নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সাকিবের কাছে সবই ছিল। জাতীয় দলের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক, বিশ্বকাপে স্বপ্নের মতো পারফরম্যান্স, অধিকাংশ ফরম্যাটে শীর্ষস্থানীয় অলরাউন্ডার, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর 'হট কেক' এমন আরও অনেক কিছু যা একজন ক্রিকেটারের আজীবনের লালিত স্বপ্ন।
সাকিবের নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে আরও ৫-৬ মাস লাগবে। এই সময়ে যদি করোনা মহামারির কারণে ক্রিকেট মাঠে না গড়ায় তাহলে আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ থাকবে তার সামনে। নাহলে অপেক্ষার প্রহর আরও বাড়বে। এত লম্বা সময় ক্রিকেটের বাইরে থাকার পর পূর্বের অবস্থান ফিরে পাওয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন। তবে সাকিব এটাকেই একমাত্র চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছেন।
'ডয়চে ভেলে বাংলা'র ইউটিউব চ্যানেল ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে নিজের একমাত্র চ্যালেঞ্জ নিয়ে সাকিব বলেন, 'আগে খেলায় ফিরতে চাই। বাকিটা পরে। যেখানে থেকে আমার খেলাটা বন্ধ হয়েছে আমি ঠিক সেখান থেকেই শুরু করতে চাই। আমার কাছে এটাই এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ। খেলায় ফেরাটা আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি। '
এপ্রিলে সাকিব-শিশির দম্পতি দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের মুখ দেখেছেন। সাকিব জানিয়েছেন, তারা মেয়ের নাম রেখেছেন 'ইররাম', যা অর্থ 'জান্নাত'। বর্তমানে পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মেডিসনে অবস্থান করছেন সাকিব। লকডাউনের মাঝে পরিবারকে সঙ্গ দিচ্ছেন। তবে খেলাটাকেও ভীষণ মিস করছেন তিনি।
আবার খেলায় ফিরতে মুখিয়ে থাকা সাকিব বলেন, 'খেলতে পারছি না এটা নিয়ে মনের ভেতর তো অস্বস্তি আছেই৷ যদিও পরিস্থিতির কারণে এখন কোনো খেলাই হচ্ছে না৷ কবে খেলা শুরু হবে সেটাও অনিশ্চিত৷ আমার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরো ৫-৬ মাস আছে৷ তার আগে খেলা শুরু হয়ে গেলে আমি তো খেলতে পারবো না৷'
নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা জানিয়ে সাকিব বলেন, 'খেলতে পারছি না, বা আরো কয়েক মাস খেলতে পারবো না এটা মনে হলে খারাপ তো লাগেই৷ কিন্তু এ ঘটনা আমার জন্য একটা বড় শিক্ষাও৷ অনেক কিছু ঘটে যেটা আমরা গুরুত্ব দেই না বা অবহেলা করি৷ এটা আসলে ঠিক না৷ এখন এ শিক্ষা আমার হয়েছে। '
২০১৯ বিশ্বকাপে তিনে ব্যাট করে দারুণ সাফল্য পেয়েছেন সাকিব। অথচ জাতীয় দলে তাকে ৫ কিংবা ৬ নম্বরে নামতে দেখা গেছে। ফলে তিনে নামা তার জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ ছিল। তাতে তিনি দারুণভাবে উতরে গেছেন। এর পেছনের কারণে নিয়ে তিনি বলেন, 'দলের ভারসাম্য রাখতে চার বা পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতাম৷ তবে মনে হত উপরে ব্যাট করলে আরো রান করতে পারবো৷ সেটা হলে তো নিচের দিকের ব্যাটসম্যানদের উপর চাপই পড়বে না তাই আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েই তিন নম্বরে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলাম৷'
'সিদ্ধান্ত ভালো বা খারাপ তা বলবো না৷ দুইটাই ভালো বা দুইটাই খারাপ৷ তবে কি কারণে সিন্ধান্ত নিচ্ছি সেটাই আসল৷ উদ্দেশ্য ভালো না খারাপ৷ যদি ভালোর জন্য নেন এবং সবাই যদি সেটা বিশ্বাস করে তবে খারাপ হলেও সেটা ভালো হয়ে যাবে৷ আর সবাই বিশ্বাস না করলে ঠিক সিদ্ধান্তও খারাপ হয়ে যায়৷'
