তিনি বলেন, সব বিষয় মাথায় রেখে বাজেট দেওয়া হয়। এ বাজেট গরিব মারার বাজেট নয়, তেলা মাথায় তেল দেওয়ার বাজেট নয়।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, বাজেট নিয়ে আপনাদের প্রশ্নগুলো একেবারেই মিনিং লেস। বাংলাদেশ এখন কি অবস্থা আছে আপনারা জানেন? এ দেশে দরিদ্র্য বাড়ছে না। যে বলে দেশে দরিদ্র্য বাড়ছে তারা মিথ্যা বলছে। আপনারা এমন সব প্রশ্ন করছেন উত্তর দিতেও লজ্জা করে। যারা দেশের পরিবর্তন স্বীকার করে না, তারা বলে দেশে দারিদ্র বেড়েছে। আপনারা কোন মুখে বলেন গরিব মারার বাজেট!
শুক্রবার (০৮ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (০৭ জুন) জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। যা ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের চেয়ে ৬৪ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা বেশি। এ বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেট গরিব মারার বাজেট কি? এমন প্রশ্নের জবাবে মুহিত বলেন, আপনাদের জন্মের আগে দেশে ৭০ শতাংশ দরিদ্র্য মানুষ ছিলো। এখন কমে হয়েছে ২২ শতাংশ। এখন অতিমাত্রায় গরিব ১১ শতাংশ। আপনারা কোন মুখে বলেন- দেশে দরিদ্র্য মানুষ কমছে না। আপনারা কোন হিসাবে বলেন- এই দেশে গরিব মারার বাজেট হচ্ছে। ধনীকে তেল দেয়ার বাজেট হচ্ছে! আপনারা বোঝাতে চাচ্ছেন কিছুই হচ্ছে না। দেশে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা কমছে এটা যারা স্বীকার করে না তারা মিথ্যাবাদী।
‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশের বাজেট ছিলো পুরোপুরি বৈদেশিক ঋণ নির্ভর। এখন সেই বাংলাদেশ নেই। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অভাব শব্দটা এদেশে নেই বলেন দাবি করে
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, অভাবের পাশাপাশি দেশ থেকে মঙ্গা উজাড় হয়ে গেছে। দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে মানুষ ভালো আছে।
সঞ্চয়পত্রের সুদহার প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজেটের পরের মাসেই সমন্বয় করা হবে। সাধারণত দুই তিন বছর পরপরই আমরা সুদহার সমন্বয় করি। কিন্তু এবার একটু দেরি হয়েছে। তাই এবার বাজেটের পরই এটা সমন্বয় করব।
বাজেট নিয়ে কিছু পত্র-পত্রিকা আপত্তিকর সংবাদ ছাপিয়েছে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, কেউ কেউ মনে করে আমি হয়তো বাংলা বুঝিনা। বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি, বাংলা ভালোই বুঝি। কিছু কিছু পত্রিকা এটাকে ভুয়া বাজেট বলছে। বাজেট কি করে ভুয়া হয়? এ বিষয়ে ওইসব পত্রিকার কাছে জানতে চেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, যারা নির্বোধ তাদের জন্যই এটা ভুয়া বাজেট।
নির্বাচনী বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেক বাজেটই নির্বাচনী বাজেট, কারণ আমি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সব বিষয় মাথায় রেখে বাজেট দেওয়া হয়। এ বাজেট গরিব মারার বাজেট নয়, তেলা মাথায় তেল দেওয়ার বাজেট নয়।
ব্যাংক সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন হচ্ছে না। পরবর্তী সরকারের কাছে এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র দেওয়া হবে।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনবিআর) বলেছেন, অনলাইন কেনাকাটায় কর নেই। এটা বাজেট বক্তৃতায় ভুল ছাপা হয়ে থাকতে পারে। তবে গুগল ও ইউটিউবে কর বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় ব্যাংক কমিশন গঠনের ব্যাপারে। এর আগে ব্যাংক কমিশন করার কথা তিনি একাধিকবার বলেছেন। বাজেটের পরই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। বিষয়টি তুলে ধরলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যাংক সংস্কারে কোনো কমিশন করছি না। সব কাগজপত্র তৈরি করছিলাম। এটা পরবর্তী সরকারের কাছে দিয়ে যাব। তারা এটা করবে। ’
