ঢাকা: শান্তিপূর্ণভাবেই বুধবার শেষ হলো ভারতের মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার রাজ্যের আইনসভার ভোটগ্রহণ।
উৎসবপূর্ণ পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে ভারতের মাহাত্ম্য আবারও উপস্থাপিত হলো বিশ্বের সামনে।
বিকেল ৫টা নাগাদ হরিয়ানায় পড়েছে ৬৫ শতাংশ ভোট এবং মহারাষ্ট্রে পড়েছে ৫৫ শতাংশ ভোট।
এই অধিক ভোটার উপস্থিতিকে আশীর্বাদ মানছে বিজেপি। বিজেপি নেতাদের দাবি প্রধানমন্ত্রী মোদীর ডাকে সাড়া দিয়ে দুই রাজ্যেই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের শাসনের অবসান ঘটাতে বেশি করে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হচ্ছেন ভোটাররা। এর সত্যতা কতটুকু তা অবশ্য টের পাওয়া যাবে ১৯ তারিখে ভোট গণনার দিন।
পাখির চোখের দৃষ্টিতে এই দুই রাজ্যের নির্বাচনী ডামাডোলকে পর্যবেক্ষণ করলে এটা পরিষ্কার যে উভয় রাজ্যেই বিজেপির বাজি মোদী ম্যাজিকের ক্যারিশমা। এমনকি ভোটগ্রহণের দিনও পরিষ্কার নয় নির্বাচনে জিতলে কে হবেন এই দুই রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী।
তাই বিজেপির জন্য পুরো নির্বাচনীয় প্রচারণাটাই রূপ নিয়েছে ‘ওয়ান ম্যান শো’ অর্থাৎ পুরোটাই মোদী কেন্দ্রিক।
বিজেপির ধারণা লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে ‘মোদী ওয়েভে‘ ভেসে গিয়েছিলো বিরোধীরা, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে দুই রাজ্যেই। বিশেষ করে মোদী হাওয়ায় সওয়ার হয়ে মহারাষ্ট্রে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বিজেপি।
বিজেপি মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মোদী যেসব অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন লোকসভা নির্বাচনে তা সাদরে গ্রহণ করেছে ভারতের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মহারাষ্ট্রের জনগণ। এখন রাজ্যের ক্ষমতার পালাবদলের সময়ও মোদী ম্যাজিকের ওপর ভোটারদের মুগ্ধতাকে বগলদাবা করে ভোট বাক্সবন্দি করার ছক একেছে বিজেপি।
বিজেপির স্বপ্ন এখন তাই মোদীর ওপর ভর করে কেন্দ্রের পাশাপাশি এককভাবে বাণিজ্যিক রাজধানীর ক্ষমতাও কুক্ষিগত করা। এককভাবে মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে ‘মোদী ওয়েভ’ এর ওপর বিজেপির এতটাই আস্থা যে শিবসেনার মত দীর্ঘ ২৫ বছরের বিশ্বস্ত মিত্রকেও ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করেনি তারা।
তাই এই দুই রাজ্যের নির্বাচনকে মোদীর জনপ্রিয়তার পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ভোট সামনে রেখে কোমড় বেঁধে নেমেছিলেন মোদী নিজেও। বুধবার ভোটের দিনও মহারাষ্ট্রের সব শীর্ষ পত্রিকার প্রথম পাতায় শোভা পায় সগর্বে দণ্ডায়মান মোদীর ছবি সহ বিজেপির বিজ্ঞাপন।
তবে মহারাষ্ট্রে মোদী ম্যাজিকের সামনে একমাত্র পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন ভারতের পারিবারিক রাজনীতির আরেক প্রতিভূ প্রয়াত হিন্দু মৌলবাদী নেতা বাল থ্যাকরের পুত্র উদ্ভব থ্যাকরে। বাল থ্যাকরে মারা যাওয়ার পর উদ্ভবই এখন শিবসেনার দণ্ডমুন্ডের কর্তা।
পিতার মতই পার্সানোলিটি কাল্টে বিশ্বাসী পুত্র উদ্ভব। মহারাষ্ট্র তথা ভারতবাসীর সামনে পিতার মতই এক অনমনীয় চরিত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চান তিনি। এক্ষেত্রে এই নির্বাচন তার জন্য মোক্ষম সুযোগ।
যদি নির্বাচনে বিজেপি আশানুরূপ আসন না পায়, পক্ষান্তরে শিবসেনা লাভ করে সম্মানজনক আসন, সেক্ষেত্রে মোদী ম্যাজিক মহারাষ্ট্রে এসে থেমে গেছে, এমনটা বলা সহজ হবে শিবসেনার পক্ষে।
সেজন্যই ভোট সামনে রেখে ব্যক্তিগতভাবে মোদীর বিরুদ্ধে একের পর এক কামানের গোলা দেগে গেছেন উদ্ভব। আর ভোটের একদিন আগে তো মোদীকে বিদ্ধ করলেন তার তূনের সবচেয়ে বিষাক্ত তীরে।
