নয়াদিল্লি থেকে: জেসিসি বৈঠকে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারত। বিশেষ করে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগির চুক্তির ক্ষেত্রে পূর্বের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকার বিষয়টি পুনরায় ব্যক্ত করেছে ভারতীয় পক্ষ।
এছাড়া আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছে ভারত সরকার।
তৃতীয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক শেষে শনিবার দুপুরে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়।
পরে নেহেরু ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিনও পানি সমস্যা সমাধানে ভারতের ইতিবাচক অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।
যৌথ ইশতেহারে বলা হয়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের নেতৃত্বে উভয়পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত শনিবারের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় নানা ইস্যুতে আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়। আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় যৌথ ইশতেহারে।
বিশেষ করে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের পূর্বের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকার ব্যাপারে পুনরায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে ভারত।
যৌথ ইশতেহারে আরও জানানো হয়, প্রস্তাবিত আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের হিমালয় অববাহিকার অংশের ব্যাপারে ভারত সরকার এককভাবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া উভয় পক্ষই ঢাকায় সুবিধামত সময়ে ৩৮তম যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক আয়োজনের ব্যাপারে একমত হয়। জেআরসির টিপাইমুখ পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প সংক্রান্ত সাব গ্রুপের তৃতীয় বৈঠক দ্রুত অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও একমত হয়েছে উভয় পক্ষ।
জেসিসি বৈঠকের পর নেহেরু ভবনে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিন বলেন, পানি একটি স্পর্শকাতর একটি বিষয়। আমরা এ বিষয়টি সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বিষয়কে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সমাধানের ভারত সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
যৌথ ইশতেহারে আরও জানানো হয়, জেসিসি বৈঠকে উভয় মন্ত্রীই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জেসিসি বৈঠকে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন উভয় মন্ত্রী।
এছাড়া বাণিজ্য,বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, সংযোগ, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, পানি, বিদ্যুত, জাহাজ চলাচল, উন্নয়ন সহযোগিতা, শিল্প সংস্কৃতি, মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়েও বিস্তৃত আলোচনা হয় উভয় মন্ত্রীর মধ্যে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সফলতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন উভয় পক্ষই। পাশাপাশি এই সফর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে বলেও একমত পোষণ করেন তারা।
এছাড়া বৈঠকে ভারতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সফর এবং বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের অগ্রগতির বিষয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়া গত মার্চ মাসে জেএসসি বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের বিষয়ে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেন উভয় পক্ষ। পাশাপাশি এই সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তারা।
দুই মন্ত্রী এ সময় সমুদ্র সীমানার রায় নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিস্ট বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তারা।
এছাড়া বৈঠকে ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। বৈঠকে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে যেসব বাধা রয়েছে তার একটি তালিকা ভারতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ভারত এই তালিকা যাচাই করার আশ্বাস দেয়। এ সময় বাংলাদেশে বিশেষ ভারতীয় শিল্প জোন তৈরি করার বাংলাদেশি প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় ভারত।
একই সঙ্গে আগামী বছরের ৩১ মার্চ মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে যাওয়া বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়নের ব্যাপারে আলোচনার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন উভয় মন্ত্রী।
উভয় পক্ষ বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তে অবস্থিত কাস্টমস স্টেশন,স্থলবন্দর ইত্যাদির উন্নয়নে একমত হন। পাশাপাশি আখাউরা আগরতলা সমন্বিত চেকপোস্টের কার্যক্রমেও সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা।
এছাড়া থেগামুখ-ডিমাগিরি এবং সাব্রুম-রামগড় স্থল শুল্ক স্টেশনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে একমত হন দুই মন্ত্রী। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের বিএসটিআই ও ভারতের ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দেন তারা।
উভয় দেশ আরও বেশি সংখ্যক সীমান্ত হাট স্থাপনের বিষয়ে একমত হয়, এবং এ ব্যাপারে অগ্রগতির বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন দুই পক্ষই।
এ সময় বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের ৮শ’ মিলিয়ন ডলার ঋণের বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। উভয়পক্ষই প্রকল্পগুলো সন্তোষজনকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।
