ঢাকা: জালাল ইউনুস। নিবেদিতপ্রাণ একজন ক্রীড়া সংগঠক ও সাবেক ক্রিকেটার।
১৯৮৯ সালে ক্রিকেট ছাড়ার পর ১৯৯০ সালে আবাহনীর কোচ ও ম্যানেজার পদে যুক্ত হন। ক্রিকেট তার মনে-প্রাণে। মাঠ ও মাঠের বাইরের সফল এ মানুষটিরও আক্ষেপ আছে। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত যখন তার বাঁহাতি পেসে কাঁপছে ঢাকার মাঠ, তিনি উইকেটের পর উইকেট তুলে চলেছেন, তখন তিনি বঞ্চিত হয়েছেন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ থেকে।
সত্তরের দশকের ক্রিকেট, নিজের ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি-আক্ষেপ, ক্লাব ও বিসিবিতে লম্বা সাংগঠনিক জীবন নিয়ে জালাল ইউনুস কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট সাজ্জাদ খান। সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বে থাকছে তার খেলোয়াড়ী জীবনের আদ্যোপান্ত।
বাংলানিউজ: সেসময় আবাহনী ছিল শীর্ষ ও সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাব। ওখানে খেলার সুযোগ কীভাবে এলো?
জালাল ইউনুস: আমি লিগে অনেকগুলা উইকেট নেওয়ার পর আবাহনী-মোহামেডানের নজরে পড়লাম। এখনও মনে পড়ে, তখন আবাহনীর শেখ জামাল (বঙ্গবন্ধুর পুত্র) বেঁচে ছিলেন। আমার একটা খেলা দেখছিলেন আউটার স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বাইরেরটা) দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে বলছিলেন, আবাহনীতে খেলবে? বললাম, দেখা যাক। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে আবাহনী ক্লাব খুব জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তায় আবাহনীর পর মোহামেডান ও আজাদ বয়েজ। কলেজ জীবন থেকেই আমি আবাহনীর সমর্থক। তারপরও ১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে আবাহনীতে না গিয়ে ধানমন্ডি ক্লাবে গেলাম। তখন ধানমন্ডি প্রথম বিভাগে নতুন উঠেছে। তখন আমার টিমে ছিলেন নাদির শাহ, মুন্না শাহ (নাদির শাহ’র ছোট ভাই) আজিম শাহ (জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা’র বড় ভাই)। আজিম শাহ ছিলেন আমাদের অধিনায়ক।
বাংলানিউজ: ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর সময়ের কোনো ম্যাচের কথা কি মনে পড়ে?
জালাল ইউনুস: আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ হলো মোহামেডানের সঙ্গে যখন প্রথম খেলি ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে। তখন ইনার স্টেডিয়াম বলতে বুঝতাম, বঙ্গবন্ধুকে স্টেডিয়ামকে আর আউটার স্টেডিয়াম বলতে বাইরের মাঠটা। ইনার স্টেডিয়ামে (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) মোহামেডোনের সঙ্গে আমাদের খেলা। তখন মোহামেডান খুবই শক্তিশালী। ওই ম্যাচে ২৫ রানে ৭ উইকেট নিলাম। মোহামেডান ৮৫ রানেই অলআউট। এ রান চেজ করতে গিয়ে আমাদেরও ৮ উইকেটট পড়ে গিয়েছিল। তবে এতো বড় একটা টিমকে নতুন টিম হিসেবে হারিয়ে আমি লাইম লাইটে এলাম।
বাংলানিউজ: এরপরই কি আবাহনীতে ডাক?
জালাল ইউনুস: লিগের পর শহীদ স্মৃতিতে (আরেকটি টুর্নামেন্ট) আবাহনী-মোহামেডান একটা খেলা ছিল। আমাকে বললো খেলতে। তখন অতো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। লিগ ছাড়া অন্য টুর্নামেন্টে যে কোনো টিমে খেলা যেতো। তখন আবাহনীর অফিসিয়ালরা আমাকে বললো, মোহামেডানের সঙ্গে খেলা আছে, খেলবা নাকি? ১৯৭৭ সালে প্রথমবার আবাহনীতে খেললাম। যদিও ওই ম্যাচটা আমরা হেরে যাই। ৪ উইকেট নিয়েছিলাম আমি। বল লেগে হাত ফেটে যাওয়ায় আমি মাঠ থেকে চলে আসি। এরপর আবাহনীতেই রয়ে যাই। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত আমি নিয়মিত ক্রিকেটার ছিলাম আবাহনীর।
বাংলানিউজ: লিগের স্ট্রাকচার কেমন ছিল তখন?
