কমেন্ট্রি বক্সে বসে রইলেন না কেউই। উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উদ্দেশ্যে গলা ফাটাচ্ছেন ইয়ান স্মিথ।
যে প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠত প্রতিপক্ষ, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজকের জয়ের পর ব্রায়ান লারা, কার্ল হুপারের মতো কিংবদন্তিদের কান্নাই বলে দিচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট থেকে কখনো বিলীন হবে না। সে কারণেই শামার জোসেফকে কখনোই ভুলবেন না তারা। এই পেসারের হাত ধরেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২৭ বছর পর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনে ক্যারিবিয়ানরা। গোলাপি বলের টেস্টে ব্রিসবেনে ৮ রানের নাটকীয় জয়ে ড্র করে সিরিজ।
অথচ সিরিজ শুরুর আগে তাদের গোনায় ধরার লোক ছিল খুব কমই। প্রথম টেস্টে বিধ্বস্ত হওয়ার পর কেউ হয়তো প্রত্যাশাও রাখেনি। কিন্তু এই ব্রিসবেন টেস্টের পড়তে পড়তে ছিল রোমাঞ্চ। যেখানে বিশ্ব ক্রিকেটে আবির্ভূত হয়েছেন অজপাড়া গাঁয়ের এক পেসার। যে গ্রামে জনসংখ্যা কেবল ৩৫০। ২০১৮ সালের আগপর্যন্ত যেখানে ইন্টারনেট অবধি পৌঁছায়নি।
সেই গ্রামেরই ২১ বছর বয়সী তরুণ দিনমজুরী ও নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে চাকরি করার পরও ক্রিকেটকে ভালোবেসেছেন বেশ যত্ন নিয়ে। নিজের দ্বিতীয় টেস্টে লিখেছেন অবিশ্বাস্য এক গল্প। যা সিনেমাকেও হার মানায়। ২১৬ রানের লক্ষ্যে নামা অস্ট্রেলিয়া ২০৭ রানে গুটিয়ে যায় শুধুমাত্র তার আগুনে ঝরা বোলিংয়ে। ১০ উইকেটের মধ্যে ৭টিই শিকার করেছেন তিনি। ম্যাচসেরা তো বটেই হয়েছেন সিরিজসেরাও। তাই এ সিরিজকে শামার জোসেফ সিরিজ বললেও ভুল হবে না।
আজকের দিনটি যে এভাবে লেখা হবে জোসেফ তা কল্পনাও করতে পারেননি। গতকাল মিচেল স্টার্কের এক ইয়র্কারে পায়ে আঘাত পেয়ে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েন তিনি। স্ক্যান রিপোর্টে যদিও চিড় ধরা পড়েনি। কিন্তু ব্যথা না কমায় মাঠে না যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন এই পেসার। কিন্তু চিকিৎসকের টোটকায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়।
ম্যাচের ২৯তম ওভারে তাকে বোলিংয়ে আনেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাথওয়েট। পরের ওভারে এসে ভাঙলেন স্মিথ-গ্রিনের জুটি। টানা ১২ ওভারের স্পেলে পুরো ম্যাচটি একার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেন জোসেফ। ৬৮ রান খরচ করে শিকার করলেন ৭ উইকেট। দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া স্টিভেন স্মিথের বীরত্বও তখন তার কাছে ফিকে হয়ে যায়। শেষ ব্যাটার হিসেবে আসা জশ হ্যাজেলউড বোল্ড করার পর গোটা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে দৌড় শুরু করেন। যে দৌড়ে কেউ উল্লসিত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ কেঁদেছেনও।
জোসেফও তাই সেখানে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেন কীভাবে, 'সত্যি বলতে আজ মাঠেই আসার কথা ছিল না আমার। চিকিৎসককে কৃতিত্ব দিতে হবে। দলকে সমর্থন দেওয়ার জন্য হলেও তিনি আমাকে মাঠে আসতে বললেন। আমি আসলাম এবং তিনি আমার আঙুলে কিছু একটা করলেন। জানি না কী করেছেন, কিন্তু কাজে লেগেছে। তাই সেই সময়ে দলকে জেতানোর জন্য মাঠে নামতেই হতো আমাকে। আমার আঙুলের অবস্থা যেমনই হোক না কেন। আমি ঠিক আছি। আমি এটা তার জন্য করেছি এবং তাকে গর্বিত করতে পেরে আমি এখন খুশি।
'আমি অতোটো ক্লান্ত নই। কারণ আমি এটা দলের জন্য করতে চেয়েছিলাম। আমি অধিনায়ককে বলেছিলাম শেষ উইকেট পড়ার আগ পর্যন্ত আমি বল করব। এটাই আমাদের ইতিবাচকতা। '
প্রথম টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই উইকেটের খাতা খোলেন জোসেফ। তাও আবার স্টিভেন স্মিথের। সেই ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়ে কেঁদেছিলেন তিনি। আজ স্মিথের উইকেট না পেলেও তাকে ট্র্যাজিক হিরোতে পরিণত করেন ডানহাতি এই পেসার।
'সিনিয়র ফাস্ট বোলাররা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, ম্যাচজুড়ে আমাকে খুবই সমর্থন দিয়ে গেছেন যদিও আমি আবেগী হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু সেই অশ্রু কেবলই আনন্দ ও খুশির। অতীত মনে রেখে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখাতেই এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি আমি। এর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। '
শামার জোসেফের এই ত্যাগ ওয়েস্ট ইন্ডিজ চাইলেও যে ভুলতে পারবে না!
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
এএইচএস