ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

শচীন হওয়ার নেশায় শিবাজি পার্কে

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, মুম্বাই থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
শচীন হওয়ার নেশায় শিবাজি পার্কে

ছেলে তখন কেবল ফিল্ডিং শেষ করে এসেছেন। বাবা ভারত শুক্লা উৎকণ্ঠার চোখে তাকিয়ে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না জানতে চাইলেন এই ম্যাচে অধিনায়কত্ব করার গর্ব এনে দেওয়া ছেলের কাছে।

পাশ ফিরে তাকিয়ে দূর দেশের সাংবাদিক বুঝতে পেরে চেয়ারটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বসুন না!’ পরেরটুকু এরপর নিজেই বলতে শুরু করলেন তিনি।

ছেলের নাম রুদ্র ভারত শুক্লা, ‘আমার নামের সঙ্গে কেবল রুদ্রটা যোগ হয়েছে। ’ এরপর ভদ্রলোক তার চোখে খেলা করা স্বপ্ন মুখেও নিয়ে এলেন দুটো ছবি দেখিয়ে, ‘শচীনের ছেলে যে কোচের কাছে প্র্যাক্টিস করে, আমার ছেলেও তার কাছেই...’

ভারত থাকেন বহু দূরের কোথাও। নির্দিষ্ট কোনো কাজ করেন না। ভাইঝি মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেন। আমার ছেলে ব্যাটার, ভাইয়ের মেয়েটা বোলার— ভারত জানান আনন্দ নিয়ে। মুম্বাইজুড়ে ছেলের যেখানে খেলা হয়, ছুটে যান সেখানেই। আর স্বপ্নটা বলে বেড়ান এভাবে, ‘রুদ্র একটু পরই ব্যাটিংয়ে নামবে, বসে থেকে দেখুন কী ভালো ব্যাট করে। ও তো একদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলবেই...’

এই কথোপকথন যেখানে বসে হচ্ছে— মুম্বাইয়ের বিখ্যাত সেই জায়গাটার নাম শিবাজি পার্ক। পরিচিত লাগছে? স্বাভাবিকই তাহলে। এখানেই রমাকান্ত আচরেকারের হাত ধরে বেড়ে উঠেছেন কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা বহু ক্রিকেটারেরও অঙ্কুর জায়গাটা।

চারপাশে বাউন্ডারি দেওয়া বিশাল মাঠ। গেটে বড় করে আঁকা ভাস্কর্যের পিলারে লেখা— ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ পার্ক। ১৬শ সালের মারাঠা সম্রাট শিবাজি মহারাজ, তার নামে এই পার্ক তৈরি করা হয়েছিল প্রায় শত বছর আগে। এখন অবশ্য তিনি আড়ালেই, মুম্বাইয়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি এখন শচীন।

বিকেল ঘনিয়ে আসা সময়ে শিবাজি পার্কে পা পড়লো যখন, একটু রোমাঞ্চও খেলা করে গেলো তো শচীনের কথা ভেবেই। সাদা ট্রাউজার আর জার্সি, মুখজুড়ে হেলমেটের ফাঁকে অস্পষ্ট চেহারা আর ব্যাট-প্যাডের ছেলেগুলোর মতোই শচীনও একদিন এই পথ মাড়িয়ে কতবার এসেছেন-গেছেন- নিশ্চয়ই তখন এদের মতোই কারো চোখে পড়েননি; এমন কিছুর কল্পনা করে!

ক্রিকেটের বহু তারকার উঠে আসার গল্প শুনে কল্পনার চোখে যেমন প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, মাঠটা অবশ্য তেমন নয়। একদিকে ফুটবল আরেকদিকে শখের ক্রিকেট; এক পাশজুড়ে পূজোর জন্য তৈরি করা মণ্ডপ। এর মধ্যেই ক্রিকেটটা খেলতে হচ্ছে খুব মনোযোগ দিয়ে, তা ক্রিকেট বলেই। তাও একসঙ্গে দুটো ম্যাচ, ফিল্ডিংয়ের বাউন্ডারি সীমানা প্রায়ই ‘সাংঘার্ষিক’ হয়ে যাচ্ছিল। কোনো ম্যাচের ফাইন লেগ হয়তো অন্য কোথাও হয়ে যাচ্ছেন থার্ডম্যান।  

তবুও তাতে তেমন কিছু যায়-আসছে না। ক্রিকেটই যে এখানে গুরুত্বপূর্ণ, কীভাবে সেটার হিসাব অন্য কোথাও। উইকেটরক্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে গিয়েও তাই তেমন আপত্তি পোহাতে হলো না। বয়স পনেরো না পেরোনো ছেলেদের সব মনোসংযোগ ওই ক্রিকেটে। উঁচু-নিচু আর কম ঘনত্বের ঘাসের মাঠে একদম ঠিকঠাক ক্রিকেট পিচে।