দলীয় মুখপত্র সামনায় এক কলামে তিনি মোদীকে ‘চাওয়ালা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, যদি মোদীর মত একজন ‘চাওয়ালা’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, তবে তার যোগ্যতা রয়েছে মহারাষ্ট্রের কুরসিতে বসার।
একই সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে মোদী ম্যাজিককে কটাক্ষ করে বলেছেন, শিবসেনা না থাকলে মোদী কেন মোদীর বাবা দামোদর দাসের পক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সম্ভব হতো না।
পিতা বাল থ্যাকরের মত ‘স্ট্রং ম্যান’ ইমেজের ঐতিহ্য ধরে রেখে মহারাষ্ট্রের ওপর ছড়ি ঘোরানোর বাসনা তার। তাই স্বাভাবিকভাবেই মহারাষ্ট্রে বিজেপির মোদী বন্দনাকে খুব ভালোভাবে নেননি তিনি। অনেকের ধারণা শুধু মোদীর প্রতি ঈর্ষা থেকেই বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন উদ্ভব।
সমালোচকদের মতে বুধবারের ভোটকে উদ্ভব তাই নিয়েছেন নিজের সঙ্গে মোদীর ব্যক্তিত্বের সংঘাতের একটি যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে। এ লড়াইয়ে মহারাষ্ট্রের ক্ষমতার থেকেও তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মোদীর ব্যক্তিগত কাল্ট ইমেজের ধ্বংসসাধন।
আবার উদ্ভবের প্রতিও নাকি একই রকম মনোভাব মোদীর। শিবসেনাকে বাদ দিয়ে এককভাবে নির্বাচনে লড়ার ইচ্ছাটা নাকি মোদীর আগে থেকেই ছিলো।
দিল্লি ও হিন্দি বলয় জয় করলেও মহারাষ্ট্র তথা মারাঠাভূমি জয়টি এখনও ঠিকমতো হয়নি বলে মনে করেন মোদী। তাই তার এবারের লক্ষ্য মহারাষ্ট্র। দিল্লি জয় তো আগেই হয়েছে, এবার মোদীর টার্গেট মুম্বাই।
এজন্যই আসন ভাগাভাগি প্রশ্নে শিবসেনার সঙ্গে আলোচনা করতে তিনি পাঠিয়েছিলেন তার বিশ্বস্ত সেনাপতি অমিত শাহকে।
সমালোচকরা বলছেন, শিবসেনার সঙ্গে সম্পর্ক টেকানোর থেকে অমিত শাহ নাকি বেশি উৎসাহী ছিলেন সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে। আর মোদীর আঙ্গুলের ইশারা ছাড়া অমিত শাহ এক পা নড়েন না এটা তো জানা কথাই।
মহারাষ্ট্রে বিজেপি এবং শিবসেনা জোট ৪৮টি লোকসভা সিটের মধ্যে পেয়েছিলো ৪২টি। যার মধ্যে বিজেপির ছিলো ২৩টি। মূলত এই বিষয়টিই আত্মবিশ্বাস যোগায় মোদীকে। তিনি মনে করছেন শিবসেনাকে বাদ দিয়েই মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে সক্ষম বিজেপি।
সব মিলিয়ে মহারাষ্ট্রের ভোটের লড়াই আসলে দাঁড়িয়েছে মোদী ও উদ্ভব থ্যাকরের ব্যক্তিত্বের। যে লড়াই এসে মিলেছে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে এসে।
যদি এ নির্বাচনে বিজেপি হারে তবে হার হবে মোদীর একার। এমনকি যদি শিবসেনা কাঙ্খিত আসন নাও পায়, যদি ক্ষমতা যায় কংগ্রেস এনসিপির ঘরে, তারপরও উদ্ভব থ্যাকরে নিজেকে বিজয়ী বলে ভাবতে পারবেন। ব্যক্তিত্বের সংঘাতে শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হয়েছেন ভেবে লাভ করবেন আত্মপ্রসাদ।
অপরদিকে যদি এই ভোটে লোকসভা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে সক্ষম হয় বিজেপি তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উদ্ভব থ্যাকরে।
মোদীর কাছে ব্যক্তিত্বের সংঘাতে হেরে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবেন তিনি। আর এ সুযোগে তার জায়গা দখল করে নেবে তারই চাচাতো ভাই মহারাষ্ট্রের আরেক উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা রাজ থ্যাকরে। যিনি নেতৃত্বে রয়েছেন শিব সেনার থেকেও উগ্র সংগঠন মহরাষ্ট্র নবনির্মাণ সংঘের নেতৃত্বে।
তাই যতই কাগজ কলমে মহারাষ্ট্রের ভোট চতুর্মুখী হিসেবে বিবেচিত হোক না কেন মহারাষ্ট্রের ভোট আসলে হচ্ছে দুই ব্যক্তির মধ্যে। একজন মোদী অপরজন উদ্ভব থ্যাকরে। দুইজনের যে কোনো একজনের পতনের শুরু হবে এই নির্বাচনে।
তো এ লড়াইয়ের হারজিত জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ভোটের ফল ঘোষণার দিন পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সময়: ০২১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৪