকটা স্বস্তি দিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে থাকা অন্যতম বড় উপকরণ হচ্ছে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা। যদিও এটি নতুন করে বাড়াননি। ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। তবে মহিলা ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিকের জন্য ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এই সীমা ঠিক করা হয়েছে। যেটি আগে ছিল আড়াই লাখ টাকা। অপরদিকে, প্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা।
সংশোধিত বাজেট:
অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট পেশ করেন। যার পরিমাণ ২ লাখ ১৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বাজেট-বক্তৃতা শুরু করেন বেলা সোয়া তিনটার কিছু পরে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনি সংসদ অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ করেন। সরকারদলীয় সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দিত করেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদের নির্দিষ্ট আসনে বসে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন।
সরকারের উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, বিশিষ্ট নাগরিক, ব্যবসায়ী নেতা ও বিদেশি মিশনের কূটনীতিকেরা সংসদের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে বাজেট-বক্তৃতা শোনেন।
এর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংসদে উপস্থাপনের জন্য নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাষ্ট্রপতি বাজেট প্রস্তাবে তার সম্মতি দেন।
করপোরেট কর:
করপোরেট করের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিবর্তন আনেননি মুহিত। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মুঠোফোন কোম্পানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ কর আরোপ রয়েছে। এটি আগেও একই পরিমাণ ছিল। তবে পুঁজিবাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য কর ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। অন্য সব করপোরেট কর আগের মতই রেখেছেন তিনি।
পদ্মা সেতু:
পদ্মাসেতু সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। অর্থমন্ত্রী পদ্মাসেতুর জন্য ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, ০৫ জুন, ২০১৪