উপরে ছোট ছাউনি আর নিচে কয়েকটা চেয়ারে সাজানো ড্রেসিং রুম থেকে সতীর্থদের চিৎকার ভেসে যাচ্ছিল উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ব্যাটারের কাছে। পাশে দাঁড়িয়েই সেসব দেখছিলেন বিবেক তোনান্দাকার। ভদ্রলোক চল্লিশ পেরিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৫ বছরই কেটেছে ভি.ভি কামাদ মেমোরিয়াল ক্রিকেট ক্লাবে কোচিং করিয়ে, আগের জীবনটাও তার ক্রিকেটের সঙ্গেই।  

তিনি এখন বা গত ১৫ বছর ধরে যে ক্লাবটির কোচ; কে চালাতেন সেটি, জানেন? রমাকান্ত আচরেকার। এখন বিবেকের সঙ্গে আরও তিন কোচ, দেখভালের দায়িত্বটা অবশ্য রমাকান্ত আচরেকারের পরিবারের কাছে।  

দুই সময়ের পার্থক্য দেখা বিবেক হাত উঁচিয়ে বোঝাচ্ছিলেন, ‘আচরেকার স্যারের দর্শন যদি এত উঁচুতে হয়, তাহলে আমাদেরটা এখানে (নিচে)...’ এরপর তার কাছে প্রশ্ন, শচীনকে দেখেছেন? হুম কয়েকবার। কথা হয়নি? বিবেক এবার হতাশই করলেন, ‘না’ উত্তর দিয়ে।

এমনিতে শিবাজি পার্কে শচীনের পা পড়ার কথাটা তিনি মনে করতে পারেন, ‘আচরেকার স্যার যখন মারা গেলেন, তখন এসেছিলেন। পরেও একবার এসেছেন...। ’ শচীন ছাড়াও আরও ২১ ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা ফেলেছেন মুম্বাই থেকে।  

ভারতের ক্রিকেটটার জন্মই তো আসলে এখানে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ‘ময়দানে’ ক্রিকেট খেলতেন ইংরেজরা। এরপর গাছে ঘিরে থাকা সবুজ ময়দানের খেলায় তাতে যোগ দেন স্থানীয় মানুষও। অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে এসে লর্ড হ্যারিস ক্রিকেটকে আরো প্রসারিত করেন এখানে।

হিন্দু, ক্যাথোলিক বা মুসলিম; এমন ধর্মের ভিত্তিতে দল ভাগ করা হতো কখনো। মাঝেমধ্যে খেলাটা হতো শহর বনাম সমুদ্রের পাশের মানুষের। ওই গোড়াপত্তন মুম্বাইয়ের ক্রিকেটকে টেনে এনেছে বহুদূরের পথে।

সুনীল গাভাস্কার কিংবা শচীন টেন্ডুলকার— পথ হেঁটে পরে আলো ছড়িয়েছেন অনেক দূরে। অবুঝ ছেলে হয়ে শিবাজি পার্কে ব্যাট-প্যাড পরে ক্রিকেট শিখতে আসা কেউ হয়ে গেছেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার।

জীবন বোধ হয় এমনই— কখন রং বদলে যায় বোঝা মুশকিল। শিবাজি পার্ক থেকে বের হতে হতে কথাটা আরও একবার মাথায় এলো পাঁচ বছর না পেরোনো কতগুলো মিষ্টি বাচ্চাকে দেখে। তাদের গায়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি— পেছনে রোনালদো কিংবা পল পগবাদের নাম লেখা।

চোখ তুলে তাকিয়ে ওই শিশুদের তাদের কোচকে ঠিকঠাক দেখার কথা নয়; দু পক্ষের বয়স বা উচ্চতার এমনই তফাৎ। তবুও কোচ মহাশয় খেলাটা শেখাচ্ছেন ভীষণ যত্ন করে। গোধূলির আলোতে জন্মে যাওয়া মায়া কাটিয়ে পার্কের ‘এক্সিট’ কিংবা ‘এন্ট্রি’ পথ পেরিয়ে যেতে যেতে কেবল মনে হলো— শিবাজি থেকে শচীন হয়ে পরের নামটা কি এই পাঁচ না পেরোনো কেউই হবে? যার জন্য বহু দূরের বাংলাদেশ থেকে কেউ দেখতে আসবেন আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ এই মাঠ!

বাংলাদেশ সময় : ২১৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
এমএইচবি/এএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।