চট্টগ্রাম: ২২ বছরের যুবক মং গ্রী এর কণ্ঠস্বর প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গলার বাম পাশে নিচের দিকে ফুলে থাকা টিউমার সদৃশ বস্তুটা তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছিল।
মং কিভাবে এ অবস্থার শিকার হলেন- তা জানতে গিয়ে পাওয়া গেলো অবাক করা তথ্য।
রোগীর গলার পাশে দ্রুত বাড়ন্ত সেই বস্তুটি পরীক্ষা করে দেখা যায়- সেটি টিউমার বা গলগণ্ড নয়, ক্যান্সারও ছড়ায়নি। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করা ক্যারোটিড আর্টারি (ধমনি) থেকেই ঘটনার উৎপত্তি। এই ধমনির কোনও একটা অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ছিঁড়ে গিয়েছিল।
হৃদপিণ্ড এই রক্তনালী দিয়ে মস্তিষ্কের জন্য যে রক্ত পাঠায় তার কিছু অংশ ছেঁড়া স্থান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমন ভয়ংকর বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য একটি দুর্বল প্রাচীর তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালীকে ঘিরে। বেরিয়ে আসা শোণিতধারা সেই প্রাচীরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঘূর্ণিবায়ুর মতো ঘুরতে থাকে, কিছু অংশ আবার মস্তিষ্কের দিকে যাত্রা করে। দ্রুতগামী রক্তের এই অস্বাভাবিক গতিধারার কারণে সৃষ্ট শব্দ আর কম্পন চিনতে ভুল হয়নি ভাস্কুলার সার্জনের।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মিনহাজুল হাসান বাংলানিউজকে জানান, মং এর সমস্যার কেতাবি নাম- ‘ক্যারোটিড আর্টারি সিউডোঅ্যানিউরিজম’। বলা যায়, বিরল ঘটনা। চিকিৎসার পদ্ধতি দুটো, অপারেশনের মাধ্যমে অথবা রিং (স্টেন্ট) লাগিয়ে। এমন রোগীর অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল। গলার যে স্থানে স্ফীতি, সেখানে রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অপারেশন শুরু করতে হবে বুক উল্লম্বভাবে কেটে (স্টারনোটমি)। কিন্তু রোগীর অপারেশন পরবর্তী ব্যথা, জটিলতা ও ভোগান্তির কথা ভেবে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয়।
তিনি বলেন, ২য় পদ্ধতি রিং পড়ানো। সেটাও সম্ভব, কিন্তু তার জন্য যে টেকনিক্যাল ও হার্ডওয়্যার সাপোর্ট দরকার, সেটা চট্টগ্রামে নেই। তাছাড়া এমন রোগী কখনো দেখাও হয়নি। এই স্থানে রক্তনালী এভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বেলুনের মতো ফুলে ওঠা একেবারেই বিরল ঘটনা। হাসপাতালে আসার আগেই রোগী মারা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। মং অবশ্য ভাগ্যবান।
কিন্তু এ ঘটনা কিভাবে ঘটলো, তা জানা দরকার। চিকিৎসকের প্রশ্নের উত্তরে ফ্যাস ফ্যাস করে মং কিছু একটা বলেছিল, যার পাঠোদ্ধার করা যায়নি। রোগীর সঙ্গে থাকা দোভাষীও কোনও তথ্য দিতে পারেনি। এ অবস্থায় রোগীর ঘাড়ের পেছনের দিকটা পরীক্ষা করে দেখতেই বেরিয়ে আসে কারণ।
গুলির দাগ। সেটিও শুকিয়ে গেছে। গুলি তার ক্যারোটিড আর্টারির একপাশ উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সাথে ক্ষতি করেছে স্নায়ুরও। ব্যথা আর অস্বস্তিতে রোগীকে ঘাড় বাঁকিয়ে রাখতে হতো। এ অবস্থা দেখে ঝুঁকিটা নিলেন ডা. মিনহাজুল হাসান। ঢাকার ভাস্কুলার সার্জন প্রফেসর ডা. জি এম মকবুল হোসাইনের দিক নির্দেশনা ও ডা. শহিদুল ইসলাম শাহীনের সঙ্গে পরামর্শে নগরের পার্কভিউ হাসপাতালের ক্যাথল্যাবে সেপ্টেম্বরের শেষ দুপুরে হয় রিং পড়ানোর কাজ।
ডা. মিনহাজুল জানালেন, রিং বসাতেই রোগীর গলার ফোলাটা উধাও হয়ে যায়। পার্কভিউ’র ক্যাথল্যাব স্টাফরা এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল সেদিন। কারণ চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো ‘কমন ক্যারোটিড আর্টারি (লেফট) সিউডোঅ্যানিউরিজম’ এর চিকিৎসা হয় রিং লাগিয়ে (কভার্ড স্টেন্ট)।
মং এর পর আরও কয়েকবার এসেছেন কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে দেওয়া এই চিকিৎসকের কাছে। গলার ফোলা ভাব কিছুটা ছিল। চিকিৎসকের ভাষায়, ‘সেটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। মানুষের শরীরও এমন। শূন্যস্থান রক্ত বা অন্য কোনও বডি ফ্লুইডে পূর্ণ হয়ে যায়’।
রোগীকে আশ্বস্ত করা হলো। আর অপারেশন না করার কথা বলা হলো। কিন্তু রোগী মানলো না। পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরতে চায়। অগত্যা গত ৬ নভেম্বর দ্বিতীয়বার এই রোগীর অপারেশনটাও করতে হলো ডা. মিনহাজুল হাসানকে।
জানা গেছে, মং এখন পুরোপুরি সুস্থ। গলার ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজের জন্য তাকে নাক কান গলারোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দিয়েছেন দেবদূত হয়ে আসা এই চিকিৎসক। তবে সেটা নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা নেই।
ডা. মিনহাজুল হাসান বলেন, ‘ভাষার সমস্যা মং আর আমার মাঝে দেয়াল হয়ে ছিল বরাবরই। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল তার কষ্ট। সঙ্গে ছিল কঠিনকে জয় করার প্রচেষ্টা’।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২৪
এসি/টিসি