জালাল ইউনুস: তখন প্রিমিয়ার ডিভিশন ছিলো না। প্রথম বিভাগে ২০টা ক্লাব খেলতো। ২০টা টিম ১০টা করে দুইটা গ্রুপ হতো। টপ দুইটা করে টিম দুইটা গ্রুপ থেকে সেমিফাইনালে উঠতো। সেমিফাইনাল ছিল তিন দিনের। ফাইনাল হতো চার দিনের। ৪০টি ওভার হতে সেমিফাইনাল লংগার ভার্সন হতো। ১৯৭৮-৮৯ মৌসুমের দিকের কথা, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগ ছিল। মজার ব্যাপার হলো, তখন কিন্তু আমাদের বোলিং রেস্ট্রিকশন ছিলো না। ৪০ ওভারের লিগ হতো। যে যতো ওভার করে। ২০ ওভারের বেশি তো আর করতে পারবে না এক প্রান্ত থেকে। আমি ১৫-২০ ওভার করতাম। এই ১৫-২০ ওভারে ৬-৭টি করে উইকেট তুলতাম।
বাংলানিউজ: ক্লাব ক্রিকেটে আপনাদের সিনিয়র ও সমসাময়িক ক্রিকেটার তখন কারা?
জালাল ইউনুস: আমাদের সময়ে তখন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, ইউসুফ রহমান, দৌলত জামান, সামিউর রহমান, তানভির হায়দার, শফিকুল হীরা- এরা ছিলেন সিনিয়র ও টপ ক্রিকেটার। আর আমি তখন লাইমলাইটে আসা শুরু করেছি। রফিক আলম (বিসিবির সাবেক প্রধান নির্বাচক), ইশতিয়াক আহমেদ (বর্তমানে ব্যাংক কমকর্তা), জিএস হাসান তামিম, দীপু রায় চৌধুরীরা (ফাস্ট বোলার) আমাদের আগে শুরু করেছেন। তখন সমসাময়িক ক্রিকেটার ছিলেন এ এস এম ফারুক, মাইনুল হক, সেলিম ভাই, সামিউর রহমান। এর পরের দিকে ওয়াহিদুল গনি, তানভির হায়দার, মঞ্জুর আহমেদ (সাবেক সিইও, বিসিবি), ইকবাল আহমেদ বাচ্চু (ন্যাশনাল টিমে ওপেন করতেন)।
বাংলানিউজ: ঢাকায় ক্রিকেট পাগলামি তখন কেমন ছিল?
জালাল ইউনুস: আবাহনী-মোহামেডান যখন ম্যাচ হতো, এমনকি চার দিনের ম্যাচেও ফুল হাউস থাকতো গ্যালারি। তখন ক্রিকেট আরও আকর্ষণীয় হলো যখন লিগে বিদেশি প্লেয়ার আসা শুরু করলো। ১৯৮২ সালে প্রথম আমরা দুইটা বিদেশি ক্রিকেটার নিয়ে আসলাম। এদের একজন ভারতের জাতীয় দলের ব্যাটসম্যান ভেঙ্কাটাপতি রাজু । ওই বার মোহামেডান নিয়ে আসলো ভারতের প্রণব রায়কে। বাইরের প্লেয়ার আসা শুরু হলো। তারপর তো অনেক প্লেয়ার খেলে গেছে। শ্রীলংকা থেকে ব্রেন্ডন কুরপু, দিলীপ মেন্ডিস, মারভান আত্তাপাত্তু, অশন্ত ডি মেল, রয়ডাস, রানাতুঙ্গা, জয়সুরিয়া। পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম, এজাজ আহমেদ। আশীষ কাপুর খেললো, সান্ধু নামে একটা স্পিনার খেললো। তখন লিগটা আরও জমে গেল। তবে দর্শকদের মাঝে ক্লাব ফিলিংসটাই বেশি ছিল। আবাহনীতে কে আসছে? মোহামেডানে কে আসছে? এ নিয়ে আলোচনাটা এমন ছিল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ৩০-৪০ হাজার দর্শক খেলা দেখতো। একদিকে আবাহনীর, অন্যদিকে মোহামেডানের সমর্থকরা বসতো। ফ্যান্টাস্টিক একটা পরিবেশ বিরাজ করতো মাঠে। ১৯৮৪ সালের দিকে প্রিমিয়ার লিগ শুরু হলো। তখন ক্লাবের অফিসিয়ালরা সোনা-গয়না বিক্রি করে ক্লাব চালাতেন। কোনো লাভ ছাড়া শুধু খেলাধুলাকে ভালোবেসে নিজের গাড়ি বিক্রি করে ক্লাব চালিয়েছেন- এমন সংগঠকও আমি দেখেছি।
বাংলানিউজ: নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করতেন?
