এমন দৃশ্যের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয় ক্রিকেট। যদিও ৯ মাস আগেই অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড দেখা গেছে তা।
দুজনের মধ্যে মিল হলো, দুজনেই ফাস্ট বোলার। আরও নির্দিষ্ট করে বললে পেস আক্রমণের নেতা। কামিন্স অবশ্য এখানে একটু ভিন্ন। প্রায় তিন বছর হতে চলল অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। বুমরাহরও এটি প্রথম নয়। তবে দুই বছর আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের মতো এ ম্যাচেও ভারপ্রাপ্ত হিসেবেই কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
ভাগ্যিস রোহিত শর্মা নেই! নয়তো টেস্ট ক্রিকেটে বর্তমান সময়ের সেরা দুই বোলার ব্লেজার পরে টস করতে নামছেন এমনটা হয়তো দেখা যেত না।
অধিনায়কত্ব শব্দটির সঙ্গে প্রায় সময়ই কোনো না কোনো ব্যাটারের নাম উঠে আসে। বোলারদের তুলনায় তাদের কাজের চাপ কিছুটা কম। তাই তা কৌশল সাজাতে ও দল ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ হতে সাহায্য করে।
কিন্তু একজন বোলারের ক্ষেত্রে তা আলাদা। লাইন, লেংথ, বৈচিত্র্য- অনেক কিছু নিয়েই চিন্তা করতে হয় তাদের। রবিচন্দ্রন অশ্বিনই বলে থাকেন, একসঙ্গে ২৫টি ডেলিভারির পরিকল্পনা করেন তিনি। তাই এর বাইরে নেতৃত্ব নিয়ে ভাবাটা কঠিন করে তোলে।
দ্বিমতও অবশ্য আছে। আর আছে বলেই আজ প্রথম ফাস্ট বোলার হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কামিন্স। ভারতেও সেই সংস্কৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছে। বুমরাহর আগে পেসার হিসেবে কপিল দেবই সবশেষ দলটির অধিনায়কত্ব করেছেন।
তাই বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি হাতে কামিন্স-বুমরাহর ছবিটি হাজার না হলেও শতশত শব্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্পকে তুলে ধরেছে।
২০১১ সালে টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখা কামিন্সের ‘ব্যাগি-গ্রিন ক্যাপ’ দেখলেই বোঝা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে কতটা শাণিত করেছেন তিনি। ক্যাপের সামনের কিনারা ইতোমধ্যেই ছিঁড়ে গেছে, তার ওপরে লোগোতে পড়েছে ধূসর ছাপ।
সেই তুলনায় বুমরাহর টেস্ট ক্যাপটি এখনো নতুনই লাগে। যদিও তার অভিষেক হয়েছে ৬ বছর আগে। ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় আরও একটি নতুন ক্যাপ পান।
এই তো কয়েক বছর আগেও নেতৃত্ব প্রসঙ্গ উঠলে ফাস্ট বোলারদের উপেক্ষার চোখে দেখা হতো। তবে সেই কাঠামোতে এবার পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন কামিন্স-বুমরাহরা। সময়ের অন্যতম সেরা দুই পেসার একই সিরিজে নিজ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমনটা দেখা গিয়েছে ১৯৯৭ সালে। তিন ম্যাচের সেই সিরিজে পাকিস্তানকে ওয়াসিম আকরাম (র্যাংকিংয়ের দ্বিতীয়) ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নেতৃত্ব দিয়েছেন কোর্টনি ওয়ালশ (র্যাংকিংয়ের সপ্তম)।
বর্তমান সময়ে বুমরাহ (৩) ও কামিন্স (৪) নিজেদের মধ্যে ইঁদুর-বিড়াল লড়াই করছেন। নেতৃত্বের মাধ্যমে পার্থ টেস্টে তাদের দ্বৈরথটি এবার অন্য মাত্রা পাবে।
যদিও খুব একটা পরিবর্তন দেখছেন না কামিন্স। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না এতে খুব একটা বদল আসবে। তবে এটি সত্যি একটি বিরল জিনিস। সে কীভাবে কাজ করে, তা ড্রেসিংরুম থেকে দেখতে মুখিয়ে আছি। তবে ফাস্ট বোলিংয়ের ভক্ত হিসেবে বলতে পারি, এমনটা দেখতে সবসময়ই ভালো লাগে। ’
বল হাতে দক্ষতার বাইরে কামিন্স-বুমরাহ দুজনেরই নেতৃত্বের ভার পাওয়ার আগে তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। তিন বছর আগে টিম পেইনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে কেবল চারটি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন কামিন্স।
লিস্ট ‘এ’ হোক বা প্রথম শ্রেণি- বুমরাহ কোনো ফরম্যাটেই নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি। ২০২২-এ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যানচেস্টার টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রোহিত শর্মা কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ায়। সেই ম্যাচে ৭ উইকেটে হেরে যাওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব নিতে কোনো রকমের ভয় কাজ করে না বুমরাহর মনে।
তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিতে ভালোবাসি। ছোটবেলা থেকেই কঠিন কাজ করতে চাইতাম আমি। সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে এবং কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চেয়েছি। তাই এটি আমার জন্য আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ যোগ করেছে। ’
‘এর চেয়ে বড় সম্মান আর নেই। ছোটবেলায় আমি সবসময় চাইতাম এই ফরম্যাট খেলার এবং টেস্ট ক্রিকেটে ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার। খুব কম খেলোয়াড়ই ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছে এবং নেতৃত্ব দেওয়ার সংখ্যা আরও কম। তাই এই দায়িত্ব পেয়ে আমি খুবই সম্মানিত এবং খুবই খুশি। ’
অধিনায়কত্বের দায়িত্ব ও বোলিংয়ে ব্যক্তিগত চাহিদাগুলো সমন্বয় করার সময় এর জটিলতা বুঝতে প্রায় ১০ ম্যাচ সময় লেগেছে কামিন্সের।
অজি অধিনায়ক বলেন, ‘আমার মনে হয় না, সেই দশ ম্যাচে আমি খুব বড় কিছু পরিবর্তন এনেছি। তবে অন্তর্দৃষ্টি কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু যখন আমি নতুন ছিলাম, তখন সহায়তার জন্য আমার আশেপাশে দারুণ কয়েকজন সতীর্থ ছিলেন। তাই কখনো একা মনে হয়নি। আমি মনে করি প্রশ্নটা সবসময়ই থাকে, আমি কি যথেষ্ট নাকি অতিরিক্ত বোলিং করে ফেলছি? তবে এটা অনুভূতির ব্যাপার তাই অন্যদের সঙ্গে কথা বলে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। ’
পরিসংখ্যানগত দিক থেকে, কামিন্সের সঙ্গে বুমরাহর খুব একটা অমিল নেই। বয়সে বুমরাহর (৩০) চেয়ে ৭ মাসের বড় হলেও কামিন্স (৩১) খানিকটা পিছিয়ে আছেন গড় ও স্ট্রাইকরেটে। প্রতি ২২.৫৩ রানে একটি করে উইকেট পেয়েছেন কামিন্স, সেই তুলনায় বুমরাহর গড় ২০.৫৭। একটি উইকেটের জন্য ভারতীয় পেসার অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪৪.৬ বল। সেখানে কামিন্সের স্ট্রাইকরেট ৪৬.৮।
দুজনের সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা অবশ্য অভিজ্ঞতায়। অভিষেক টেস্টের পর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় টেস্ট খেলতে পারেননি কামিন্স। তবে তারপরও ম্যাচ খেলার দিক থেকে বুমরাহর চেয়ে এগিয়ে আছেন অজি অধিনায়ক। ৬২ ম্যাচ খেলে তার শিকার ২৬৯ উইকেট। বিপরীতে বুমরাহ ৪০ টেস্ট খেলে নিয়েছেন ১৭৩ উইকেট।
এর বাইরেও রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা। সেটাই পার্থ টেস্টের আগে এগিয়ে রাখছে কামিন্সকে। ডানহাতি এই পেসার তার নেতৃত্বগুণে অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিয়েছেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। দুটোই এসেছে গত বছর ভারতকে হারিয়ে। তাই বড় চাপ ও বড় দায়িত্ব কোনোটাই এখন আর নতুন নয় কামিন্সের কাছে। তবে বুমরাহর এ বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। .
ভারতের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক বলেন, ‘অভিজ্ঞতা কেউ জন্ম থেকে নিয়ে আসে না, খেলেই অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়। তাই এক্ষেত্রে কাউকে অন্ধ হয়ে অনুসরণ না করে, নিজস্ব উপায় খুঁজে নিতে হবে। নিজের বোলিংয়ের বেলায় আমি কাউকে অনুকরণ করিনি। নিজের স্বভাব অনুযায়ী খেলে যাই এবং এভাবেই সবসময় ক্রিকেট খেলি আমি। ’
‘নিজের ধারণা ও অন্তর্দৃষ্টির ওপর প্রচুর আস্থা রয়েছে আমার। তাই কৌশলগতভাবে বোলার হিসেবে আমি সেগুলোই অনুসরণ করি। অবশ্যই বোলাররা প্রচুর গবেষণা করে এবং ব্যাটারদের তুলনায় আরও ডাটাভিত্তিক হয়ে হয়ে থাকে। কারণ এভাবেই খেলাটা এগিয়ে যাচ্ছে। ’
‘আমি অবশ্যই ফাস্ট বোলিংয়ের ভক্ত। এ কারণেই আমি বোলার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শারীরিকভাবে হয়তো বোলিং বেশ ক্লান্তিকর একটি ব্যাপার, কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে বোলাররাও বেশ স্মার্ট। অতীতে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। কামিন্স অসাধারণ কাজ করেছে, প্রচুর সফলতা পেয়েছে। আশা করি, এটি নতুন সংস্কৃতির একটি শুরু এনে দেবে এবং আরও খেলোয়াড় তা অনুসরণ করবে। ’
কামিন্সের মতো এতোটা সফল হওয়ার সুযোগ এখনো পাননি বুমরাহ। তবে এরপর থেকে টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পেসারদের উপেক্ষা করার সুযোগ নিশ্চয়ই পাবে না দলগুলো!
বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২৪
এএইচএস