ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

গাভাস্কার-শচীন নয়, মুম্বাইয়ের ‘সেরা তিন ক্রিকেটারের’ অন্যজনের খোঁজে

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, মুম্বাই থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০২৩
গাভাস্কার-শচীন নয়, মুম্বাইয়ের ‘সেরা তিন ক্রিকেটারের’ অন্যজনের খোঁজে বিজয় মার্চেন্ট লাইব্রেরি। ছবিঃ বাংলানিউজ

থরে থরে সাজানো বই। লাইব্রেরিতে যেমন থাকে— নীরবতা ঠিক তেমনই।

প্রায় পাঠকশূন্য, সম্ভবত দুনিয়াজুড়ের সংকটটা এখানেও। সব বই-ই ইংরেজি। যে দু-চার জন কর্মচারী দেখভাল করেন, তাদের হাতেও অফুরন্ত সময়; ডেস্কটপের সামনে বসে তারা মেতে আছেন খোশগল্পে।  

দ্য ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ার রিসিপশন অবধি যেতে প্রায় মিনিট দশেক একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে হলো। শুরুতে খুব একটা পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। বহুদূর থেকে এসেছি, লাইব্রেরিটা খুঁজে পাওয়া দরকার; এমন বোঝানোর পর কাজ হলো। অনেকটুকু জায়গাজুড়ে দুটো লাইব্রেরি পাশাপাশি। একটা বাচ্চাদের, আরেকটা বড়দের জন্য।  

এতক্ষণ পড়েও আলাদা কিছু খুঁজে পাননি? পাওয়ার কথাও নয়— আর পাঁচটা লাইব্রেরি যেমন হয়; এতক্ষণ যার বর্ণনা দিলাম সেটিও তেমনই।  তাহলে এটার কথা কেন আলাদা করে লিখছি? কারণ এর নাম ‘বিজয় মার্চেন্ট লাইব্রেরি। ’

নাম শুনেও খুব বিশেষ কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না? বিজয় মার্চেন্ট ভদ্রলোক ক্রিকেটার ছিলেন। এটুকু বলা সম্ভবত খুব সরল পরিচয়ই হয়ে গেল, আসলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে (কমপক্ষে ৫০ ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে) সবচেয়ে বেশি গড়ে রান করেছেন তিনি।  শুধুই কি তাই?

১৯৫১ সালে ৪০ বছরের মার্চেন্ট ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫৪ রান করেছিলেন; সেটিই ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। সবচেয়ে বেশি বয়সে ভারতের হয়ে টেস্ট সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটারটি এখনও তিনি। ব্র্যাডম্যান যাকে সর্বকালের সেরা ভারতীয় ব্যাটার হিসেবে মানতেন।  বিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট এস শ্রীরামকে একবার বলেও দিয়েছিলেন যে, ‘মার্চেন্টের টেকনিক গাভাস্কারের চেয়ে ভালো। ’ 

শুধুই কি ব্র্যাডম্যান? শচীন টেন্ডুলকার কিংবা সুুনীল গাভাস্কার— মুম্বাইয়ের অবসিংবাদিত সেরা ক্রিকেটার নন অনেকের কাছেই। তাদের সঙ্গে তালিকায় প্রায়ই ঘুরেফিরে আসে বিজয় মার্চেন্টের নাম। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেও যেমন শচীন টেন্ডুলকার প্যাভিলিয়নের ঠিক পাশেরটাই বিজয় মার্চেন্টের নামে কিংবা উল্টো করেও বলা যায়; সেটাই বোধ করি বেশি উপযুক্ত হয়।  

প্যাভিলিয়ন মানে গ্যালারি, এখানে এসে নিরাপত্তারক্ষী আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ছাড়া কাউকে খুঁজে পাওয়ার কথা নয় অনুমিতভাবেই। কিন্তু লাইব্রেরি সংশ্লিষ্ট কেউও তাকে নিয়ে কিছু বলতে পারলেন না! শুধু দেয়ালে টানিয়ে রাখা বিজয় মার্চেন্টের একটা ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে উনিই তিনি। ’ 

সেই লোককে তখন বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ‘আরে ভাই, এটা জেনেই তো এসেছি; পারলে তার সম্পর্কে আরেকটু কিছু বলুন!’ সেই লাইব্রেরি ভর্তি বইয়ের অবশ্য কোথাও নেই বিজয় মার্চেন্ট। তাকে ওখানকার লোকজন চেনেন বলেও মনে হয় না। পরিবার বা অন্য কিছুর খোঁজ তো বহুদূর।  

লাইব্রেরির মূল দায়িত্বে থাকা ভদ্রমহিলা কেবল এটুকুই বললেন, ‘ওয়াংখেড়েতে মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের একটা লাইব্রেরি আছে; ওখানে গিয়ে খোঁজ করতে পারেন। ’ একটু আশা খুঁজে পেলাম। কিন্তু পরে জানা গেলো, ওয়াংখেড়ের এই লাইব্রেরিতে বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে!