জালাল ইউনুস: অক্টোবেরে ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যেতো। আমরা নিজেরো নিজেদের যত্ন করতাম। অফ-সিজনে শ্রীলঙ্কার ফুটবল কোচ পাকির আলী বলতো জালাল বসে থেকো না। তখন আমরা ফজরের আযানের পর বের হয়ে জগিং ও ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করতাম। আবাহনী ক্লাব থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি যেতাম। ওখান থেকে ঘুরে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড হয়ে ক্লাবে আসতাম। জিম করতাম ঢাকা ইউনিভার্সিটির জিমনেশিয়ামে।
নিজেকে মেইনটেইন করার দায়িত্ব নিজেরই ছিল। একটা ম্যাচে এমন হলো- সূর্য তরুণ ক্লাবের সঙ্গে খেলা, কুচকিতে টান লেগেছে। ১৯৮৪ সালের কথা বলছি। আমাদের প্রতিপক্ষ সূর্য তরুণে তখন আতহার আলী খান খেলেন, শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। ওই ম্যাচে কুচকিতে টান লাগায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে বল করতে হয়েছে। আমি তিন উইকেট নেই ও ম্যাচটা জিতি। ক্লাবের জন্য যতটুকু পারি দিতাম।
বাংলানিউজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও তো রিপ্রেজেন্ট করেছেন আপনি...
জালাল ইউনুস: প্রথম বিভাগে যতো সেরা খেলোয়াড়, তার সবই ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে (লংগার ভার্সন) ঢাকা ইউনিভার্সিটি খেলতো। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল- এ পাঁচ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রিপ্রেজেন্ট করি। আমাদের সঙ্গে ওয়াহিদুল গনি, রফিক আলম, ইশতিয়াক আহমেদ, নেহাল হাসনাইন, জি এস হাসান তামিমরা ছিলেন ইউনিভার্সিটি টিমে। পরের দিকে আতাহার আলী খান এলেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিম সবসময় সেরা হতো।
বাংলানিউজ: খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানলেন কবে?
জালাল ইউনুস: খেলতে খেলতে আমি টেনিস এলবো (কনুইয়ে চোট) ইনজুরিতে পড়ি। প্রতিবছর একটা ইনজেকশন নিতে হতো। এরপর ১৯৮৯ সালে অনিয়মিত হয়ে গেলাম। যখন দেখলাম ইনজুর আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তখন আস্তে আস্তে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিলাম। আমি আমার পড়াশোনা শেষ করেছি ঢাকা ভার্সিটি থেকে। দেশের সর্বোচ্চ লেভেলে ক্রিকেট খেলেছি। আমি এতে সন্তুষ্ট ছিলাম।
বাংলানিউজ: খেলোয়াড়ী জীবনে মজার কোনো ঘটনা?
জালাল ইউনুস: ১৯৮৯ সালে যখন আমি খেলা ছেড়ে দেবো, এমন সময়ে প্রতিপক্ষ দলে আকরাম খানকে পেলাম। ধানমন্ডি মাঠে খেলা ছিল। রেলওয়ে বনাম আবাহনী। আকরাম তখন রেলওয়ের নতুন খেলোয়াড়। ওই ম্যাচে আমি বাউন্সার দিচ্ছি বডি লাইনে। আমার একটা অভ্যাস ছিল বল করার পর ব্যাটসম্যানকে ডিস্টার্ব করার জন্য স্লেজিং করতাম। আমার স্লেজিং শুনে আকরাম ভড়কে গিয়েছিল। স্লেজিং জিনিসটা ও তখন বোঝে নাই। ম্যাচ শেষে বুঝেছে আসলে কী হয়েছে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কোথায় দেখতে চান?
জালাল ইউনুস: আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের ক্রিকেট একদিন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের কাতারে যাবে। এ জন্য টেস্ট ফরম্যাটে ভালো করতে হবে। তিন ফরম্যাটেই আমি চাই র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ৪-৬ নম্বরের মধ্যে উঠে আসুক। এখন পাইপলাইনে পেসার বেড়েছে। আল আমিন, শফিউল, তাসকিন, মুস্তাফিজ, রুবেলরা আছে। এক সময় তো দলে পেসার ছিল না। পাইপলাইনে যেন পর্যাপ্ত ক্রিকেটার থাকে এ জন্য ক্রিকেট বোর্ড থেকে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন বেশ ডাইনামিক। বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরও ভালো দিন সামনে রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১৬
এসকে/এইচএ/
**সংগঠক হিসেবেও সফল জালাল ইউনুস