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সরকার ঋণ নিয়ে ঘি খাচ্ছে না, মেগা প্রকল্পে ব্যয় করছে? ঋণের টাকায় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, রফতানি বাড়ছে। আমরা ঋণ নিয়েছি কিন্তু পরিশোধ করতে পারিনি এমনটা কখনোই হয়নি। আমরা ঋণের টাকা পরিপূর্ণভাবে মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছি। এতে দেশে বিদ্যুতের যোগান বাড়ছে, দেশে রফতানি বাড়ছে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য বাড়েনি। যারা বেশি আয় করেন তারা বেশি কর দেবেন, যারা আয় কম করেন তারা কম কর দেবেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এক অংকে সুদহার আনতেই ব্যাংক খাতে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতে করপোরেট কর দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে এ হার কমানোর জন্য। বর্তমানে ব্যাংক ঋণে সুদহার অনেক, আমরা এই সুদহার এক অংকে আনতে চাই। এতে বিনিয়োগ বাড়বে, অবকাঠামো উন্নয়ন হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। দেশের উন্নয়ন হবে। আর এই উন্নয়নের হাত ধরে প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের গ্রোথ অনেক ভালো। সাত শতাংশের ওপরে আমাদের গ্রোথ, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দরিদ্রের হার কমেছে। এই সম্ভাবনাময় দেশটাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যেই আমরা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবো।
এরপর তিনি বাংলাদশ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের করা মন্তব্যগুলো তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, দেশের সার্বিক বিষয়ে উন্নয়ন হয়েছে। এখন ৯০ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ। গ্রামে গরিব মায়ের সন্তান কম মারা যাচ্ছে। গরিব মাতৃ মৃত্যুর হারও কমেছে। স্বাস্থ্যখাতের পাশাপাশি শিক্ষাখাতেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, অনলাইন কেনাকাটায় ৫ শতাংশ কর নেওয়া হবে না। এটা হয়তো প্রিন্টিং মিসটেকস হয়েছে। ফেসবুক, গুগলসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আয়ের উপর কর আরোপ করা হয়েছে। তবে অনলাইনে কেনাকাটার জন্য জনগণকে কোনো কর দিতে হবে না।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় অনলাইন কেনাকাটায় ৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে বলে সাংবাদিকরা অবগত করলে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বিষয়টি ভুলে ছাপা হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ২০১৭ সালের শেষে দিকে আমদানির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৫-২৭ শতাংশ। রফতানির প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৬-৭ শতাংশ। রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি হয়েছিল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে অন্যান্য প্রভাবও ছিল। তখন আমাদের ঋণ ও আমানতের প্রবৃদ্ধির মিসম্যাচ হয়েছে। তারল্যের মধ্যে একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছিল। ওই সময়ে বেসরকারিখাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ শতাংশ আর আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। আর তখনই মিসম্যাচটি শুরু হয়। সেই অবস্থার মধ্যে আমরা অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) সংস্কার করলাম। কনভেনশনাল ব্যাংকিংয়ের জন্য আগে যা ছিল তার চেয়ে দেড় শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিলাম। এবং ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য ১ শতাংশ। তারপরে দেখেছি যে আমাদের আরও কিছু সংশোধন করতে হয়। যেমন বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। সেটি আমরা মাত্র ১ শতাংশ কমিয়েছি। রিজার্ভ থেকে ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) শামসুল আলম, অর্থ সচিব মুসলিম চৌধুরী, ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আজম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৮
এমআইএস/ইএআর/ইএস/এসএইচ