ঢাকা: মাউথ ক্যাটফিশ সাকার মাছ দেশীয় প্রজাতির মাছের রেণু খেয়ে ফেলে। এটি সাধারণ জীববৈচিত্র্যের জন্যও হুমকি।
দীর্ঘ গবেষণায় বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলোকে যখন একে একে ফিরিয়ে আনছেন গবেষকরা, তখন সারা দেশের জলাশয়ে বাড়ছে দেশি মাছের শত্রু সাকার। বুড়িগঙ্গা-তুরাগে জাল ফেললে অন্য মাছ না মিললেও উঠছে ১০-১৫ কেজি সাকার মাছ। বিপণন নিষিদ্ধ থাকায় জেলেরা তা আবার নদীতেই ফেলে দিচ্ছেন। বিপজ্জনক মাছটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে পুরো মৎস্য খাত।
রাজধানীর প্রাণ বুড়িগঙ্গার বাঁকে বাঁকে এখন কিলবিল করছে রাক্ষুসে সাকার মাছ। তুরাগের কুচকুচে কালো পানিতেও সাকারের রাজত্ব। বুড়িগঙ্গায় ১৬ বছরের বেশি সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মোতালেব শেখ এখন ভ্যানে সবজি ফেরি করেন। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গায় সাকার ছাড়া অন্য মাছ তেমন পাওয়া যায় না। পানিতে নামলে মাছটির কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয় শরীর। জাল ভরে মাছ উঠলেও বাজারে বিক্রি করা যায় না। তাই জেলেরাও এগুলো ফের জলাশয়ে ফেলে দেয়। অনেক জেলেই পেশা বদলে ফেলেছে।
গবেষকরা বলছেন, ইতোমধ্যে মাছটি ৬৪ জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। পাওয়া গেছে পুকুরেও। মাছটি প্রচুর খাবার খায় ও দ্রুত বংশবিস্তার করে। অন্য মাছের ডিম, লার্ভা খেয়ে ফেলে। এ মাছের পাখনা খুব ধারালো হওয়ায় এর আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহে ক্ষত হয় এবং পচন ধরে মারা যায়। এটি এখন দেশি মাছের জন্য হুমকি। দূষণের কারণে যে পানিতে অন্য প্রাণী বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন নেই, সেখানেও অনায়াসে মাছটি বেঁচে থাকতে ও প্রজনন ঘটাতে পারে। সাকারের বৃদ্ধি ঠেকাতে না পারলে দেশি মাছ থাকবে না।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র বলেন, মাছটি ছড়িয়ে পড়েছে এটা নিশ্চিত। শুধু উন্মুক্ত জলাশয় নয়, আমাদের বিএফআরআইর গবেষণা পুকুরেও মাছটি পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিস্তারিত গবেষণা ছাড়া এটা নিয়ে বেশি বলার সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠানটির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রবিউল আউয়াল বলেন, আমরা বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন জলাশয় থেকে মাছটির নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি পেয়েছি। এটা খাওয়ার উপযোগী নয়। তলানির খাবার খাওয়ার জন্য এটা হতে পারে। মাছটিকে পানি ছাড়া তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে দেখেছি। এটা বিস্ময়কর। মাছটির দেহে ভারী ধাতু কীভাবে আসছে, পানি বা অক্সিজেন ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকছে, ভারী ধাতু দূর করে মাছটিকে ব্যবহারের উপযোগী করা যায় কি-না- এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা দরকার ছিল। তবে আমাদের ফান্ড ছিল না। দুই মাসে রিপোর্ট দিয়েছিলাম। নিষিদ্ধ হওয়ার পর এটা নিয়ে আর কাজ হয়নি।
এদিকে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে ক্ষতিকর বিবেচনায় ২০২২ সালে সাকার মাছের আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মাছটি পেলে মাটিকে পুঁতে ফেলতে বলা হয়। এর পর মৎস্য অধিদপ্তর এ মাছ দেশের জন্য ক্ষতিকর বলে একটি প্রচারপত্র তৈরি করে। এর বাইরে আর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপণন নিষিদ্ধ করে সংকট বাড়ানো হয়েছে। জেলেরাও মাছটি ধরছে না। ফলে এটা বাড়ছে ও ছড়িয়ে পড়ছে। কার ঠেকা পড়েছে মাছ নিয়ে গিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলবে? তাতে তার লাভ কী? নিষিদ্ধের আগে মাছটির পুষ্টিগুণ, খাওয়ার উপযোগিতা, প্রজনন মৌসুম ও অন্যান্য দিক নিয়ে বিস্তর গবেষণা করলে এটাকে হয়তো সম্পদে পরিণত করা যেত। বিশ্বের অনেক দেশে মাছটি মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাণী খাদ্য, সার, কসমেটিক্স তৈরি করা হচ্ছে। এটা বাংলাদেশেও সম্ভব। দূষিত পানির মাছ বিষমুক্ত করে ব্যবহার করা যায়। সরকার প্রকল্প করে জেলেদের থেকে কিনে নিতে পারে। এরপর সেই মাছ দিয়ে প্রাণী খাদ্য, সারসহ অনেক কিছুই তৈরি করা সম্ভব। এর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা সম্ভব। হাড় দিয়ে গাছের সার হয়।
মাছটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ মাছ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে নানা রোগ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
এসআইএস