একই সঙ্গে আশুগঞ্জে ইনল্যান্ড রিভার পোর্ট স্থাপনের বিষয়ে অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। তাছাড়া ইশ্বরদীতে একটি রেল কনটেইনার ডিপো স্থাপনের বিষয়ে নিজেদের আগ্রহ ব্যক্ত করে ভারত। একই সঙ্গে আশুগঞ্জ-আখাউরা সড়ক নির্মাণ এবং বিদ্যমান সড়কটি উন্নয়নের বিষয়েও আলোচনা হয়।
এছাড়া ঢাকা-শিলং প্রস্তাবিত বাস সার্ভিসকে স্বাগত জানান উভয় মন্ত্রী। পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সার্ভিসকে আরও উন্নত করার বিষয়েও আলোচনা হয়। এছাড়া উভয় দেশের মধ্যে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়।
বিদ্যুত ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশের সহযোগিতার সাফল্যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন উভয় মন্ত্রীই। বিশেষ করে ২০১৩ সালে ভেড়ামারা-বহরমপুর গ্রিডের মধ্যে আন্তঃসংযোগ এবং ভারত থেকে বাংলাদেশের ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেনার সাফল্যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এছাড়া ত্রিপুরার পলাটানা বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে ১০০ মেগাওয়াট বিদু্ত সরবরাহের ক্ষেত্রে হওয়া অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন উভয় মন্ত্রীই।
পাশাপাশি বহরমপুর-ভেড়ামারা লাইনে বিদ্যুত সরবরাহ ৫শ‘ মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট করার ব্যাপারে যৌথ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান তারা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে বিদ্যুত সরবরাহের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে।
একই সঙ্গে বাগেরহাটের রামপালে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের স্মারক ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন উভয় মন্ত্রী।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিমসটেক সচিবালয়ের উদ্বোধনের জন্য এ সময় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানায় ভারত। একই সঙ্গে আগামী নভেম্বরে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন সফল করার ব্যাপারেও একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করেন উভয় মন্ত্রী।
এছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠকে দু’দেশের গঠনমূলক সংলাপে সন্তোষ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এর মধ্যে ঢাকায় স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক ও নয়াদিল্লিতে বিএসএফ-বিজিবি’র ডিজি পর্যায়ের বৈঠকের কথা উল্লেখ করা হয় বৈঠকে।
জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক অবস্থানে সন্তোষ প্রকাশ করেন ভারতীয় মন্ত্রী। একইসঙ্গে বাংলাদেশের মাটি কোনো দেশের-বিশেষত ভারতের-জন্য সন্ত্রাসবাদের হুমকি হবে না বলে ঢাকার পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ সময় সীমান্তে অপরাধ দমন ও মর্মান্তিক প্রাণহানি বন্ধে উন্নত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজম্যান্ট প্ল্যানের (সিবিএমপি) কার্যকর প্রয়োগের ওপর জোর দেন দুই মন্ত্রী। সীমান্তে মর্মান্তিক প্রাণহানি বন্ধে ভারতের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দু’পক্ষই সীমান্তে প্রাণহানি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার ব্যাপারে মতৈক্য প্রকাশ করেন।
যোগাযোগ সহজীকরণে ফুলবাড়ি-বাংলাবান্ধা সীমান্তে শিগগির ইমিগ্রেশন সুবিধা চালুর জন্য বাংলাদেশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফুলবাড়িতে ইমিগ্রেশন সুবিধা চালু করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে এবং শিগগির ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শুরু হবে।
উল্লেখ্য, শনিবার সকাল দশটায় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জেসিসি বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেন সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ভারতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দেন সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলে এ বৈঠক।
ভারত সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সহ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সফর শেষে জাতিসংঘের ৬৯ তম সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে শনিবার রাতেই দিল্লি থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
** নুর হোসেনকে ফেরত দেবে ভারত, প্রক্রিয়া চলছে অনুপ চেটিয়ার
** ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বানায়া, হাসিনা বাংলাদেশ বাঁচায়া’
** জেসিসি বৈঠকে তিস্তায় জোর
** জেসিসি বৈঠক চলছে
** বঙ্গবন্ধু স্থপতি, হাসিনার হাতে সুরক্ষা বাংলাদেশের, বললেন মোদী
** সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা
** বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ মোদীর
** সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে ভারত
** সারদা প্রসঙ্গ ভারতের অভ্যন্তরীণ
** তিস্তাসহ অমীমাংসিত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে
** জানুয়ারিতে ঢাকায় আসতে পারেন মোদী
** সমঝোতায় প্রাপ্য আদায়ে সচেষ্ট হবে বাংলাদেশ
** দিল্লির ফুটপাতেও মোটর সাইকেল!
** দিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
** তিস্তা চুক্তিতে জোর দেবে বাংলাদেশ
** সাবেক কংগ্রেস মন্ত্রীর পানির লাইন বিচ্ছিন্ন
বাংলাদেশ সময়: ১৮২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০৩০/আপডেটেড