ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮ রজব ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

মাদক মামলা কমেছে, বেড়েছে নিষ্পত্তির হার

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২৫
মাদক মামলা কমেছে, বেড়েছে নিষ্পত্তির হার ...

চট্টগ্রাম: মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে চট্টগ্রাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

মাদকদ্রব্য উদ্ধারে এখনও খুব বেশি তৎপর নয় সংশ্লিষ্টরা।  

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে মাদক উদ্ধারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালনকারী সংস্থা পুলিশ কয়েকদিন একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল।

পরবর্তীতে কাজে যোগ দিলে আগের মতো অভিযান পরিচালনা করছে না সংস্থাটি। এ কারণে মাদক উদ্ধার অভিযানের পাশাপাশি মামলার সংখ্যাও কমেছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভূ-আঞ্চলিক কারণে মাদকের উৎপত্তির নিকটস্থ ত্রিভূজের সীমানায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার অবস্থান। একারণে এসব জেলার সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো থেকে আগে চট্টগ্রামে প্রবেশের আগে তল্লাশির মুখে পড়তে হতো। একাধিক চেকপোস্টে যানবাহন থামিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হতো। এসব অভিযান থেকে উদ্ধার হতো মাদক। একইসঙ্গে এসব ঘটনায় মামলা হতো থানায়।  

বিশেষায়িত সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ডসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাদক নিয়ে কাজ করেন। এসব বাহিনী ও সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাদক ব্যবসা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বর্তমানে অনেকটা বিনা বাধায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে মাদক কারবারিরা। এক্ষেত্রে তাদের অবৈধ ব্যবসায় সহযোগিতা করছে অসাধু রাজনৈতিক নেতারা।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে মোট মাদকের মামলা ছিল ১০ হাজার ৬২৬টি। ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৮৫টি। ২০২১ সালে বিচারাধীন ছিল ১০ হাজার ৩৪৩টি মামলা, ২০২২ সালে ১০ হাজার ৫৫১টি।  ২০২১ সালে মাদকের মামলা নিষ্পত্তি হয় ২৮৩টি, ২০২২ সালে ৬৬৭টি। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মাদকের মামলা হয়েছিল ২ হাজার ৬৪৪টি। ২০২২ সালে মামলার সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৬৯টি। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মাদকের মামলা হয়েছিল ১ হাজার ৭৪০টি, ২০২২ সালে ১ হাজার ৭১১টি।

জানা গেছে, মাদক আইনের মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার জন্য ডিসি, এসপি, ওসি ও আইওকে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকলে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তাকেও সাক্ষী আনাসহ মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ এজাহার ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতায় মাদক মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া, আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা তৈরি না করা, জব্দ তালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল, আদালতে সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে আসেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মাদক মামলা নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাক্ষী। কিন্তু অনেক সাক্ষীই আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে নারাজ। সমন জারির পরও সাক্ষী হাজির হয় না। অনেক মামলার সাধারণ সাক্ষীও খুঁজে পাওয়া যায় না। মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকে সাক্ষ্য দিতে ভয় পায়। তাই সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অবসরে গেলে সাক্ষী সঠিক সময়ে হাজির হয় না। কেউ বদলি হয়ে গেলে অন্য জেলা থেকে এসে সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর ৪৪ ধারায় মাদকের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল স্থাপননের কথা বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া পর্যন্ত সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংশ্লিষ্ট জেলা জজ বা দায়রা জজকে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব প্রদান করতে পারবেন বলেও আইনে বলা হয়েছে।  

এই আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী, মাদকদ্রব্যসহ আসামি ধরা পড়লে আদালতে সোপর্দ করার ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে এবং আসামি ধরা না পড়লে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তা এতে ব্যর্থ হলে কারণ উল্লেখ করে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দেবেন। এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এবং আদালতে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরবর্তী প্রতিবেদন দিতে হবে। এরপর যদি নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়, তাকে আসামিসহ মামলা ১৫দিন এবং আসামিহীন মামলা ৩০দিনে তদন্ত শেষ করতে হবে। নতুন আইনের ৫১ ধারা অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা পাওয়ার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টকে লিখিতভাবে জানাতে হবে এবং এর অনুলিপি সরকারকে পাঠাতে হবে। একইভাবে আরও ১৫দিন সময় বাড়াতে পারবেন ট্রাইব্যুনাল।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) রিয়াদ উদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, আগের চেয়ে মাদক মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেড়েছে। মাদকের মামলার অধিকাংশই সাক্ষীর জন্য নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সাক্ষী হাজিরের জন্য সমন দিলেও আদালতে উপস্থিত হয় না। অথচ আদালতে সাক্ষী এলে ফেরত পাঠানো হয় না। বর্তমানে মাদক মামলায় দ্রুত সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক মো. সাখাওয়াত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতিতে এসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আদালতে মামলা জট বাড়ছে। বছরের পর বছর ঝুলে থাকায় অনেক আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে ফের মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে।  মাদকের পরিমাণ ও মূল্যের দিকেই শুধু গুরুত্ব না দিয়ে ছোট-বড় সব মাদক মামলায় গুরুত্ব দিতে হবে।  মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।  

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর এর সাধারণ সম্পাদক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সরকার, সকল রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের দেশ ও সমাজের স্বার্থে একই প্লাটফর্মে থেকে কাজ করতে হবে। মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা করতে হবে মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গীর্জার ফাদারদের মাধ্যমে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে মাদক সেবনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২৫
এমআই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।