বিজয় মার্চেন্ট তো শুধুই ক্রিকেটার ছিলেন না; ছিলেন এর চেয়েও বেশিকিছু। ছোটবেলায় তার নাম ছিল বিজয় ঠাকরে; এটাই আসল নাম হওয়ার কথা। কিন্তু বাবা ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। স্কুল শিক্ষক তাই পদবী হিসেবেও যুক্ত করে দিয়েছিলেন ‘মার্চেন্ট’ পরে যেটি হয়ে গেছে ইতিহাসের অংশও।

ভদ্রলোক ছিলেন ভীষণ রাজনীতি সচেতন। ১৯৩২ সালে ইংল্যান্ড সফরে যায় ভারত, মহাত্মা গান্ধীসহ স্বাধীনতা যোদ্ধারা জেলে আটকে থাকায় তখন নাম সরিয়ে নেন তিনি। তার এই রাজনীতি সচেতনতার গল্প উঠে এসেছিল জন আর্লটের লেখায়।  

তিন বছর পর মার্চেন্ট ইংল্যান্ড সফরে যান, তখন ভারতে স্বাধীনতার সুর বাজছে বেশ জোরেসোরে। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ইংলিশ লেখক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমাদের ওখানে তো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লেগে থাকে সবসময়; তোমার কি সত্যিই মনে হয় ভারতের স্বাধীনতা পাওয়া উচিত?’ মার্চেন্ট তখন উত্তরে বলেছিলেন, ‘ভুলে যেও না, তোমাদেরও কিন্তু যুদ্ধ করেই স্বাধীনতাটা পেতে হয়েছে। ’

পরে মার্চেন্টের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আর্লটের। এমনই যে, পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ‘মার্চেন্টের সঙ্গে পরিচয়টা না হলে আমি বোধ হয় কখনোই বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলতাম না। ’ 

এ বিষয়ে কেমন সরব ছিলেন আর্লট? ক্রিকেট সাহিত্যের জনক নেভিল কার্ডাসের উত্তরসূরি হিসেবে তখন তার বেশ সুনাম। দ্য গার্ডিয়ানের হয়ে লেখেন, বিসিবি ‘টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল’ এ ধারাভাষ্য দেন। ইংল্যান্ড দলের সঙ্গে তিনি যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ইমিগ্রেশনে তার হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে দেওয়া হলো চারটি অপশন দিয়ে- ‘হোয়াইট, ইন্ডিয়ান, কালারড নাকি ব্ল্যাক?’ আর্লট সব বাদ দিয়ে কাগজে লিখে এসেছিলেন ‘আমি মানুষ। ’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খুব বেশি টেস্ট খেলতে দেয়নি বিজয় মার্চেন্টকে। মাত্র ১০ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৩ সেঞ্চুরি আর সমান হাফ সেঞ্চুরিতে ৮৫৯ রান করেছিলেন ৪৭.৭২ গড়ে। প্রথম শ্রেণির কথা তো আগেই বলেছি- ১৫০ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ১৩ হাজার ৪৭০ রান করেছেন ৭১.৬৪ গড় নিয়ে।

খেলোয়াড়ি জীবনের পরে তিনি সফল ছিলেন নির্বাচক, ধারাভাষ্যকার, প্রশাসক বা লেখক সব ভূমিকায়। যে সুনীল গাভাস্কার পরে রাজ করেছেন, তাকেও খুঁজে এনে দিয়েছিলেন তিনি। জাতীয় দলে তার সুযোগ পাওয়ার সময়টাতে নির্বাচক ছিলেন মার্চেন্ট।

এখন যখন মুম্বাইয়ের সর্বকালের সেরা একাদশ বেছে নেওয়া হয়- সুনীলের সঙ্গে ওপেনিংয়ে অন্য নামটা হন বিজয়। তিনি আসলে কেমন ওপেনার ছিলেন? তার শততম জন্মদিনে ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ায় বসে এর একটা ধারণা দিয়েছিলেন সতীর্থ মাধব আপ্তে।  

‘ভিনু (মানকড়) প্রতিদিন আমাদের বিজয় ভাইয়ের নেটের পেছনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতো। আমরা সকালে নতুন বলে উনার ব্যাটিং দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। তখন অনেক কুয়াশা থাকতো চারদিকে, উনি যেভাবে বল ছেড়ে দিতেন ওটা ছিল আমাদের জন্য বিশাল শিক্ষা। ’

বিজয় মার্চেন্ট (বাঁয়ে) ও সৈয়দ মুশতাক আলী (ডানে)।

লেখার ইতিটা বিজয় মার্চেন্টকে নিয়ে লেখা ইংরেজি একটা আর্টিকেলের ভাবানুবাদ দিয়ে করলেই বোধ হয় সবচেয়ে ভালো হয়- দুনিয়ার আর কোনো শহর মুম্বাইয়ের মতো এত ব্যাটারের জন্ম দিতে পারেনি, এমনকি সিডনিও না।  

মুম্বাইয়ের কথা এলে তিনটা নাম তো অবধারিতভাবেই এসে যায়— মার্চেন্ট, গাভাস্কার ও টেন্ডুলকার। তারা ছিলেন সময়, শহর ও দুনিয়ার সেরা ব্যাটার। এই তিনজনের মধ্যে কে সেরা— তা নিয়ে হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিন বা সপ্তাহ আলাপ কিংবা তর্ক করা যাবে।  

বিজয় মার্চেন্টের বাজে উইকেটে খেলার সামর্থ্য নাকি গাভাস্কারের মনোযোগ অথবা টেন্ডুলকারের স্ট্রোক খেলার ক্ষমতা; আলাপ হতে পারে এ নিয়ে। কিন্তু যদি এই তর্কটা কেবল ক্রিকেট থেকে ক্যারেক্টারে নিয়ে আসা যায়, তাহলে অবধারিতভাবেই জয়ী হবেন বিজয় মার্চেন্ট।  

‘বোম্বে স্কুল অব ব্যাটসম্যানশিপের’ প্রতিষ্ঠিতা নিশ্চিতভাবেই মুম্বাইয়ের সবচেয়ে রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ক্রিকেটার। অথবা ক্যানভাসটা আরও বড় করে বলা যায়— ভারতেরই।

বাংলাদেশ সময় : ১৮০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০২৩
এমএইচবি/এএইচএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।