বিশ্বকাপে তিনে ব্যাট করার পেছনে সাকিবের অনুপ্রেরণা ছিলেন সাবেক প্রোটিয়া অধিনায়ক এ বিডি ভিলিয়ার্স। এ নিয়ে সাকিব বলেন, 'বিশ্বকাপের আগে বিপিএলে ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে কথা হয়েছিল। খুব সাধারণ কথাবার্তা। সে আমাকে বলল একসময় সে নিজেও নিচের দিকে ব্যাট করত। সে যদি তিনে ব্যাট করত তাহলে দলের জন্য আরও বেশি রান ও অবদান রাখতে পারত। '
'দলের কথা ভেবে সেও ৪, ৫ কিংবা ছয়ে ব্যাট করত। তার থিউরি ছিল মিডল অর্ডারে ব্যাট করে ৭০-৮০ রান করা, যা তার দলকে মাঝেমধ্যে এগিয়ে রাখতো এবং মাঝেমধ্যে এটা কাজে লাগত না। কিন্তু যখন সে তিনে ব্যাট করা শুরু করল, এরপর থেকে সে ১০০-১২০ রান করার পর্যায়ে চলে গেল এবং দলের জয়ও কিছুটা বাড়তে শুরু করল। '
'আমি ভাবতাম ২-৩ উইকেট হারানোর পর মূল দায়িত্বটা আমাকে নেব এবং দলের কাজেও লাগবে এটা। তার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। সে বলল ওই সময়, সে যদি তিনে ব্যাট করত, সে আরও বেশি রান করতে পারত এবং সেটা পরের ব্যাটসম্যানদের কাঁধ থেকে চাপ কমিতে দিতো। দুইটা দুই ধরনের চিন্তা। আমি বলছি না কোনটা ঠিক কিংবা কোনটা ভুল। বিষয় হলো, আপনি যখন সিদ্ধান্ত নেবেন, আপনার উদ্দেশ্যটাই সেখানে আসল কথা। '
'সেই থেকে আমি ভাবছিলাম আমাকে টি-টোয়েন্টিতে ওপরের দিকে ব্যাট করতে হবে। আমি ভাবলাম আগে যা করতে পারিনি অর্থাৎ ব্যাট হাতেও (ওয়ানডেতেও) দলের জন্য আরও বেশি অবদান রাখতে পারব। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি টপ অর্ডারে ব্যাট করব। ওই পজিশনে আমাদের নির্দিষ্ট কেউ নেই, ফলে আমি একবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। '
'বিশ্বকাপ হওয়ায় চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। এমনকি ম্যাচের আগের রাতেও আমার কাছে ফোন আসছিল। জানতে চাচ্ছিল আমি নিশ্চিত কি না। এটা আমাকে করতেই হবে? চাপের ব্যাপার ছিল। সবাই যেখানে দ্বিধায় আছে, সেখানে আমার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। সবাই পাশে থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। '
তবে প্রায় সবাই সাকিবের তিনে ব্যাট করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ব্যাট হাতে ঠিকই জবাব দিয়েছেন তিনি। পুরো আসরে তার ব্যাট থেকে আসে ৬০৬ রান, যা তাকে শচীন টেন্ডুলকার, ম্যাথু হেইডেন, রোহিত শর্মাদের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ওয়ানডে বিশ্বকাপের এক আসরে ৬০০ রানের মাইলফলক গড়ার পাশাপাশি তিনি ১১টি উইকেটও নিয়েছেন। ওই আসরে দলের ৮ ম্যাচে দুটি সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫টি ফিফটিও হাঁকিয়েছেন তিনি।
কিছুদিন আগে নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের সঙ্গে ফেসবুক লাইভে এসে সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও স্বীকার করেছেন, যে সাকিবের তিনে ব্যাট করা নিয়ে দলের সবাই বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু মাশরাফি জানতেন সাকিব ঠিকই চ্যালেঞ্জ জিতে আসবেন। হয়েছেও তাই। এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে তার সামনে। পুরনো রাজত্ব ফিরে পাওয়ার চ্যালেঞ্জ। সাকিব কি পারবেন?
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০২০
এমএইচএম