ফুটবলের দেশ ইতালির জাতীয় ক্রিকেট দলে রাকিবুল প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার। ইতোমধ্যে ইতালির জার্সি গায়ে আটটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেলে ফেলেছেন তিনি।
ঢাকার ক্রিকেটে খেলে যাওয়া রাকিবুল দেশে পরিচিত বাবু নামে। যদিও ক্রিকইনফোতে তার ডাকনাম দেখাচ্ছে রকি আর ক্লাবের নাম ভুলবশতই কলাবাগান ক্রীড়া চক্র লেখা হয়েছে। বাস্তবে কলাবাগানের হয়ে তিনি কখনোই খেলেননি। ২০০৮ সালে তিনি খেলেছেন ইন্দিরা রোড ক্রীড়া চক্রের হয়ে। সর্বশেষ ২০১০ সালে প্রথম বিভাগে খেলেছেন উত্তরা স্পোর্টিংয়ের হয়ে। একটা সময় সৌম্য সরকার, মমিনুল হক, এনামুল হক, তাইজুল ইসলাম, আবুল হোসেনদের সঙ্গে একই দলে ছিলেন রাকিবুল।
ক্রিকইনফো রাকিবুলের জন্মস্থান ঢাকা দেখালেও তার জন্ম কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলায়। বিভিন্ন আর্কাইভ, দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের আর্টিকেল ঘেটে জানা যায়, কুমিল্লা অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে একসময় বিসিবির বয়সভিত্তিক ক্যাম্পে সুযোগ পেয়েছিলেন রাকিবুল। এছাড়া, কুমিল্লা জেলা দলের হয়ে খেলেছেন তিন বছর।
বাবা মারা যাওয়ার পর ২০১১ সালে সংসারের হাল ধরতে ইতালিতে পাড়ি জমান রাকিবুল। সেখানে তার কিছু আত্মীয় ছিলেন। কিন্তু, ইতালিতে অবস্থানের বৈধ কাগজপত্রও ছিল না রাকিবুলের কাছে। একটা সময় নিজে থেকেই পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছিলেন। বয়স সতেরোর নিচে হওয়াতে ইমিগ্রেশন পুলিশই তার অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাদের মাধ্যমে ২০১২ সালে ইতালির বৈধ নাগরিকত্ব পান তিনি। তবে, অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় ইতালি গিয়েই কাজের সুযোগ পাননি। সে দেশের আইন অনুযায়ী একটি মানবাধিকার সংস্থার অভিভাবকত্বে কাটান দুই বছর। এই সময় তাঁর পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব বহন করে ওই সংগঠন।
ইতালিতে একটি রেস্তরায় কাজ শুরু করেন রাকিবুল। স্থানীয় ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনিও নেমে পড়েন মাঠে। রাকিবুলের বাঁহাতি স্পিনটা সেখানকার ব্যাটসম্যানদের কাছে একটু দুর্বোধ্যই ছিল। বেশ নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইতালির বোলোনিয়ায় স্থানীয় বাংলাদেশিদের এক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকেই নতুন দিনের শুরুটা পান রাকিবুল। দারুণ পারফরম্যান্সে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন। এক সময় স্থানীয়দের সাহায্যে নাম লেখান বেলোনিয়া ক্রিকেট ক্লাবে। এই ক্লাবের হয়েই ইতালির ঘরোয়া ক্রিকেট সিরি ‘আ’ লিগে খেলা শুরু করেন তিনি।
সেখানে প্রায় দুই বছর খেলার পর ডাক পান পিয়ানোরা ক্রিকেট ক্লাবে। সেখান থেকেই ডাক পান ইতালি জাতীয় দলে। ইউরোপের বেশির ভাগ ক্রিকেট দলের মতো ইতালির দলেও উপমহাদেশের ক্রিকেটারদেরই ছড়াছড়ি। তাদের মধ্যেই নিজেকে প্রমাণ করতে থাকেন রাকিবুল। গত জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইউরোপ অঞ্চলের বাছাইপর্বে ইতালিকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেন রাকিবুল।
এখন ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যালেঞ্জ লিগে ইতালির জার্সিতে ব্যস্ত সময় কাটছে রাকিবুলের। সবশেষ ম্যাচে গত ৩ ডিসেম্বর মাঠে নেমেছিলেন তিনি। কেনিয়ার বিপক্ষে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। ব্যাট হাতে করেন ৪৭ বলে অপরাজিত ২৯ রান। তার আগে বল হাতে ১০ ওভারে ৩৪ রান খরচায় তুলে নেন একটি উইকেট।
বিশ্ব ফুটবলে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ইতালি। ব্রাজিলের পর সবচেয়ে বেশি ৪ বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইতালি। তাই ইতালিতে ফুটবল যে কতটা জনপ্রিয় সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ফুটবলের দেশ হলেও ৮০’র দশক থেকে ছোট আকারে ক্রিকেট খেলছে পিৎজা-পাস্তার দেশ ইতালি। বর্তমানে ২০২৩ বিশ্বকাপের প্রাথমিক বাছাইপর্ব হিসেবে পরিচিত আইসিসি বিশ্বকাপ চ্যালেঞ্জ লিগে খেলছে ইতালি। র্যাংকিংয়ের ২১ থেকে ৩২ নম্বর দলগুলো দুই ভাগে ভাগ হয়ে লড়ছে। প্রতি গ্রুপের সেরা দল আগামী বিশ্বকাপের মূল বাছাইপর্বে উত্তীর্ণ হবে।
ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে আর সংসারের হাল ধরতে অজানা দেশে পাড়ি জমানো কিশোর রাকিবুল এখন স্বপ্ন দেখছেন ইতালিকে বিশ্বকাপে তোলার। লাল-সবুজের বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যরকম এক বিজ্ঞাপন হয়ে রাকিবুল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন ইতালির নীল জার্সি গায়ে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে না পারলেও, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা তো হচ্ছে! বাস্তবতার কাছে হার মেনে দেশ ছেড়ে যাওয়া রাকিবুলের কাছে শত অপ্রাপ্তির ভিড়ে এটাই হয়তো অনেক বড় পাওয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৯
এমআরপি